মিয়ানমারে সংঘাত বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল সেন্টমার্টিনেও

প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০২৪, ২২:১৬

সাহস প্রতিবেদক
ছবি: সংগৃহীত

কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিনের বিপরীতে মিয়ানমার সীমান্তের ওপার থেকে মঙ্গলবার রাতে টানা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। রাত আটটা থেকে একটা পর্যন্ত থেমে থেমে ভারী বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে সেন্টমার্টিন দ্বীপ।
এর আগে কয়েক দিন ধরে টেকনাফের হ্নীলা ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নের বিপরীতে মিয়ানমারের মংডু টাউনশিপের উত্তর অংশ থেকে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। মঙ্গলবার রাতে শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্ট মার্টিনের বিপরীতে অবস্থিত মংডু টাউনশিপের দক্ষিণ অংশ থেকেও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। সীমান্ত এলাকার লোকজন বলছেন, মিয়ানমারের ওই এলাকায় দুটি গ্রাম হাস্যুরাতা ও নাখ্যংদিয়া থেকে এই বিস্ফোরণের শব্দ আসছে। নতুন করে ওই এলাকায়ও সংঘাত ছড়িয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশটির রাখাইন প্রদেশে সম্প্রতি সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘাত তীব্রতর হয়েছে।
সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, মঙ্গলবার রাত আটটা থেকে একটা পর্যন্ত মংডু টাউনশিপের উত্তরে নাকফুরা, বলিবাজার এবং দক্ষিণে হাস্যুরাতা ও নাইক্ষ্যংদিয়ায় আরাকান আর্মি ও সে দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে তুমুল লড়াই চলছে। সীমান্তের ওই এলাকায় গত রাতে অর্ধশতের বেশি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। সেন্টমার্টিন, টেকনাফ সীমান্তের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের খারাংখালী, ঝিমংখালী, হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজার, ওয়াব্রাং, পুরানবাজার, ফুলের ডেইল, চৌধুরীপাড়াসহ অন্তত ১৩টি গ্রামে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়।
টেকনাফ স্থলবন্দরে আমদানি পণ্য নিয়ে আসা মিয়ানমারের কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, টানা দেড় মাসের বেশি সময় ধরে রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির সংঘাত চলছে। আরাকান আর্মি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন এলাকা দখল করেছে বলে জানা গেছে। সরকারি বাহিনী এসব এলাকায় নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য পাল্টা হামলা চালিয়েছে।
তবে সীমান্তের পরিস্থিতির কারণে নতুন করে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিজিবি। টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাখাইন পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদী ও সীমান্তে বিজিবির টহল বাড়ানো হয়েছে।
এদিকে রাখাইন রাজ্যে সংঘাত চলাকালীন পালিয়ে আসা মিয়ানমারের ১৭৯ সেনাদের ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে মিয়ানমারের জান্তা সরকার দেশটির কারাগারে থাকা ২০০ বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এপ্রিলের শুরুর দিকে দুই দেশের মধ্যে বিনিময়টি হওয়া কথা রয়েছে। এই তালিকায় রয়েছেন মিয়ানমারের একজন বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) অফিসার; যিনি ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যার হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত। এই বিষয় যদিও দেশটির বর্ডার গার্ড মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারের একটি সূত্র জানিয়েছে, মিয়ানমার সরকার রাখাইন রাজ্য ও অন্যত্র কারাগারগুলিতে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে লড়াই করছে। এক্ষেত্রে তারা কক্সবাজার থেকে জান্তা সেনাদের ফিরিয়ে নেওয়া জাহাজেই বাংলাদেশি বন্দিদের ফেরত পাঠাতে চায়।
ওই কর্মকর্তা বলেন, এটি টেকনিক্যালি বন্দি বিনিময় নয়। কারণ মিয়ানমারের সেনারা বাংলাদেশে আশ্রয় চেয়েছিল। এখন তারা সবাই মিয়ানমারে ফিরে যেতে ইচ্ছুক। এক্ষেত্রে কেউ আশ্রয় চাইলে আমরা জাতিসংঘের সঙ্গে যোগাযোগ করব।
বাংলাদেশি কর্মকর্তা জানান, যে অফিসারকে ২০১৭ গণহত্যার সঙ্গে জড়িত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে তাকে বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হবে না। তিনি বলেন, যদি তিনি সাক্ষ্য দিতে ইচ্ছুক হন, তবে আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে (আইসিসি) একটি বিবৃতি রেকর্ডের অনুমতি দিতে পারি। অন্যথায় না।
এদিকে ব্যাংককভিত্তিক ফোর্টফাই রাইটস রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অপরাধে জড়িত থাকার জন্য জান্তা কর্মীদের তদন্ত করতে এবং আইসিসির তদন্তের সঙ্গে সমন্বয় করার জন্য বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

এদিকে আরাকান আর্মির কাছে পরাজিত হয়ে গত সপ্তাহে মিয়ানমারের আরো কয়েকশ’ সীমান্তরক্ষী বাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। গত ৪ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে মোট ৩৩০ জন কর্মকর্তা ও তাদের পরিবার বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এদিকে বাংলাদেশ সরকার একই সময়ে ৭৫ রোহিঙ্গাকে স্বেচ্ছায় ফিরিয়ে দিয়েছে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমার থেকে আসা একটি জাহাজের মাধ্যমে দেশটির সেনাদের বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাবাসন করা হয়।
এ সময় বিজিবি প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আর কাউকে সীমান্ত অতিক্রম করতে দেয়া হবে না।’ কিন্তু ১১ মার্চ আরাকান আর্মির কাছে পরাজিত হয়ে কমপক্ষে ১৭৯ জন সেনা সদস্য বান্দরবানের সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাদের অভিযানে প্রাণভয়ে বাধ্য হয়ে ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। এক্ষেত্রে বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি।
এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে দিতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু নিরাপত্তা ও নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা ছাড়া বেশিরভাগ শরণার্থীরাই ফিরে যেতে চাচ্ছে না। এদিকে মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকেও ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তাই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছে।
এদিকে মিয়ানমারের সঙ্গে ১,৬১০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তে বেড়া নির্মাণ করতে ভারত সরকার প্রায় ৩৭০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করার পরিকল্পনা করেছে। বেড়া নির্মাণ কাজ শেষ হতে এক দশক সময় লেগে যাবে। এ বিষয়ে খুব ভালোভাবে অবগত আছেন এমন এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ তথ্য জানিয়েছে। ওই কর্মকর্তা নিজের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
এ বছরের শুরুতে দিল্লি মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের কয়েক দশক পুরানো ভিসামুক্ত চলাচল নীতি থেকে সরে আসার এবং যুদ্ধবিক্ষুব্ধ প্রতিবেশী সীমান্তে বেড়া নির্মাণের ঘোষণা দেয়। এর কারণ ব্যাখ্যায় ভারত সরকার থেকে বলা হয়, তারা সীমান্ত এলাকায় বসবাস করা নিজদের নাগরিকদের নিরাপত্তা ও জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এবং উত্তরপূর্বাঞ্চলের ভূপ্রাকৃতিক অবকাঠামো ঠিক রাখতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রয়টার্সের খবরে বলা হয়, এ মাসের শুরুতে ভারত সরকারের একটি কমিটি সীমান্ত বেড়া নির্মাণ ব্যয়ে অনুমোদন দেয়। এখন এতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রিসভার অনুমোদন প্রয়োজন।
রয়টার্স থেকে এ বিষয়ে জানতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র, অর্থ, পররাষ্ট্র এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু তাদের কারো কাছ থেকেই কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। মিয়ানমার জান্তা সরকার থেকেও এখন পর্যন্ত ভারত সরকারের সীমানা বেড়া নির্মাণ পরিকল্পনার বিষয়ে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত