ইয়াসির আরাফাত: মুক্তিকামী মানুষের ট্রেডমার্ক

প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০১৯, ১২:১৫

যুগ যুগ ধরে চলে আসা মুক্তির সংগ্রামে ফিলিস্তিনের মানুষের মুক্তির প্রতীক হয়ে আছেন ইয়াসির আরাফাত। প্রায় চার দশকের বেশি সময় ধরে এককভাবে আরব্য রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ছিলেন ইয়াসির আরাফাত।

ইয়াসির আরাফাত। আসল নাম মুহাম্মদ আবদেল রহমান আব্দেল রউফ আরাফাত আল-কুদওয়া আল-হুসেইনী। জন্ম ১৯২৯ সালের ২৪ আগস্ট মিশরের কায়রোতে। যদিও এ নিয়ে রয়েছে নানা জনের মতের অমিল। কায়রোর পাশাপাশি শোনা যায় পশ্চিম তীর আর জেরুজালেমের নামও। যদিও জীবদ্দশায় ইয়াসির আরাফাতের দাবী ছিলো তিনি জন্মেছিলেন জেরুজালেমে, যাকে তিনি সবসময়ই দেখেছেন ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে। শৈশবেই আরাফাতকে লোকে ‘ইয়াসির’ বলে ডাকতে শুরু করে। ষাটের দশকে তার সমর্থকেরা তাকে ‘আবু আম্মার’ বলে সম্বোধন করত।

জন্মের ৪ বছরের মাথায় আরাফাতের মা মারা গেলে তার শৈশব কাটতে থাকে কায়রোতেই। সেখানেই শুরু হয় শিক্ষাজীবন। ১৯৪৪ সালে কায়রোর ইউনিভার্সিটি অব কিং ফুয়াদ ওয়ানে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন। মাত্র সতের বছর বয়সেই আরাফাত জড়িয়ে পড়েন ফিলিস্তিনের মুক্তির সংগ্রামে। তখন তিনি মিশর থেকে ফিলিস্তিনে অস্ত্র চোরাচালানের কাজ করতেন। এভাবেই শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন। এরপর তিনি ইহুদিবাদ ও জায়নিজম সম্পর্কে পড়াশোনা করেন। ১৯৪৮ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় ফিলিস্তিনের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু ফেদাইনে যোগ না দিয়ে তিনি যোগ দেন মুসলিম ব্রাদারহুডে, যদিও ব্রাদারহুডের রাজনীতির সাথে তিনি কখনই যুক্ত ছিলেন না। সেখানে থেকে ফিরে ‘জেনারেল ইউনিয়ন অব প্যালেস্টাইনিয়ান স্টুডেন্টস’ এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রায় চার বছর দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৫৬ সালে প্রাগে অনুষ্ঠিত হওয়া একটি কংগ্রেসে যোগ দেন তিনি। সেখানেই তিনি প্রথম পরিধান করেন আরবের ঐতিহ্যবাহী পোষাক ‘কেফিয়াহ’ যা মাথায় পরিধান করা এক ধরনের চেক রুমাল বিশেষ। পরবর্তীতে এটিই হয়ে উঠেছিলো ইয়াসির আরাফাতের ট্রেডমার্ক হিসেবে। ফিলিস্তিনের মুক্তির প্রতীক হয়ে উঠেছিলো এই ট্রেডমার্ক। এই সময়েই আরাফাত পরিচিত হতে শুরু করেন ‘মি. প্যালেস্টাইন’ হিসেবে। গণমানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হতে শুরু করেন ইয়াসির আরাফাত।

পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে আরোও কিছু সংগ্রামীকে নিয়ে আরাফাত গঠন করেন ফাতাহ-দ্য প্যালেস্টাইনিয়ান ন্যাশনালিস্ট গেরিলা অর্গানাইজেশন। যা পরবর্তীতে একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিনত হয়। আরাফাত আর তার দল ফাতাহের উদ্দেশ্যই ছিলো বিপ্লব কিংবা সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে ফিলিস্তিন কে পুরো ভুমিসহ মুক্ত করা। এসময় আরাফাত তার দল ফাতাহের অধূনে একটি সামরিক শাখা গড়ে তোলেন ‘আল-আকসা’ নামে। এই বাহিনি প্রথম ইসরায়েলে হামলা চালায় ১৯৬৫ সালে অন্যান্য আরব নেতাদের সাথে ইসরায়েলের একটি বৈঠক চলাকালীন সময়ে। যদিও, সেখানের আলোচনার বিষয় ছিলো ফিলিস্তিনের স্বাধীনটার ব্যাপারটাই। কিন্তু ইয়াসির আরাফাত বুঝতে পারেন বৈঠকগুলো কালক্ষেপণ মাত্র। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ফাতাহ আরবদের সাথে যোগ না দেয়া একমাত্র সংগঠন যারা শুধুমাত্র ফিলিস্তিনের স্বাধীনতায়ই মনোনিবেশ করে এবং জনগনের কাছে আশার সবচেয়ে জলন্ত প্রদীপ হয়ে ধরা দেয়। এতে অনেক ভলান্টিয়ার যোগ দিতে শুরু করে এবং তা জর্ডানের কাছে মাথা ব্যাথা স্বরুপ মনে হতে থাকে।

১৯৬৯ সালে আরবের সেরা গেরিলা ইয়াসির আরাফাত ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন’-পিএলও’র প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষিত হন। কিন্তু পিএলও বিভিন্ন সময় বোমা বিস্ফোরন, বিমান ছিনতাই এবং বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকায় ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তারা সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবেই পরিচিতি পায় বিশ্ব সম্প্রদায়ে। ১৯৭০ সালে জর্ডানের সাথে সম্পর্ক আরোও তিক্ত হতে শুরু করলে তাকে জর্ডান থেকে বের করে দেওয়া হয়। আরাফাত আবার ফাতাহ পাড়ি জমায় লেবাননে এবং মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার চেষ্টা চালাতে থাকে। এ সময় আরাফাত গেরিলা বেশ ছেড়ে হয়ে উঠতে থাকেন একজন স্টেটসম্যান।

তার এই প্রচেষ্টা সফলতার মুখ দেখে যখন জাতিসংঘ ‘পিএলও’ কে ফিলিস্থিনের গণমানুষের প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এবং আরাফাত’ই হয়ে যান প্রথম ব্যক্তি যিনি কোন দেশের সরকার গঠন না করেও শুধু মাত্র জনগনের প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘের সাধারন পরিষদে বক্তব্য রাখেন।

কিন্তু এর ঠিক ১০ বছর বাদেই ইসরায়েল লেবানন আক্রমন করলে ইয়াসির আরাফাত ও ফাতাহ বাধ্য হয় তিউনিশিয়া গমন করতে। আরাফাত ও ফাতাহের গল্পে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঘটে ১৯৮৮ সালে যখন তারা ফিলিস্তিনের জনগনের কাছে চলে আসে এবং একই বছর আরাফাত পিএলও কে জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী করার উদ্দ্যেশে কূটনৈতিক ভাবে অগ্রসর হতে রাজি করেন এবং ইউরোপ-আমেরিকার সাথে সম্পর্কোন্নয়নে জোর চেষ্টা চালান মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানদের মতো। এতে ফিলিস্তিনি জনগণের মুক্তি বাধাগ্রস্ত হয় বলে অনেক ফিলিস্তিনি মনে করেন। এরই প্রেক্ষাপটে গঠিত হয় হামাস। ব্যাপারটা তিনি হয়তো আরোও উসকে দেন যখন তিনি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ২৪২ ধারা মেনে নেন যেখানে ইসরায়েলকে শান্তিপূর্ণ ভাবে সেখানে থাকার অধিকার দেয়া হয়। এই সিদ্ধান্তটিই ফিলিস্তিনের সাথে আন্তর্জাতিক বিশ্বের যোগাযোগের নতুন মাত্রা তৈরী করে।

হামাসের বিরোধীতা সত্বেও আরাফাত ও ফাতাহ শান্তিচুক্তির দিকেই অগ্রসর হতে শুরু করে এবং অসলো শান্তি চুক্তিতে সাক্ষর করে ইসরায়েলের সাথে। এতে করে পিএলও পশ্চিম তীর ও গাজার শাসনভার হাতে পায়। গঠিত হয় প্যালেস্টাইন অথরিটি (পিএ) বা ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ এবং প্যালেস্টাইন লেজিসলেটিভ কাউন্সিল (পিএলসি)। ১৯৯৪ সালে সেখান থেকে ইসরায়েলি সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। সেখানে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের অধীনে পিএলসি নির্বাচন হয় ১৯৯৬ সালে। নির্বাচনে ফাতাহ জয় পায় এবং ইয়াসির আরাফাত হন ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রথম প্রেসিডেন্ট।

এসময় ফিলিস্তিনের মাটিতেই বাড়তে থাকে ইয়াসির আরাফাতের শত্রু সংখ্যা। আরোও বেশি মাথা গজিয়ে উঠতে থাকে আরেক সশস্ত্র দল হামাস। কিন্তু ইসরায়েল সরকারের সঙ্গে কয়েক দফায় শান্তি আলোচনা করেন ইয়াসির আরাফাত। ১৯৯১ সালের মাদ্রিদ সম্মেলন, ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তি এবং ২০০০ সালের ক্যাম্প ডেভিড সম্মেলনের মাধ্যমে সংঘাত অবসানের চেষ্টা চালান। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা একে আরাফাতের নতজানু নীতি হিসেবে আখ্যায়িত করে তীব্র নিন্দা করতে থাকেন। মাহমুদ দারবিশের মতো তার অনেক বন্ধু পিএলও থেকে পদত্যাগ করেন।

১৯৯৪ সালে অসলো শান্তি চুক্তির জন্য ইজহাক রবিন ও শিমন পেরেজ-এর সঙ্গে একত্রে নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করেন ইয়াসির আরাফাত। এরপর ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত হন ফিলিস্তিনের প্রথম প্রেসিডেন্ট। একই সময় হামাস ও অন্যান্য সশস্ত্র সংগঠনের উত্থান হয়। তারা ফাতাহ ও আরাফাতের ক্ষমতার ভিত্তি দুর্বল করে ফিলিস্তিনের বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে।

ইয়াসির আরাফাত ২০০২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত রামাল্লায় তার অফিস কম্পাউন্ডে মূলত ইসরাইলি বাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ ছিলেন। ২০০৪-এর শেষদিকে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে প্যারিসের পার্সি মিলিটারি হাসপাতালে নেয়া হয়। এখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১১ নভেম্বর ২০০৪ সালে মারা যান। পশ্চিম তীরে তাকে সমাহিত করা হয়। কিন্তু চিকিৎসকেরা সেই সময় মৃত্যুর সঠিক কারণগুলো বলতে পারেনি। এমন কি ধ্বংস করে ফেলা হয় ইয়াসির আরাফাতের সকল মেডিকেল নমুনা। কিন্তু আরাফাতের স্ত্রী, সুরা আরাফাত পরবর্তীতে তদন্তের দাবী জানালে তদন্ত শুরু হয়। রাশিয়ার ফরেন্সিক তদন্ত দল ও সুইজারল্যান্ডের একটি চিকিৎসা গবেষণালয় তদন্তের রিপোর্টে ঘোষণা করেছে—প্রেসিডেন্ট আরাফাতকে পোলেনিয়াম-২১০ উচ্চ মাত্রার তেজস্ক্রিয় পদার্থ প্রয়োগের মাধ্যমে হত্যা করা হয়। তার হাড়ে গ্রহনযোগ্য মাত্রা থেকে আঠারো গুন বেশি পোলেনিয়াম পাওয়া যায়। 

ইয়াসির আরাফাত মারা গিয়েছেন প্রায় ১৫ বছর আগে। কিন্তু এখনো ফিলিস্তিনের ঘরে ঘরে আছেন ইয়াসির আরাফাত। রাস্তায রাস্তার শোভা পায় ইয়াসির আরাফাতের গ্রাফিত্তি। মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক হয়েই আছেন তিনি; থাকবেন মুক্তির এই চলমান সংগ্রামে। শুধু ফিলিস্তিনিদের সাথে থেকে নয় পুরো বিশ্বের মুক্তিকামী জনতার পাশে থেকে বেঁচে থাকবেন ইয়াসির আরাফাত।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ