পশ্চিমাদের অন্ধকার জগত এবং একটি বিশ্লেষণ

প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৫:৩৯

ড. মো: কামরুজ্জামান
লেখক : ড. মো: কামরুজ্জামান

প্রথম পর্ব
আধুনিক যুগ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। বিগত বিশ বছরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে। প্রযুক্তির আশির্বাদে বর্তমানে গোটা পৃথিবী একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞান আজ বিশাল ভূপৃষ্ঠকে কব্জা করে নিয়েছে।  সাগরের তলদেশ দখল করার পর মহাকাশ জগতকেও বশে আনতে যাচ্ছে বিজ্ঞান। নতুন নতুন আবিস্কারের ফলে মানুষের দৈনন্দিন কাজ সহজতর হচ্ছে। আর এর সবগুলোতে পশ্চিমাদের অবদানকেই মানুষ বড়ো করে দেখছে।  প্রাচীন বহু সভ্যতা ডিঙ্গিয়ে আমরা নতুন সভ্যতায় পা রেখেিেছ। ইতিমধ্যেই একবিংশ শতাব্দির ২৩টি বছর আমরা অতিক্রম করেছি। নতুন সভ্যতা আমাদেরকে নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখাচ্ছে। আমরা এ সময় পশ্চিমাদেরকেই নতুন সভ্যতার নির্মাতা মনে করছি। মনে করছি, পশ্চিমারাই সহনশীলতার প্রাণকেন্দ্র, পশ্চিমারাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্রষ্টা। এ সভ্যতার সবচেয়ে বড়ো শ্লোগান হলো, গণতন্ত্রের উন্নতি আর মানবাধিকার সুরক্ষা। গণতন্ত্র প্রশ্নে আমরা পশ্চিমাদেরকেই গণতন্ত্রের জনক মনে করে থাকি। আমরা মনে করি, পশ্চিমারাই মানবাধিকারের সংরক্ষক। বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম পশ্চিমাদের বাইরে কিছুই বোঝেনা। অতীতে কোনো জাতি উন্নত ও সভ্য ছিল, এটা তারা বিশ্বাসই করে না। এটা সত্য যে, আধুনিক পশ্চিমারা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রে যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেছে। মানবাধিকার সুরক্ষায়ও তারা সুনাম কুড়িয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে তারা অভূতপূর্ব অবদান রেখে চলেছে। 


নব নব আবিস্কারে তারা তাদের প্রাধান্যের সাক্ষর রেখে চলেছে। এসব কারণে আধুনিক তরুণ-তরুণীরা পশ্চিমা সভ্যতার প্রতি অন্ধ আনুগত্য পোষণ করছে। তাদের আবিস্কার ও সভ্যতার প্রতি বর্তমান প্রজন্ম প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়েছে। তারা তাদের জ্ঞন ও প্রযুক্তির কাছে নিজেদেরকে সমর্পণ করেছে। মুসলিমদের যে এক সোনালী অতীত ছিল এটা নতুন প্রজন্ম জানেই না। মুসলিমদের সোনালী অতীতের বিপরীতে পশ্চিমাদের আছে এক কালো অন্ধকার অধ্যায়। নতুন প্রজন্ম সে সম্পর্কেও  কিছু জানে না। তাদের অতীতটি নিকষকালো অন্ধকারে ঢাকা এক পঙ্কিলময় ইতিহাস। তাদের বর্তমান সভ্যতা নির্মিত হয়েছে প্রবল এক লালসার উপর। তাদের বর্তমান এ সভ্যতার পেছনে রয়েছে ঘৃণীত এক বর্ণবাদী মানসিকতা। 


শুধু পেছনের ইতিহাস নয়, বর্তমানেও তাদের সভ্যতা ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত। লাখ লাখ নিরপারধ মানুষের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে তারা নির্মাণ করে চলেছে তাদের কথিত গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। প্রবলতম সুবিধাবাদী নীতিতে ভরপুর তাদের আন্তর্জাতিক পলিসি। পরের সম্পদে লোভ, জবরদখল, দেশদখল আর নিজেদের মোড়লিপনাই তাদের আন্তর্জাতিক পলিসির মূলবক্তব্য। ভিন্ন দেশ, ভিন্ন মহাদেশ ও অঞ্চলভেদে তাদের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের রুপ ভিন্নরকম। যার মূল লক্ষ্যই হলো অন্যের উপর দাদাগিরি করা। দুর্বলের উপর ছুরি ঘুরিয়ে ইচ্ছেমতো সুবিধাবাদী নীতির প্রয়োগই হলো তাদের গণতন্ত্র। গোটা বিশ্বকে অস্ত্রশক্তি দিয়ে করায়ত্ত করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। 


২০০১ সালে আফগানিস্তানে আর ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণই এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আর আধুনিক ফিলিস্তিনীদের সাথে তাদের কাপুরোষিত আচরণই বলে দেয় তাদের উদ্দেশ্য কী! তারা দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার অন্তরালে অশান্তি সৃষ্টিকারী একটি নিকৃষ্ট জাতি। তারা মূলত একটি সন্ত্রাসী গোষ্টি। পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। এ ব্যাপারে আল্লাহর বানী প্রনিধানযোগ্য। ‘তাদেরকে যখন বলা হয়, তোমরা পৃথিবীতে সন্ত্রাস সৃষ্টি করো না, উত্তরে তখন তারা বলে, আমরাইতো পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী!’ (আল বাক্বারা: ১১) বর্তমানে গোটা দুনিয়ায় এ জাতিই গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের ফেরি করে চলেছে। মূলত তারা শান্তির নামে অশান্তি সৃষ্টি করতেই ব্যস্ত। তাদের বর্তমান ও অতীতের রক্তখেকো ইতিহাস, ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যায়নি। তাদের  কলঙ্কজনক অধ্যায় কখনও সচেতন জাতি ভুলে যাবে না। সভ্যতার অন্তরালে তাদের অসভ্য ও কুৎসিত অতীত বিশ্ববাসি বলে যাবে, লিখে যাবে। 


দু:খজনক সত্য হলো, জ্ঞান আর প্রযুক্তি যখন উন্নত হচ্ছে আমরা তখন পেছনের দিকে যাচ্ছি! বলতে হয় আমাদের কপালটাই খারাপ! কারণ দুনিয়ার তাবৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আজ পশ্চিমাদের একক নিয়ন্ত্রণাধীন। বিশ্বমিডিয়াটিও আজ তারা নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের কুকীর্তি সম্পর্কে আধুনিক প্রজন্ম কোনো ধারণাই রাখে না। তাদের সৃষ্ট চোখ ধাধানো প্রযুক্তি আমাদের নতুন প্রজন্মকে নির্বোধ বানিয়ে দিচ্ছে। এ নির্বোধ প্রজন্ম পশ্চিমাদের অন্ধ অনুসারী হয়ে গেছে। ধর্ম, সংস্কৃতি ও মননশীলতায় পশ্চিমা সভ্যতার গোলামে পরিণত হয়ে পড়েছে। 


আমাদের পাঠশালাগুলো আজ শুধুই কারুকার্য খচিত দামী নির্মাণশৈীলির নিদর্শন! সেটা এখন নিকেতন কেন্দ্র ব্যতীত অন্য কিছুই নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন শুধুই গবেষণার মিথ্যে ফানুস। বইয়ের বদলে তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে শোভা পায় সারি সারি মদের বোতল! নিয়ম করে রুটিনমাফিক সেখানে বসে জুঁয়ার আড্ডা। ফলে বাংলার ৬ কোটি দামাল তরুণ-তরুণী আজ চরম বেশামাল-অস্থির। তারা প্রযুক্তির মিথ্যে ফানুসের মধ্যে নিজেদেরকে বিলিন করতে বসেছে।  


বাঙ্গালী মুসলিম স্বাধীন সত্তা তাদের মধ্য হতে হারিয়ে যাবার পথে! পশ্চিমা মিডিয়া সর্বক্ষণ সম্প্রীতির নামে সাম্প্রদায়িকনীতি প্রচার করে চলেছে। তারা অপপ্রচার করে বলছে, মুসলিমরা হচ্ছে সবচেয়ে অসভ্য। তাদের মিডিয়াগুলো মুসলিমদেরকে নিয়ে নানা মিথ্যে কাহিনী ভাইরাল করছে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে বানোয়াট গল্প সাজিয়ে মিডিয়ায় উপস্থাপন করছে। এসব মিথ্যে প্রচারের মাধ্যমে নিজেদের অন্ধকার দিকগুলোকে ঢাকবার চেষ্টা করছে। কিন্তু সত্য কখনও চাপা থাকে না। তাদের চেপে রাখা অন্ধকার ইতিহাসের অতি সামান্যই তুলে ধরার ক্ষুদ্র এক প্রয়াসই হলো এ প্রবন্ধ।

সৃষ্টির শুরু থেকে লজ্জা নিবারণ করা মানুষের অতি সহজাত স্বভাবেরই অংশ। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানবজাতি মাত্রই লজ্জা নিবারণের এ কাজটি করে থাকে। কিন্তু পশ্চিমারা এর বিপক্ষে ‘নো-প্যন্ট ডে’ নামক এক উলঙ্গ নীতির অনুসরণ করে থাকে। প্রতিবছরের ১০ই জানুয়ারি পশ্চিমা দেশগুলোর তরণ-তরুণীরা উলঙ্গ থাকে। দিনের বেলা তারা পাতাল রেলে প্যান্ট খুলে ঘোরাফেরা করে। (সূত্র: https://en.m.wikipedia.org, 14 July, 2019) এটা আধুনিক মানব নসভ্যতার সবচেয়ে কুৎসিক একটি দিক। এক্ষত্রে তাদেরকে কোনোভাবেই সভ্য জাতি বলা যায় না। 


পশ্চিমাদেশের আরেকটি অসভ্য দিক হলো, তাদের পুরুষেরা বীর্য বিক্রি করে! এ বীর্য থেকে একজন পশ্চিমা নাগরিক শত শত সন্তান জন্ম দিয়ে থাকে। একজন ব্রিটিশ পুরুষ তার বীর্য থেকে ৮০০ সন্তানের জন্মের কথা স্বীকার করেছে। (সূত্র: https://m.youtube.com, may 1, 2020) বিষয়টি রুচিশীল পাঠকদের ব্যাখ্যা করার জন্য পেশ করা হলো। 

পৃথিবীতে ৪ হাজারের বেশি ধর্ম রয়েছে। প্রতিটি ধর্ম মাতৃত্বকে সম্মানের সাথে দেখে থাকে। আর মাতৃত্বের মৌলিক সম্মানের জায়গা হলো মায়ের গর্ভ। মায়ের গর্ভের মত গোপন ও মর্যাদাপূর্ণ স্থান দ্বিতীয়টি নেই। কিন্তু পশ্চিমা প্রায় সবদেশের সব মানুষের কাছে এ গর্ভের কোনো সম্মান নেই। পশ্চিমের অধিকাংশ দেশগুলোতে মেয়েরা তাদের গর্ভ ভাড়া দিয়ে থাকে! তাদের রুচি এমন নিম্ন স্তরে পৌঁছেছে যে, নিজের মা পর্যন্ত সন্তানের কাছে গর্ভ ভাড়া দেয়! নিজ পুত্রের বীর্য দিয়ে মায়ের গর্ভধারণকে পশ্চিমা নারীরা গর্ব অনুভব করে! (সূত্র: https://en.m.wikipedia.org/wiki /Surrogacy) এছাড়া পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশ পরিবারের নিজেদের মধ্যেই যৌনতাকে বৈধতা দিয়েছে। এতে বাবা তার কন্যার সাথে, মা তার ছেলের সাথে ইচ্ছেমতো যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। আর এটা তাদের রাষ্ট্রীয় আইনে বৈধ। ফ্রান্স, পর্তুগাল, স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রদেশে এ জাতীয় বৈধতা বর্তমানেও লক্ষণীয়! এটা কী ধরণের সভ্যতা, তা পাঠকগণই বিবেচনা করুন! (সূত্র: https://en.m.wikipedis.org) আধুনিক নারীরা পশ্চিমাদেরকেই একমাত্র তাদের জীবন ও মনের মডেল মনে করে। তারা তাদেরকেই নারী অধিকার ও ক্ষমতায়নের প্রবক্তা মনে করে থাকে।

অথচ পৃথিবীর সবচেয়ে ধর্ষণপীড়িত দেশ এই পশ্চিমা দেশগুলো। এক জরিপে দেখানো হয়েছে, যৌন হয়রানিমূলক শীর্ষ ১০ রাষ্ট্রের তালিকার ১০টিই পশ্চিমা দেশের অন্তর্গত। এ তালিকায় একটি মুসলিম রাষ্ট্রের নামও খুঁজে  পাওয়া যায় নাই। আমেরিকা একটি ধর্ষণপ্রবন দেশ। এফবিআই এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমেরিকাতে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ৯৫ ভাগ ধর্ষণ সংঘটিত হয় মাতাল অবস্থায়। আর এমতাবস্থায় বাবা তার মেয়ের সাথে, ছেলে তার মায়ের সাথে ও ভাই তার বোনের সাথে যৌনকর্মে মিলিত হয়। 

পরিসংখ্যান বলছে, ধর্ষণের দায়ে সাজাপ্রাপ্তরা জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর প্রায় শতকরা ৯৫ ভাগই  তারা আবার ধর্ষণে লিপ্ত হয়। এক জরিপে বলা হয়েছে, নারী ধর্ষণে সবচেয়ে এগিয়ে প্রথম অবস্থানে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সুইডেন, এরপর বৃটেন, জার্মানি, ফ্রান্স ও কানাডা। (সূত্র: https://www.bd.pratidin.com, 14 July 2019) অথচ সভ্যতার দাবিদার এই আমেরিকা! আর আমরাই তাদেরকে সভ্যতার জনক মনে করি! 
(চলবে)
লেখক: অধ্যাপক, দা'ওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া ও নির্বাহী সদস্য (জাশিপ)
Email: [email protected]

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ