করোনাভাইরাস

ভারতের হাসপাতালে যায়গা নেই, লড়াই এখন বাড়িতে, অক্সিজেনের দাম আকাশচুম্বী

প্রকাশ : ২৭ এপ্রিল ২০২১, ১৪:৩৪

বিবিসি বাংলা

ভারতের রাজধানী দিল্লি এবং আরো বহু শহরে হাসপাতালে কোনো শয্যা আর খালি নেই। খালি থাকলেও বহু হাসপাতাল রোগী নিচ্ছে না অক্সিজেনের অভাবের কারণে।

ফলে গুরুতর অসুস্থ কোভিড রোগীদের বাড়িতেই যতটুকু সম্ভব চিকিৎসা দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন স্বজনরা।

প্রাণ বাঁচানোর জন্য বহু মানুষকে কালো বাজারের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। সেখানে জরুরী ওষুধ এবং অক্সিজেন সিলিন্ডারের দাম এখন আকাশচুম্বী।

কোভিড চিকিৎসার নামে এমন সব ওষুধ গোপনে বিক্রি হচ্ছে, যেগুলো আসল না নকল এবং আদৌ সেগুলো ব্যবহার করা উচিৎ কিনা - তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

অংশু প্রিয়া তার কোভিড আক্রান্ত শ্বশুরের চিকিৎসার জন্য দিল্লি বা শহরতলী নয়ডার কোনো হাসপাতালেই জায়গা পাননি। শ্বশুরের অবস্থা ক্রমেই সঙ্গীন হয়ে পড়ছে, কিন্তু এক সিলিন্ডার অক্সিজেনের খোঁজে সারাদিন ঘুরেও ব্যর্থ হয়েছেন।

ফলে বাধ্য হয়ে কালোবাজার থেকে ৫০ হাজার রুপি দিয়ে এক সিলিন্ডার অক্সিজেন কিনেছেন। স্বাভাবিক সময়ে এই সিলিন্ডারের দাম বড়জোর ছয় হাজার রুপি।

তার শাশুড়িরও শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। কিন্তু অংশু প্রিয়া জানেন যে এত দামে কালোবাজার থেকে আরেকটি সিলিন্ডার কেনা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

শুধু দিল্লি বা নয়ডা নয়- লখনৌ, এলাহাবাদ, ইন্দোর বা এমন বহু শহরের এখন এই একই কাহিনি। হাসাপাতালে জায়গা না পেয়ে মানুষজন ঘরের ভেতরেই প্রাণে বাঁচার চেষ্টা করছেন।

অক্সিজেনের কালোবাজার
কিন্তু ভারতের সিংহভাগ মানুষেরই কালোবাজার থেকে ওষুধ বা অক্সিজেন কেনার সামর্থ্য নেই।

অনেক খবর এবং ছবি বেরিয়েছে যে কালোবাজার থেকে ওষুধ বা অক্সিজেন কিনতে না পেরে অনেক রোগী হাসপাতালের গেটে বা সিঁড়িতে প্রাণ হারিয়েছেন।

বেশ কজন অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রেতার কাছে ফোন করলে তারা স্বাভাবিক দামের চেয়ে এমনকি দশগুণ পর্যন্ত দাম হাঁকে।

বিশেষ করে দিল্লির পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। শহরে একটি হাসপাতালেও কোনা আইসিইউ বেড খালি নেই। অনেক সম্পন্ন পরিবার বহু টাকা দিয়ে বাড়িতে নার্স রেখে এবং ডাক্তার দিয়ে প্রিয়জনের শ্বাস-প্রশ্বাস অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছে।

রক্ত পরীক্ষা, এক্সরে বা সিটি স্ক্যান করা এখন অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়েছে। ল্যাবগুলোর ওপর অস্বাভাবিক চাপ, ফলে রিপোর্ট পেতে কয়েক দিন লাগছে। সিটি স্ক্যান করার সময় পেতেই কয়েকদিন লাগছে। ফলে ডাক্তারদের পক্ষেও রোগীর হাল বোঝা কষ্টকর হয়ে পড়ছে।

ডাক্তাররা বলছেন - বিভিন্ন জরুরী পরীক্ষার এই দেরিতে রোগীর জীবন হুমকির মুখে পড়েছে। কোভিডের টেস্ট করতেও (আরটি-পিসিআর) কয়েকদিন লাগছে।

আমি এমন কয়েকজন কোভিড রোগীর কথা জানি যাদের কাছে কোভিড পজিটিভ পরীক্ষার রিপোর্ট নেই বলে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেননি।

দিল্লির বাসিন্দা অনুজ তিওয়ারি জানালেন, তার ভাইকে কোনো হাসপাতাল ভর্তি করতে রাজী না হওয়ার পর বাড়িতে একজন নার্স জোগাড় করেছেন তিনি।

অনেক হাসপাতাল বলে দিচ্ছে তাদের কোনো খালি বেড নেই। আবার অনেক হাসপাতাল রোগী নিচ্ছেনা কারণ অক্সিজেন নেই বা ফুরিয়ে আসছে। শুধু অক্সিজেনের অভাবে দিল্লিতে বেশ কজন কোভিড রোগী গত কদিনে মারা গেছেন।

অনেক হাসপাতাল প্রতিদিন অক্সিজেনের জন্য এসওএস নোটিস পাঠাচ্ছে। এমন বার্তার পর সরকারের পক্ষ থেকে অক্সিজেন ট্যাংকার হয়ত পাঠানো হচ্ছে, কিন্তু একদিনের ভেতরেই তা শেষ হয়ে যাচ্ছে।

দিল্লির একজন ডাক্তার বলছেন হাসপাতালগুলো এভাবেই এখন চলছে, এবং “সত্যিকারের আশঙ্কা রয়েছে যে কোনো সময় বড় কোনো ট্রাজেডি ঘটতে পারে।”

লড়াই এখন বাড়িতে বাড়িতে
হাসপাতালগুলোর এই পরিস্থিতি দেখে অনুজ তিওয়ারি ভাইকে বাঁচাতে অনেক টাকা দিয়ে একটি কনসেনট্রেটর কিনেছেন - যা দিয়ে বাতাস থেকে অক্সিজেন শুষে নেওয়া যায়।

ডাক্তার তাকে রেমডিসিভির ওষুধ জোগাড় করতে বলেছেন। দোকানে না পেয়ে কালোবাজারের দ্বারস্থ হতে হয়েছে তিওয়ারিকে।

তিনি বলেন, “হাসপাতালে কোনো বেড খালি নেই। আমি কি করবো? অন্য কোনো শহরেও ভাইকে নেওয়ার ক্ষমতা এখন আমার আর নেই। এরই মধ্যে বহু টাকা খরচ হয়ে গেছে, হাতে বাকি আর তেমন কিছুই নেই।”

তিনি বলেন, “কোভিড রোগীদের বাঁচানোর লড়াই এখন হাসপাতাল থেকে বাড়িতে স্থানান্তর হয়েছে।”

কিন্তু ওষুধ এবং অক্সিজেনের অভাবে বাড়িতে বসে সেই লড়াই জেতা কঠিন হয়ে পড়ছে। ও ষুধের দোকানে রেমডিসিভির এখন নেই বললেই চলে।

ফলে ভরসা একমাত্র কালো বাজার। কালোবাজারে ওষুধ সরবরাহ করেন এমন ক'জনের সাথে যোগাযোগ করলে তারা বলেন, সরবরাহ পরিস্থিতি নাজুক ফলে দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।

ভারতে যে সাতটি কোম্পানি রেমডিসিভির তৈরি করে তাদেরকে দ্রুত উৎপাদন বাড়াতে বলা হয়েছে।

‘মানুষকে তার ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে’

ওষুধ সরবরাহ বাড়ানো হবে বলে সরকার বারবার যে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে বাস্তবে তার কোনো দেখা নেই।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ড. ললিত কান্ত বলছেন জরুরী ওষুধের উৎপাদন বাড়ানোর সরকারি নির্দেশ এসেছে খুব দেরিতে। তিনি বলেন, ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের জন্য সরকারের অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া উচিৎ ছিল।

“কিন্তু একইসাথে কালোবাজারে ওষুধ মিলছে। তার মানে সরবরাহ প্রক্রিয়ায় গলদ দেখা দিয়েছে যেটা সরকার সামাল দিতে পারছে না।”

তিনি বলেন, “আমরা প্রথম দফার সংক্রমণ থেকে কিছুই শিক্ষা নেয়নি।”

টিসিলিজুমাব নামে আরেকটি ওষুধের খুব চাহিদা তৈরি হয়েছে। এটি সাধারণত বাতের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়, কিন্তু গবেষণায় দেখা গুরুতর কোভিড রোগীর ওপর এটি প্রয়োগ করলে তাকে হয়ত ভেন্টিলেটরে নেওয়া লাগেনা।

খুবই গুরুতর কোভিড রোগীদের জন্য এই ওষুধের পরামর্শ দিচ্ছেন ডাক্তাররা। কিন্তু বাজার থেকে ওষুধটি এখন হাওয়া।

স্বাভাবিক সময়ে ৪৪০ মিলিগ্রামের একটি ভায়ালের দাম পড়ে ৩২,৪৮০ রুপি। কিন্তু কমল কুমারকে তার বাবার জন্য এটি কিনতে হয়েছে আড়াই লক্ষ রুপি দিয়ে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আনন্দ ভান বলছেন, সরকারের উচিৎ ছিল প্রচুর পরিমাণে এই ওষুধটি মজুত করা, কারণ এত দামে কালোবাজার থেকে তা কেনার ক্ষমতা খুব কম মানুষেরই রয়েছে।

তিনি বলেন, “এটি প্রমাণ করে যে সরকারের ভেতর কোনো পরিকল্পনাই ছিলনা। সংক্রমণের নতুন একটি ঢেউ যে আসছে তা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার।” “মানুষকে তার ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।"

প্রতারণা
বাজারে এখন নকল রেমডিসিভির বিক্রি হচ্ছে বিবিসিও এমন রেমডিসিভির দেখেছে যার লেবেলে উৎপাদক হিসাবে যে কোম্পানির নাম রয়েছে সেটি ভারতে অনুমোদিত কোম্পানির তালিকায় নেই। বিক্রেতাকে চ্যালেঞ্জ করা হলে তিনি জবাব দেন, “এই ওষুধ শতভাগ খাঁটি।“

প্যাকেজিংয়ের গায়ে লেখা নির্দেশাবলীতেও প্রচুর বানান ভুল। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে ইন্টারনেটে সার্চ দিয়েও পাওয়া যায়নি।

কিন্তু মানুষজন এতটাই মরিয়া যে নকল ওষুধ সন্দেহ হলেও সেগুলো তারা কিনছেন। প্রতারণার শিকারও হচ্ছেন অনেকে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন আইটি কর্মী বলেন টুইটারে নাম এবং ফোন নম্বর দেখে তিনি রেমডিসিভির এবং অক্সিজেন কেনার জন্য ফোন করার পর অগ্রিম হিসাবে ১০ হাজার রুপি চাওয়া হয়। “যখনই আমি টাকাটা পাঠালাম, পর পরই ঐ লোকটি আমার ফোন নম্বর ব্লক করে দেয়,”- তিনি বলেন।

মানুষ এতটাই মরিয়া যে সেই সুযোগে কালোবাজার গজিয়ে উঠছে। রেমডিসিভিরের কালোবাজারি বন্ধ করতে অনেক রাজ্যে কিছু হয়েছে, পুলিশি অভিযান চলছে, কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছে সামান্যই।

তিওয়ারি বলেন, তার মত মানুষদের সামনে কালোবাজার ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। “অবস্থা এমন যে হাসপাতালে আপনার চিকিৎসা নেই, কিন্তু বাড়িতে বসেও প্রিয়জনদের বাঁচানো যাচ্ছেনা।”

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত