খুনের রাজনীতির সাথে আপোষ আরও খুন টেনে আনবে

প্রকাশ : ০৬ জুন ২০১৬, ০১:১৭

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬-২০১৭ সালের বাজেট পেশের আগের দিন বুধবার সংসদে দাঁড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে তার সরকারের সাফল্য গেয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে কোন সময়ের চাইতে ভালো, সার্বিক আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তার সরকার জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, একই সাথে বলেছেন মানুষ ন্যায়বিচার পাচ্ছে। সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি একথা বলেন।

আজ দু’দুটো হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়েছে।

চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের সহধর্মিনী মাহমুদা আক্তার শিশু সন্তানকে নিয়ে স্কুলের বাসে তুলে দেবার পথে খুন হয়ে গেছেন।

পথিমধ্যেই খুন করেছে খুনিরা শিশুসন্তানটির মাকে শিশুটির সামনেই!

আর নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়ার খ্রিস্টান পল্লীর মুদি দোকানদার সুনীল গোমেজকে খুন করা হয়েছে। 

বীভৎস এসব হত্যাকান্ডের খুনিদের দেখার জন্য বিশেষ চশমা পড়ার দরকার নেই। যে রাজনীতি এ হত্যাকান্ড সমর্থন করে ও করায় সে রাজনীতির দাপট আমরা ১৯৭১-এই দেখেছি। সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি চালু করার জন্য এ খুনগুলো করা হচ্ছে। খুনীরা ১৯৭১ চাইতেও এখন অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী। তারই দাপট ও ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে এখন।

যুদ্ধাপরাধী জামাত–শিবির চক্রের ৭১ সালের খুনি নেতাদের বিচার কাজ শুরু হবার পর থেকেই, এ দলটি ভয়ের সংস্কৃতি চালু করার চেষ্টা করতে থাকে। হরতাল ডেকেই পুলিশের উপর চড়াও হতে থাকে। পুলিশের মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টায় অবিরাম হামলা করে গেছে রাজধানী ও বিভিন্ন জেলায়।

দুঃখজনক হলেও সত্য এ দলটি প্রায় প্রতিটি থানাতে পেমেন্টের সংস্কৃতি চালু করেছে। থানায় পেমেন্ট দিয়ে কিছু পুলিশ নিজেদের পক্ষে রাখার জন্য এই দলটির একটি জোরদার প্রচেষ্টা আছে। আমরা দেখেছি পুলিশ অফিসার কর্তৃক জমি লিখে নিয়ে জামাতের পক্ষ নিতে।

একইসাথে চালিয়ে গেছে রাজনৈতিক প্রচেষ্টা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলামের মুখ থেকে নির্গত সে অমর বানী ‘আমরা যুদ্ধাপরাধীদের একটি প্রতীকি বিচার করবো’। নানান রকমের রাজনৈতিক আলোচনা করার দাবি করে গেছে জামাত–শিবির চক্র। ক্ষমতাসীনদের এ সমস্ত দাবি প্রত্যাখ্যান করতে দেখা যায়নি।

যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায় এর দু’দিন আগে জামাত-শিবির চক্র মতিঝিলে একটি সমাবেশ ডাকে। সমাবেশ থেকে জামাত-শিবির নেতারা পরিষ্কার হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে ‘রায় এর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া আছে’ বিচারিক আদালত যেন এ হুঁশিয়ারী আমলে নেন। সারাদেশে পুলিশ পিটিয়ে জামাত-শিবির চক্র মতিঝিল সমাবেশের মিছিল থেকে পুলিশকে ফুল উপহার দেয়!

যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাকে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করে। আদালত চত্বরে অনেককেই উৎফুল্ল দেখা যায়। ক্ষমতাসীন মহলের অনেক অঙ্গ সংগঠনের নেতা কর্মীরাও আনন্দ প্রকাশ করেন।

সর্বজন শ্রদ্ধেয় আনিসুজ্জামান স্যারের মুখ থেকে বের হয়েছে ‘বিচার চেয়েছি বিচার পেয়েছি’। ন্যায় বিচার নিশ্চিত হয়েছে কিনা স্যার অবশ্য এটি বলেননি। গুমরে গুমরে কেঁদেছে শহীদ পরিবারের সদস্যরা খুনি কাদের মোল্লার রায় দেখে।

রায় দেখে ক্ষুব্ধ মানুষগুলোর একাট্টা হবার প্রেরণা যোগায় অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম। শাহবাগে জড়ো হতে থাকে প্রতিবাদী মানুষ। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে আইন পাল্টায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের।

জামাত-শিবির ও বিএনপির নেতারা গণজাগরণ মঞ্চের এ আন্দোলনেকে, ধর্মীয় ট্যাগ দেবার চেষ্টা করে গেছেন শুরু থেকেই, নাস্তিক্যবাদীদের আন্দোলন বলে। জামাত বিএনপির বুদ্ধিজীবি মহল শুরু থেকেই বিষোদগার করে গেছে এ আন্দোলনের।

জামাত-শিবির প্রকাশ্যে এনেছে তাদের দ্বিতীয় ফ্রন্ট হেফাজতকে। যুদ্ধাপরাধী খুনি নেতাদের ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচানোর আশায়। জামাতের সেই ট্রামকার্ড এখন ক্ষমতাসীনদেরও পক্ষে মাঝে মাঝে কথা বলছে, ক্যাশের বিনিময়ে। একই সাথে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে সমাজকে ধর্মান্ধ রাজনীতির পক্ষে টেনে নিয়ে যাবার জন্য। 

শাহবাগে যোগানো শক্তির বলেই যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধী নেতাদের ফাঁসির দড়ি দেখতে হয়েছে। চাপাতির কোপ সর্বপ্রথম ঘাড়ে পড়েছে মঞ্চের কর্মীদের।
 
বিভক্ত সমাজের ধর্মান্ধ ও রাজনীতিতে ধর্মীয় রাজনীতির সুবিধা নেবার আশায় জামাত-শিবির, বিএনপি ও ক্ষমতাসীন মহলে পার্থক্য বোঝ দায় নাম উল্লেখ না থাকলে।
 
এক একজন ব্লগার খুন হয়ে যাবার পরে নানান কিসিমের মন্ত্রী ব্লগারদের লেখা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন প্রকাশ্যে। গণমাধ্যমে এমন সব বক্তব্য রাখেন যেন ব্লগার খুনটি জায়েজ হয়েছে। খুন না করে উপায় ছিল না খুনিদের। মন্ত্রীদের সাথে গলা মিলিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, একজন বিশ্বাসী হিসাবে ব্লগারদের এ সমস্ত কর্মকান্ড ও লেখনী বরদাশত করবেন না।
   
খুনিদের এই সুবিধাটি পাওয়া দরকার ছিল ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে। এতে সুবিধে হয়েছে জামাত-শিবির প্রযোজিত এ সমস্ত খুনের সাথে জড়িত খুনিদের। আদতে ধর্মীয় মোড়কে উপস্থাপিত এ সমস্ত খুন, খুনিদের এক ধরণের আড়ালে যেতে সহায়তা করেছে। খুনের চাইতে খুনি ব্যক্তিটির লেখনি ও ব্যক্তি চরিত্র সামনে এসে আড়ালে ফেলেছে খুনিদের।

ব্লগার হত্যার সাথে জড়িত খুনিরা আড়ালে চলে গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদাসীনতায় ও বিচার বিভাগের নির্লিপ্ততায়। খুনিদের কেউ জামিনে রয়েছে কেউবা পালিয়েছে দেশ ছেড়ে। অভিজিৎ রায় এর হত্যাকান্ডের পরে পুলিশ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন খুনিরা নজরদারীর মধ্যে রয়েছে। ক’দিন আগে বললেন খুনিরা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। যদি খুনিরা শনাক্ত হয়ে থাকে তাহলে ধরা হলো না কেন? এ প্রশ্নের কোন উত্তর নাই। শনাক্ত খুনিদের ছবি ও তালিকা ইন্টারপোলে পাঠানো হলো না কেন? কোন উত্তর মেলে না। ওয়াশিকুর বাবুর খুনিদের ধরে পুলিশে দিয়েছিল তৃতীয় লিঙ্গের ক’জন মানুষ। খুনিরা বলেছে তারা এসেছে হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে। পুলিশ তেঁতুল (শফী) হুজুরের মাদ্রাসা পর্যন্ত যেতে পারেনি তদন্তে। খুনির রুমমেট কারা? খুনিদের টেনে এনেছে কারা এ খুনের মধ্যে? এর কিছুই বের হয়নি। হেফাজতের সমাবেশের পরপরই রাষ্ট্রের হেফাজত তোষণ মাত্রা ছাড়িয়েছে। তেঁতুল হুজুরকে রেলও্য়ের জমি ও টাকা দিয়ে বশে রাখার চেষ্টা চলছে ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে।

সাথে যোগ হয়েছে একটি বৈধতাবিহীন নির্বাচনের সংকট। যে নির্বাচনটি ক্ষমতাসীনরা ভুলে যেতে চান। মাঝে মধ্যেই মনে করিয়ে দেয় দাতা গোষ্ঠী ও বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতরা।

বৈশ্বিক রাজনীতির মোড়লরা বাংলাদেশকে নিয়ে একটি প্রচারণা চালাচ্ছে একটি মডারেট মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে। একই সাথে সাইট ইন্টেলিজেন্স এর রিটা কাৎজকে দিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে, এদেশে আইএস আছে। জামাত-শিবির প্রযোজিত এ সমস্ত হত্যাকান্ডের তিন, চার, পাঁচ ঘন্টার মধ্যেই রিটা কাৎজের সাইটে স্বীকারোক্তি চলে যায়। খুনের দাবি আইএস’এর। ব্লগার হত্যাকান্ড ও অন্যান্য হত্যাকান্ড পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, স্থানীয় কোন রাজনৈতিক সহায়তা না থাকলে এসব খুন করা যেতো না।

কবে কোন মুক্তিযোদ্ধা ধর্মান্তরিত হয়েছেন, কোথায় একজন নিখিল চন্দ্র জোয়ার্দার থাকেন, কোথায় একজন ফাদার, কোন পথে চলাচল করেন একজন মিশনারী ডাক্তার? এর সবই রাজনীতির সরবরাহ করা তথ্য উপাত্ত। এ রাজনীতির মূল কথা তোদের কারণে, তোদের মৌন অথবা সরব সমর্থনে ফাঁসির দড়িতে ঝুলে গিয়েছে আমাদের নেতারা, এর প্রতিশোধ আমরা এভাবেই নেবো।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন বলে বেশ খুশী। আমরা আপনার মত খুশী নই প্রধানমন্ত্রী। ব্লগারদের অনেকেই দেশান্তরী, আপনার পুলিশের কাছে নিরাপত্তার জন্য গেলেই বলে দেশত্যাগ করেন। ধর্ম নিয়ে এক কলম না লিখেও খুন হয়ে গেছে একজন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নাজিমুদ্দিন সামাদ।

ক্ষমতার রাজনীতিতে, একদল প্রগতিশীলতা চর্চায় রত তরুণকুল যখন বিপদাপন্ন, তখন আপনার পুলিশ খতিয়ে দেখা শুরু করে ব্লগারের নানান ঠিকুজি। যেন দেশের একমাত্র সমস্যা ব্লগারের লেখা।

ধারাবাহিক খুনের যে রাস্তায় হাঁটছে বাংলাদেশ সেটি জামাত-শিবিরের প্রতিশোধের রাজনীতি, সাথে বিএনপির কারও কারও ইন্ধন থাকতে পারে। এই রাজনীতিকে যদি রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা করা না হয়, খুনের শিকার হতে থাকবে আরও অনেক নিরপরাধ নাগরিক এ দেশের।

খুনের রাজনীতির সাথে আপোষ আরও অনেক খুন টেনে আনবে।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ