বিশ্বকাপ জয়ী ইমরান কী কারণে দেশের রাজনীতিতে পরাজিত?

পাকিস্তানকে প্রথম এবং একমাত্র ক্রিকেট বিশ্বকাপ এনে দিয়েছেন ইমরান খান। ক্রিকেট জীবনে দীর্ঘ এক দশক ধরে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু ধরে রাখতে পারলেন না রাজনীতির মাঠের নিজের অবস্থান। অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হলো তাকে। আর পাকিস্তানের ইতিহাসে এটাই প্রথমবার কোনো প্রধানমন্ত্রীর অনাস্থা ভোটে হেরে বিদায় নিতে হয়।

শনিবার (৯ এপ্রিল) জাতীয় অধিবেশনে অনাস্থা ভোটের প্রক্রিয়া শুরু হতে না হতেই হেলিকপ্টারে করে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ছেড়ে নিজস্ব বাসভবনের উদ্দেশে রওনা দেন ইমরান খান।

২০১৮ সালে ইমরান খান যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন তখন মনে হচ্ছিল যেন সবকিছু তারই পক্ষে কাজ করছে। ক্রিকেট খেলার সেই দিনগুলো থেকেই একজন জাতীয় বীর, তারপর তার রূপান্তর একজন ক্যারিশম্যাটিক রাজনৈতিক নেতা হিসেবে।

বহু দশক ধরে পাকিস্তানের রাজনীতিতে গেঁড়ে বসা প্রতিদ্বন্দ্বী দুই পরিবারকে বেশ সংগ্রামের পর অপসারণ করতে পেরেছেন। আবেদনময় সব গান নিয়ে প্রাণবন্ত রাজনৈতিক সমাবেশ, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জোরালো উপস্থিতিসহ তার আবির্ভাব হয়েছিল দুর্নীতিবিরোধী নতুন শক্তি হিসেবে।

দেশটিতে এপর্যন্ত কোনো প্রধানমন্ত্রী তার পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। মনে হচ্ছিল যেন ইমরান খান হয়তো প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেই ইতিহাস বদলাতে পারবেন। যে কারণে তাকে তার অবস্থানে খুব সংহত মনে হয়েছিল সেই একই কারণ দিয়েই তার পতন ব্যাখ্যা করা যায়।

তিনি পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় ক্ষমতায় আসীন হয়েছিলেন বলে মনে করা হয় - যদিও দুই পক্ষই এমন দাবি অস্বীকার করে। কিন্তু এখন তাদের সাথে সেই সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্বের বেশিরভাগ সময় ধরেই দেশটির নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সেনাবাহিনীর হাতে। সমালোচকরা ইমরান খানের শাসনকালকে 'হাইব্রিড; সরকার বলে আখ্যা দিয়ে এসেছে। তার প্রতি সেনা সমর্থন নানা উদাহরণ রয়েছে।

ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর ইমরান খান বেশ গর্বের সাথে ঘোষণা দিয়েছেন যে নীতি নির্ধারণের বিষয়ে সেনাবাহিনীর সাথে তার অবস্থান একই। যার একটি ফল ছিল ইমরান সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থার সমালোচক হিসেবে পরিচিত ব্যক্তি এবং সাংবাদিকদের আক্রমণ ও অপহরণ। যাতে উদ্বেগ প্রকাশ করে এসেছে সুশীল সমাজ। অন্যদিকে তা অস্বীকার করে এসেছে অভিযুক্ত দুই পক্ষই। এসব আক্রমণের জন্যেও কাউকে কখনো চিহ্নিত করা যায়নি। তবে সেনাবাহিনীর জন্য সবচেয়ে ভাল বিকল্প ছিলেন ইমরান খান।

রাজনীতির গতিতে নাটকীয় পরিবর্তন আসে গত বছর। বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেছিলেন যে, বিশেষ করে পাঞ্জাবে সুশাসন নিশ্চিত করতে ইমরান খানের ব্যর্থতায় সেনাবাহিনীতে বিরক্তি বাড়ছিল এবং সম্ভবত তাকে ক্ষমতায় বসানোর ব্যাপারে যে সমালোচনার মুখে তারা সেনাবাহিনী ছিল সেটির প্রভাব পড়ছিল। খবর-বিবিসি।

কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়া এবং গোয়েন্দা প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফায়েজ হামিদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেওয়ায়।
ফায়েজ হামিদ পরিবর্তী সেনাপ্রধান হওয়ার আশা পোষণ করতেন। সেনাপ্রধান হওয়ার ব্যাপারে তিনি এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে তিনি আফগান কর্মকর্তাদের সাথে সে ব্যাপারে কথাবার্তা বলেছিলেন।

যদিও সেনাবাহিনীর সাথে ঘনিষ্ঠ এক সূত্র বলেছিল, লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদকে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ, বিরোধীদের মুখ বন্ধ করার মত ‘নোংরা কাজে’ উপযুক্ত মনে করা হলেও তাকে সেনাপ্রধান হিসেবে যোগ্য মনে করা হয়নি।

জেনারেল বাজওয়া এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফায়েজ হামিদের মধ্যেকার বিরোধ প্রকাশ্য হয়ে উঠেছিল গত গ্রীষ্ম মৌসুমে প্রভাবশালী রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সাথে এক আলাপচারিতার সময়।

একজন সাংবাদিক একটি প্রশ্ন করেছিলেন, কিন্তু আইএসআই প্রধান বলেন, ‘সময় শেষ হয়ে গেছে’।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদকে থামিয়ে দিয়ে জেনারেল বাজওয়া বলেছিলেন, ‘আমি হচ্ছি সেনাপ্রধান এবং আমি সিদ্ধান্ত নেব কখন সময় শেষ হবে’। এমনকি ওই সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরও দেন সেনাপ্রধান।

অক্টোবর মাসে তাদের দুজনের বিরোধ চরমে পৌঁছায় এবং এর মধ্যে পড়ে যান ইমরান খান।

জেনারেল বাজওয়া গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান হিসেবে নতুন কারো কথা ভাবছিলেন এবং বিভিন্ন পদে পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছিল সেনাবাহিনী। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন ইমরান খান, যিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন। পরিবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত আইএসআই প্রধান স্বপদে থাকুন সেটা চাইছিলেন ইমরান।

ইমরান মনে করছিলেন যে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদ তাকে আরো একবার জয়ী হতে সাহায্য করতে পারবেন। তার পদ পরিবর্তন বিষয়ক প্রজ্ঞাপন সপ্তাতিনেক আটকিয়েও রেখেছিলেন ইমরান, যদিও শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়তে হয় তাকে। তবে এসব কারণে সেনাবাহিনীর সাথে ইমরান খানের সরকারের সম্পর্কের ফাটল আরো প্রকাশ্য হয়।

ইমরান খানের বিরুদ্ধে যখন অনাস্থা ভোটের পরিকল্পনা হচ্ছিল, তার দল থেকে কারা বেরিয়ে যাবেন সেটি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। তখন বেশ কটি সূত্র থেকে বিবিসিকে বলা হয়েছিল, সেনাবাহিনী এ ব্যাপারে 'নিরপেক্ষ' থাকবে বলে উল্লেখ করেছে।

ইমরানের দলত্যাগী একজন বিবিসিকে বলেছেন, তিনি এবং অন্য সংসদ সদস্যরা গোয়েন্দা বাহিনী থেকে ফোন কল পেতেন এবং তাদেরকে বলে দেওয়া হতো কি করতে হবে। “আমাদের সাথে ভাল আচরণ করা হত না”, বেশ বিরক্তির সাথে বলছিলেন তিনি। তবে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদ তার পদ থেকে সরে যাওয়ার পর থেকে এমন ফোন কল বন্ধ হয়েছে বলে উল্লেখ করছিলেন তিনি। তিনি বলেন, “এখন আর সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করছে না”।

বিবিসিকে সাংবাদিক কামরান ইওসাফ বলেছেন, ‘সেনাবাহিনী ইমরান খানের মিত্রদের "সামাল" দিয়ে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতার জায়গা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনছিল। সমর্থন কমে যাওয়া তার পতন ডেকে আনল’।

পররাষ্ট্র নীতিতেও ইমরান খানের সাথে সেনাবাহিনীর মতবিরোধ ছিল। যেদিন রাশিয়ান সেনাবাহিনী ইউক্রেনের সীমান্ত অতিক্রম করেছিল সেদিন মস্কো সফর করেছিলেন ইমরান খান। পশ্চিমা কর্মকর্তারা তদ্বির করছিলেন ইমরান যেন ভ্লাদিমির পুতিনের নিন্দা জানান। কিন্তু তাতেও সাড়া দেননি তিনি। ওদিকে সেনাবাহিনীর সুর ছিল একেবারে ভিন্ন।

এর আগে নিজের রাজনৈতিক ক্ষতির কথা ভেবে ভারতের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক আংশিকভাবে পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে জেনারেল বাজওয়ার উদ্যোগ প্রতিহত করেছিলেন ইমরান খান, বলছিলেন ইউসাফ।

যদিও এর আগে উল্টো ভারতের সাথে সম্পর্কের উন্নতি করতে চেয়ে পাকিস্তানে সরকার পতন হয়েছে, কারণ তখন সেনাবাহিনী সেটা চায়নি। ইমরান যদিও বারবার বলে গেছেন যে, তিনি লড়াই থেকে সরে দাঁড়াবেন না এবং তিনি 'যুক্তরাষ্ট্রের শাসক পরিবর্তন চেষ্টার শিকার'। কারণ পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি পশ্চিমাবিরোধী হয়ে উঠছে এবং আফগানিস্তানে মার্কিন যুদ্ধের সমালোচনা করেছে। যদিও তার এই দাবি অতিরঞ্জিত বলে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। তবে ইমরানের সমর্থকরা মার্কিনবিরোধী মানসিকতায় ক্রমাগত ঢোলের বাড়ি দিয়ে চলেছে। কিন্তু পাকিস্তানের সেনাবাহিনীও দেশটিতে এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছে যেখানে ‘বিদেশি চক্রান্ত’ ধারণাটি বারবার ব্যবহার করা হয়েছে।

খেলোয়াড়ি জীবনে ইমরান খান তার দলের খেলোয়াড়দের একবার বলেছিলেন “কোণঠাসা হয়ে পড়া বাঘের মত লড়াই করতে”। মনে হচ্ছে তিনি এখন এক ‘কোনাঠাসা বাঘের মত’ শক্তিশালী বিরোধী চরিত্রে পরিণত হতে যাচ্ছেন।

১৯৫২ সালে লাহৌরে উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া ইমরান খান ছোট থেকেই ক্রিকেটের পাশাপাশি পড়াশোনাতেও ছিলেন তুখোড়। ১৯৭৫ সালে অক্সফোর্ডের কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করেন তিনি। তার চার বছর আগেই মাত্র ১৮ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট অভিষেক ঘটে তার। ১৯৭১ সালে শুরু হওয়া তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জীবন প্রায় দু’দশকের। ১৯৭৪ সালে এক দিনের ক্রিকেটে পাকিস্তানের হয়ে খেলার সুযোগ পান। ১৯৯২ সালে দেশকে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন করার পর পাকাপাকি ভাবে বিদায় জানান ক্রিকেটের বাইশ গজকে। ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের ব্র্যাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যও ছিলেন তিনি।