জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

গুন্টার গ্রাস

প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০১৮, ১৩:০১

১.
গুন্টার গ্রাস, পুরো নাম গুন্টার ভিলহেম গ্রাস। বিশ্বব্যাপী গুন্টার গ্রাস নামে সমধিক পরিচিত। গ্যুন্টার গ্রাসের প্রতিভা ছিল বহুমুখী। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন ঔপন্যাসিক, কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী। ‘টিনড্রাম’উপন্যাসের জন্য ১৯৯৯ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ১৯২৭ সালের ১৬ অক্টোবর জার্মানির ডানজিগে গুন্টার গ্রাস জন্মগ্রহণ করেন। গুন্টার গ্রাসের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, গুন্টার গ্রাস, জার্মান সাহিত্যের আধুনিক পুরোধা, ৮৭ বছর বয়সে মারা যান ২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল, জার্মানির লুবেক এর এক হাসপাতালে। শুধু সাহিত্য বা শিল্পই নয় সামাজিক ন্যায়, শান্তি এবং পরিবেশ নিয়ে নানা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন তিনি। এ বিষয়গুলি নিয়ে মতামত প্রকাশে কখনই দ্বিধা ছিল না গ্রাসের। ঢাকায় এসেছিলেন, কলকাতাতেও বেশ কিছু দিন কাটিয়েছেন তিনি। 

২.
ভাস্কর্য, গ্রাফিক আর্ট থেকে কবিতা, নাটক, উপন্যাস— নানা ক্ষেত্রে ছিল গ্রাসের অবাধ বিচরণ। তবে নাজি সময় নিয়ে ১৯৫৯ সালে তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস ‘দ্য টিন ড্রাম’ আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। টিন ড্রাম প্রকাশের মধ্য দিয়ে বিশ্বসাহিত্যে তিনি তাঁর প্রবল আবির্ভাবের ঘোষণা দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে মায়া ও বাস্তব মেশানো উপন্যাস টিন ড্রাম তাঁকে পৌঁছে দেয় খ্যাতির চূড়ায়। আবার ‘দ্য টিন ড্রাম’ নিয়ে জার্মানিতে তীব্র প্রতিক্রিয়াও তৈরি হয়। ডুসেলডর্ফে ‘ট্য টিন ড্রাম’-এর কপি পোড়ানোও হয়েছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে হু হু করে বিক্রি হতে থাকে উপন্যাসটি। জীবদ্দশায় তিনি বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কারে সম্মানিত হন। সাহিত্যের সবচেয়ে গৌরবময় নোবেল পুরস্কার পান ১৯৯৯ সালে। এ পুরস্কার দেওয়ার সময় সুইডিশ অ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, গ্যুন্টার গ্রাস তাঁর সাহিত্যে নিপুণ হাতে ‘ইতিহাসের বিস্মৃত মুখচ্ছবি’ এঁকেছেন। নোবেল ভাষণ তিনি শেষ করেছিলেন যে-কথা বলে, এখানে তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য, ‘সমৃদ্ধ উত্তর ও পশ্চিম নিজেদের কঠিন নিরাপত্তাবেষ্টনে দুর্গের মধ্যে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু শরণার্থীদের পাল তাদেরকে ঠিক ধরে ফেলবে : কোনো ফটকই ক্ষুধার প্রবল চাপ সইতে পারে না। ভবিষ্যত এসব সম্পর্কে কিছু না কিছু বলবে। আমাদের প্রচলিত উপন্যাস অবশ্যই চলমান থাকবে। এমনকি যদি কোন একদিন লোকেরা লেখা ও বই প্রকাশ বন্ধ করেও দেয় বা করতে বাধ্য হয়, যদি বই আর না পাওয়া যায়, তা সত্ত্বেও, তখনও, গল্পকথক থাকবে, তারা আমাদের মুখ থেকে কানে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস দেবে, পুরনো গল্প নতুনভাবে বুনবে : কখনও বলবে উচ্চৈঃস্বরে, কখনও মৃদুকণ্ঠে, কখনও খণ্ড খণ্ড করে এবং কখনও বা বিরতি দিয়ে-দিয়ে, এখনই হাসির হুল্লোড় তো এখনই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হবে।’ তার এই পর্যবেক্ষণই বলে দেয় তার শৈল্পিক লক্ষ্য কী।

৩.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মান সাহিত্যে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়। তার সাহিত্যশৈলীর অন্যতম অনুষঙ্গ যাদুবাস্তবতা, এর সাহায্যে তিনি লেখকসত্তাকে সবসময় প্রশ্নের মুখোমুখি করেন, আর এটা করতে গিয়ে তিনি বাস্তববাদী আত্মজীবনীমূলক উপাদানের সঙ্গে মিশিয়ে দেন অসমর্থিত বা অজ্ঞাত কথকের বর্ণনা এবং চমৎকার, অবাস্তব ঘটনা যা কূটাভাস তৈরি করে, কিংবা ঘটনাকে বিদ্রুপায়িত করে। তার সাহিত্যিক উদ্দেশ্য সামাজিক সমালোচনার একটি পরিসর নির্মাণ করা। জার্মান জাতির বিবেক হিসেবে খ্যাত গ্যুন্টার গ্রাস তাঁর নানা লেখা এবং স্পষ্টবাদী ও দুঃসাহসী বক্তব্য প্রদানের জন্যও বিশেষ পরিচিতি পেয়েছিলেন। গ্রাস তার সৃজনশীল রচনা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে জার্মানি এবং জার্মান জনগণকে সবসময় বিষয় করেছেন। নাৎসী মতবাদের আদর্শিক যুক্তি ও তার বিস্তারকে পর্যালোচনা করেছেন। নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব এবং আত্মপরিচয়ের সংকটও তার অধীত বিষয়। আর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি তার পক্ষপাত সুবিদিত। এরাই যতসব শোষণ, নির্যাতন ও গণহত্যার প্রধান শিকার। তাঁর মৃত্যুর খবর প্রচারিত হওয়া পরে ট্যুইটারে দুঃখ প্রকাশ করেন সলমন রুশদি। তাঁকে নিজের সাহিত্যেকর্মের অনুপ্রেরণা এবং অন্যতম বন্ধু হিসেবে বর্ণনা করেছেন রুশদি।

৪.
দ্য টিন ড্রাম-এর পটভূমি যে ড্যানজিগ শহর সেখানেই জন্ম গুন্টার গ্রাসের, ১৯২৭ সালের ১৬ অক্টোবর। তার পিতা উইলহেম গ্রাস ছিলেন প্রোটেস্ট্যান্ট এথনিক জার্মান, অন্যদিকে মা হেলেন গ্রাস ছিলেন কাশুবিয়ান-পোলিশ বংশোদ্ভূত রোমান ক্যাথলিক। তবে গুন্টার গ্রাস ক্যাথলিক হিসেবেই বড় হন। শৈশবে তিনি কিছুকাল গির্জায় ‘বেদী-সহকারী’ হিসেবে কাজ করেছেন। তার পিতামাতার একটি মুদির দোকান ছিল। কৈাশোরের লেখাপড়া শেষে, ১৯৪৩ সালে, যখন তার বয়স ১৬, তিনি বিমান বাহিনীর একটি সহযোগী সংস্থায় যোগদান করেন। এটি জার্মানির ন্যাশনাল লেবার সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ১৯৪৪ সালের নবেম্বরে তিনি সাবমেরিন সার্ভিসে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ নেন, উদ্দেশ্য ‘কঠোর ক্যাথলিক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যুপকাষ্ঠ থেকে মুক্তি লাভ করা।’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে নেভিতে না নিয়ে ‘দশম প্যানজার ডিভিশন ফ্রুন্ডজবার্গ’-এ তালিকাভুক্ত করা হয়। এই বাহিনীতে তিনি ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত কাজ করেন। তিনি আহত অবস্থায় মিত্রবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং যুদ্ধবন্দী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। তার পরিবার শরণার্থীতে পরিণত হয়। তার মা রুশ সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিতা হন। ১৯৫৪ সালে মায়ের মৃত্যুর পর প্রত্যক্ষদর্শী বোনের কাছে শোনেন তিনি এই মর্মান্তিক কথা। জীবনের এই পর্বের কথা প্রথমে না বললেও ২০০৬-এ আত্মজীবনীতে সবই প্রকাশ করেন তিনি। এ নিয়ে তাঁর সমালোচনাও হয়েছিল।

৫.
১৯৪৬ সালে তিনি মুক্তি লাভ করেন। কাজ নেন একটা পটাশ খনিতে। এখানে কাজ করার সময়ই তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আকার পায়। তিনি সোশ্যাল ডেমোক্রাটসদের প্রতি আকৃষ্ট হন। চিত্রকলা ও ভাস্কর্য পড়ার জন্য ১৯৪৮ সালে ডুসেলডর্ফ একাডেমি অব আর্টে ভর্তি হন গ্রাস। ১৯৫২ সালে বার্লিনে চলে যান, ভর্তি হন সেখানকার স্টেট একাডেমি অব ফাইন আর্টস-এ। সেখানে গ্রাফিক ডিজাইনারের চাকরিও করেন। অবসর সময়ে তিনি কবিতা ও নাট্যনকশা লিখতে শুরু করেন। ১৯৫০ সালে তিনি বিকল্পধারার তরুণ লেখকদের সংগঠন ‘গ্রুপ ৪৭’-এর সঙ্গে যুক্ত হন। তার লেখা প্রকাশিত হতে শুরু করে বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায়। ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম গ্রন্থ, বিদ্রুপাত্মক ও পরাবাস্তব কবিতার সংকলন অ্যাডভান্টেজেস অব মুরহেন্স। লেখালেখির অনুকূল পরিবেশের সন্ধানে তিনি প্যারিস গমন করেন। সেখানে বসেই লেখেন দ্য টিন ড্রাম, ক্যাট অ্যান্ড মাউস এবং ডগ ইয়ার্স। এই তিনটি উপন্যাস স্বতন্ত্রভাবে রচিত হলেও ড্যানজিগ শহরের পটভূমিতে সৃজিত একটি ট্রিলজির একেকটি খণ্ডও বটে। 

৬.
এরপর অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে তিনি ব্যাপকভাবে সফর শুরু করেন। বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পূর্ব জার্মানি এবং পোল্যান্ডকে তিনি বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। দ্য টিন ড্রাম-এর সাফল্যের পর তিনি জার্মানিতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন। তিনি সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষে কাজ শুরু করেন। ওই পার্টিও তখনকার নেতা উইলি ব্রান্ডটের বক্তৃতা তিনিই লিখে দিতেন। ব্রান্ডট জার্মানির চ্যান্সেলর নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে মন্ত্রী করতে চেয়েছিলেন কিন্তু গ্রাস সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে পার্টিতে যোগ দেন ১৯৮২ সালে যখন তার পার্টি ক্ষমতা হারায়। এর দশ বছর পর তিনি পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের ব্যাপারে দলের নিয়ন্ত্রণমূলক কঠোর নীতির প্রতিবাদে।

৭.
জাদু বাস্তবতার লেখালেখি থেকে রাজনৈতিক সক্রিয়তায় অবতীর্ণ হওয়ার কারণে তার সৃজনশীল রচনার পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকে। তিনি তখন, ষাট এবং সত্তরের দশকজুড়ে, জার্মানির সাম্প্রতিক ইতিহাস, সমকালীন রাজনীতি, নারীবাদ, রান্নাবান্না, পরিবেশ, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে লিখতে থাকেন। এই সময়ে লেখা ইন ফ্রম দ্য ডায়েরি (১৯৭২)-এ তিনি সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পলিসির শম্বুক গতিকে রূপকের আদলে তুলে ধরেছেন। আর দ্য ফ্লাউন্ডার (১৯৭৭)-এ আছে খাদ্যের ইতিহাস এবং পুরুষতান্ত্রিকতা নিয়ে কৌতুক ও বিদ্রুপ।

৮.
আশির দশকে এসে তার লেখালেখি আরও হ্রাস পায়, তার রাজনৈতিক সক্রিয়তার কারণে মূলত। এ সময় তিনি জার্মানিতে আমেরিকার পারমাণবিক মিসাইল স্থপানের বিরোধিতায় ক্যাম্পেইনে নামেন। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোয়, বিশেষ করে নিকারাগুয়ায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার সমালোচনা করেন। এমন সময় একই সঙ্গে তিনি পরিবেশ সঙ্কট নিয়েও ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এই সময়ে রচিত তার প্রধান রচনা হেডবার্থ (১৯৭৯) এবং দ্য মিটিং অ্যাট টেলগেট (১৯৮১) সমালোচকরা ভালভাবে না নেয়ায় তিনি বিরক্ত হন এবং এক বছরের জন্য ভারতে চলে যান। কিন্তু সেখানেও পাঁচ মাসের বেশি তিষ্ঠাতে পারেননি, ফিরে গেছেন নিজ দেশে। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ জার্মানি প্রশ্নে তার মতদ্বৈধতা তাকে বিরূপ পরিবেশের মধ্যে নিক্ষেপ করে। সমালোচকরা তার ওপর খড়গ ঘোরাতে থাকে। এইসব সমস্যা নিয়ে তিনি দুটি উপন্যাস লেখেন দ্য কল অব টোড (১৯৯২) এবং ঠু ফা অ্যাফিল্ড (১৯৯৫)। কিন্তু এগুলো সেভাবে গৃহীত হয়নি। আসলে গ্রাসের মূল উদ্বেগ ছিল এই যে, এতে ঐক্যের ফলে জাতিরাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়বে, আর যদি ধ্বংস হয়ে নাও যায়, তাহলেও অতীতের নাৎসীবাদকে ভুলে না যাওয়ার নৈতিক অনুপ্রেরণাকে দুর্বল করে দেবে। এই বিষয় নিয়ে তিনি লেখেন ক্র্যাবওয়াক (২০০২)। দ্য টিন ড্রাম-এর পর এটাকেই তার সবচেয়ে শক্তিশালী কাজ হিসেবে দেখা হয়। উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠক-সমালোচকদের ব্যাপক সমর্থন লাভ করে। এতে তিনি দেখিয়েছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এবং তার পরে জার্মানদের দুর্গতির কথা বলেছেন যা প্রায়শই চেপে রাখা হয়। সে সময় তরুণদের মধ্যে নব্য-নাৎসীবাদের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কারণ অনুসন্ধান করেন তিনি, তিনি বলতে চান যে, মূল স্রোতের রাজনৈতিক আলোচনায় গল্পের একাংশ উঠে আসে, অন্ধকারে থেকে যায় জার্মানদের ভোগান্তি ও যন্ত্রণার কথা।

৯.
গুন্টার গ্রাস দুই খণ্ডে তার স্মৃতিকথা লিখেছেন, এবং কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। এগুলোও কম-বেশি নানান বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। ২০১২ সালে ইযরাইল তাকে ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করে ‘হোয়াট মাস্ট বি সেইড’ কবিতা প্রকাশের জন্য। এই কবিতায় ইযরাইলকে সামরিক সাহায্য দেয়ার জন্য জার্মানির সমালোচনা করা হয়। গুন্টার গ্রাস ঔপন্যাসিক হিসেবেই বেশি পরিচিত, যদিও নিজ দেশে তিনি তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্যও বেশ আলোচিত। কিন্তু একজন ভাল চিত্রশিল্পী এবং ভাস্করও ছিলেন। 

১০.
গ্রাস বিয়ে করেন ১৯৫৪ সালে, সুইডিশ নৃত্যশিল্পী মার্গারিটা শুয়ার্জকে। তাদের তিন ছেলে ও এক মেয়ে আছে। কিন্তু ১৯৭৮ সালে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ১৯৭৯ সালে তিনি বিয়ে করেন উতে গ্রুনেতকে। দ্বিতীয় পক্ষে তার দুটি সন্তান রয়েছে। 

১১.
জার্মানির নোবেলজয়ী কথাসাহিত্যিক গ্যুন্টার গ্রাসের বাঙালি ও বাংলাদেশ প্রেম ছিলো। আর তাই ১৯৮৬ সালে গ্যুন্টার গ্রাস বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। ঘুরেছিলেন এ দেশের আনাচকানাচে। পরে সেই অভিজ্ঞতা তিনি লিখেছেন নিজের ভ্রমণপঞ্জিতে। এ সফরের সময় স্ত্রী উটে গ্রাসও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। ঢাকা শহরে তিনি রিকশায় ও পায়ে হেঁটে বেড়িয়েছেন। জাতীয় জাদুঘরে জয়নুল আবেদিনের ছবি দেখে তিনি মুগ্ধ হন। লালবাগের কেল্লা ঘুরে দেখেন। এ ছাড়া মোহাম্মদপুরে বিহারি ক্যাম্প দেখতে যান। ভোরে গ্রাম দেখতে বের হন। কুমার, তাঁতি ও বস্তিবাসীদের জীবন তিনি খুব কাছে থেকে দেখেন। দিনপঞ্জিতে সেসব অভিজ্ঞতার বিবরণ তিনি লিখেছেন। রাজধানী ঢাকা সম্পর্কে গ্যুন্টার গ্রাস লেখেন, ‘৬০ লাখ লোকের একটি প্রায় শহরতলী, একটি দেশের রাজধানী, যে দেশ আয়তনে বাভারিয়্যর প্রায় দ্বিগুণ, কিন্তু লোকসংখ্যা ১০ কোটিরও বেশি, প্রতিবছর এ সংখ্যা তিন শতাংশ হারে বাড়ছে। পড়তে ও লিখতে জানে মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ। ১৯৪৬-৪৭ সালের নরমেধযজ্ঞ বা ১৯৭১ সালের লোকক্ষয়—বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতা লাভ করে—কোনো কিছুতেই এই পরিসংখ্যানের উন্নতি ঘটেনি, ফি-বছরের বন্যা ও তার পরবর্তী মহামারিতেও নয়।’

১১.২
ঢাকার সঙ্গে কলকাতার তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে দিনপঞ্জিতে গ্যুন্টার গ্রাস লিখেন, ‘কলকাতার চেয়ে এখানে মোটরগাড়ি কম, কিন্তু অনুমোদিত রিকশাই আছে এক লাখের মতো। বাতাস কলকাতার চেয়ে ভালো, রাস্তাঘাটে আবর্জনা কম, গরু-বাছুর পথ রোধ করে নেই। আর শহরে প্রবেশের রাস্তাগুলো প্রশস্ত, সামরিক কুচকাওয়াজের উপযোগী, খানাখন্দ নেই।’ বাংলাদেশের শীতের ভোরের বর্ণনা করতে গিয়ে গ্যুন্টার গ্রাস লেখেন, ‘ভোর পাঁচটায় বেরিয়ে পড়ি গ্রামের উদ্দেশে। সকালের তাজা হাওয়ায় জমে যাওয়া শরীরগুলো কাপড়, শাল, কাঁথা-কম্বলে মোড়ানো। অধিকাংশ ঘরের চালা টিনের। পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় এখানকার গ্রাম ঘন। একটি গ্রাম মিশে আছে আরেকটি গ্রামের সঙ্গে। আমাদের গন্তব্য টাঙ্গাইলের একটি মসলিন বাজার। মানুষের চাপে প্রদর্শনীর জন্য রাখা কাপড়ের রোলগুলো প্রায় দেখাই যায় না। কিন্তু যে মধ্যস্বত্বভোগী দালালেরা এই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে তারা ছাড়া বায়বীয় জাল কে আর কিনতে পারে?’ লালবাগের কেল্লা ঘুরে দেখার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে গ্যুন্টার গ্রাস তাঁর দিনপঞ্জিতে বলেন, ‘আমরা দেখতে গেলাম মোগল যুগের বিশাল লালবাগ কেল্লার অশেষ। খুব দীনহীন একটি জাদুঘর সেখানে আছে। বেশি কিছু সেখানে থাকলেও অন্ততপক্ষে তার দৈন্যদশা এই সাক্ষ্য দেয় যে, সংস্কৃতিলোলুপ ইংরেজরা কী নির্মমভাবে তাদের নিজেদের জাদুঘরগুলো সমৃদ্ধ করেছে।’ গ্রাসের এই উপমহাদেশের স্মৃতিকথায় বাংলাদেশ এভাবে ওতপ্রোত হয়ে মিশে আছে।

১২.
নোবেল বিজয়ী জার্মান লেখক গ্যুন্টার গ্রাসের সেই ঢাকা সফর নিয়ে লিখেছিলেন ‘ক্যামেরার কবি’খ্যাত গ্যুন্টার গ্রাসের ছায়াসঙ্গী নাসির আলী মামুন | এই বিশ্বখ্যাত লেখককে অনুসরণ করেছিল আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনের ক্যামেরা। কেমন ছিল গ্রাসের ঢাকা সফর? সেটি পাঠ করা যাক।

১২.২
‘গ্যুন্টার গ্রাস আমাদের আপনজনে পরিণত হয়েছেন বহু আগে। ১৩ এপ্রিল তিনি চিরতরে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার পর খুব মনে পড়ছে গ্যুন্টার গ্রাসের ঢাকা সফরের সেই দিনগুলো। মনে পড়ে, প্রায় ২৯ বছর আগের সেই দিনের কথা। সাত দিনের ব্যক্তিগত সফরে গ্যুন্টার গ্রাস আসছেন ঢাকায়। ঢাকার জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং কলকাতার গ্যাটে ইনস্টিটিউট যৌথভাবে সফরের ব্যবস্থাটি করল। কিন্তু ঢাকায় আলোচিত এই লেখককে সাত দিন সঙ্গ দেবেন কে? সে সময়ের জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক পিটার জেভিত্স চিন্তা করে বের করলেন কবি বেলাল চৌধুরীকে। তিনি ঢাকায় সার্বক্ষণিক সঙ্গী হবেন গ্যুন্টারের। মুশকিলটা হলো গ্যুন্টারের ঢাকায় অবস্থান গোপন রাখতে চায় জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। আবার একই সঙ্গে তাঁর ঢাকা সফর স্মরণীয়ও করে রাখতে চায় ওরা। গ্যুন্টারের বারণ সত্ত্বেও আমাকে সন্তর্পণে নির্বাচন করা হলো যেন মহতী ভ্রমণটিকে আলোকচিত্রে স্মরণীয় করে রাখা যায়। যখন জানলাম কাজটি আমাকে করতে হবে, ভেতর ভেতর খুব উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠা কাজ করছিল। যদিও তত দিনে আমি অনেক খ্যাতিমান এবং বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্বের পোর্ট্রেট ক্যামেরায় ধারণ করে কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। কাজেই বিশ্বাস ছিল, গ্রাসকে ঢাকায় সামলানো আমার জন্য দুরূহ কাজ হবে না। 

১২.৩
বিমানবন্দরে প্রথম দেখা- ১৯৮৬ সালের ২ ডিসেম্বর। ঢাকা বিমানবন্দরে কলকাতা থেকে আসা যাত্রীরা বের হয়ে আসছেন। আমরা চোখ রাখছি। ভিড়ের মধ্যে ট্রলি ঠেলে গ্যুন্টার গ্রাস স্যুটকেস ও ব্যাগ নিয়ে স্ত্রী উটের সঙ্গে চলে এলেন আমাদের সামনে। আমি একটু সাবধািন। শুরুতেই হুট করে ছবি তুলে বিরাগভাজন হতে চাই না। তাই ক্যামেরাটা প্রায় লুকিয়ে একটু দূর থেকে ক্লিক করলাম। তারপর কিছুটা কাছে চলে এলাম। ততক্ষণে বুঝে গেলাম আমাকে তিনি বাধা দেবেন না। ভরসা পেয়ে কয়েকটা ছবি তুললাম। গ্রাস আপত্তি করলেন না।
 
১২.৪
ধানমন্ডি ২৮ নম্বর রোডের ফোর্ড ফাউন্ডেশনের রেস্টহাউসে উঠেছিলেন গ্রাস দম্পতি। পরদিন সকালে ঠিক করা হলো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এক রিকশা। তাতে উঠে বসলেন গ্রাস ও তাঁর স্ত্রী। সামনের রিকশায় আমি ও বেলাল ভাই। প্রথমেই রিকশায় ওঁদের ছবি তুলে ফেললাম। গ্রাসের হাতে তাঁর চিরচেনা সেই পাইপ। ঠোঁটের ফাঁকে ঢুকছে আর ধোঁয়া ছড়িয়ে যাচ্ছে। ঘুরতে ঘুরতে আমরা ঐতিহাসিক লালবাগ কেল্লায় চলে আসি। ভেতরে অনেকটা সময় সবকিছু চোখে মেপে মেপে দেখলেন তিনি। দেয়ালে বাংলা লেখা প্রচুর ‘অমুক + অমুক’ জাতীয় প্রেম নিবেদন। গ্রাস জানতে চাইলেন এগুলো কী? বেলাল চৌধুরী অর্থ বুঝিয়ে দিলেন। গ্রাস মজা পেয়ে হাসলেন। হাসি দেখে আমার ক্যামেরা তাঁর আরও কাছে যেতে সাহস পায়। বিরল সব দৃশ্যের ছবি তুলে রাখছি। কেল্লা থেকে বেরিয়ে রাস্তার পাশে ছাপড়ার দোকানে চা খেতে চাইলেন, গরম বাকরখানির ব্যবস্থাও হলো। 

১২.৫
পুরান ঢাকার অলিতে–গলিতে
ঢাকায় গ্রাসের ছবি তোলার সময় তাঁর রসিকতা, সঙ্গে থাকা ব্যাগ থেকে বের করে স্কেচবুকে ছবি আঁকা, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ধারণা খুব কাছে থেকে উপভোগ করার দুর্লভ সুযোগ হয়েছিল। কলকাতা ও ঢাকার তুলনা করে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা চাঁদ দেখতে পাও, ওরা পায় না!’ ঢাকার ব্যস্ত প্রায় সব জায়গায় ঘুরেছেন তিনি। একজন দক্ষ সাংবাদিকের মতো তিনি ঢুকে পড়লেন কুমোরদের ঘরের ভেতর। বিস্ময় ভরে দেখলেন ওঁদের হাতে তৈরি নিপুণ মাটির কাজ। তাঁদের সঙ্গে কথা বললেন। একজন মাটির হাঁড়ি তৈরি করছিলেন। বিদেশি খরিদ্দার মনে করে দ্রুত চাকা ঘুরিয়ে বানিয়ে দেখান সুন্দর দুটো হাঁড়ি। স্ত্রী উটে জানতে চাইলেন মাটির এই পট িকসে ব্যবহার হয়। শাঁখারীবাজারে শিল্পীদের কাজ দেখে বিস্ময়ে চোখ আটকে যায় গ্রাসের। অনেকক্ষণ থেকে কাঁধে রাখা ব্যাগের খাতাটা বের করে ছবি আঁকতে চাইছিলেন। কিন্তু বিদেশি মানুষ দেখে ভিড় লেগে যায়। তিনি খাতাটি আবার ব্যাগে ভরে ফেলেন। রাস্তার ধারে মানুষের চুল কাটার দৃশ্য বেশ উপভোগ করেছেন। দেখতে রাশভারি হলেও গ্রাস গল্প করতে ভালোবাসেন। ঢাকার অনেক কিছু তুলনা করতে ভোলেন না কলকাতার সঙ্গে। মজার কিছু দেখলে হো হো করে হাসেন। তখন কে বলবে এই লোকটি বিশ্বখ্যাত একজন মানুষ। পৃথিবীর শীর্ষ লেখকদের অন্যতম! 

১২.৬
ঢাকায় প্রায় সব জায়গাতেই তাঁর সঙ্গে ঘুরছি, ধরে রাখছি সবকিছু ক্যামেরায়। ঘুরতে ঘুরতে যা-কিছু তাঁর মনে ধরে হয় তিনি থেমে গিয়ে খুব কাছে থেকে পরখ করেন। উটেকে অনুরোধ করতে দেখেছি সেসব ছবি তুলে রাখার জন্য। স্ত্রীর হাতে পেন্টাক্স ক্যামেরা। সবকিছু নয়, শুধু যেসব দৃশ্যে বিমোহিত হন গ্রাস, সেগুলো ক্যামেরাবন্দী করেন তিনি। বাংলাবাজার, সদরঘাট, ঢাকার নবাবদের আহসান মঞ্জিল, পুরান ঢাকার অলিগলি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দর্শনে বিমোহিত হয়েছিলেন তিনি। সোনারগাঁয়ের পানাম নগরে স্ত্রী উটের হাত থেকে ক্যামেরা চেয়ে ছবি তুলেছেন।ব্যক্তিগত স্কেচবুকে এঁকেছেন পুরোনো দালান, দরজার নকশা, ক্ষয়ে যাওয়া নিঃসঙ্গ স্তম্ভ। আমি তাঁর সঙ্গে থেকে পরখ করছি কোনো কিছুই তিনি এড়িয়ে চলছেন না। পানামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছবি এঁকেছেন, রাস্তায় ভিড় জমেছে। তিনি নির্বিকার, তাঁর কাজ করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। শাহবাগের জাদুঘরে ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখেছেন মনভরে। বিস্মিত হয়েছেন আমাদের পুরোধা শিল্পী জয়নুল আবেদিনের আঁকা দুর্ভিক্ষের অমর চিত্রকর্মগুলো দেখে।
 
১২.৭
ফুলকপি ভাজি আর রুইমাছ
ঢাকায় গু্যন্টারের সফরের শেষ দিন নতুন এক ধরনের রেস্টুরেন্টের খবর দেন বেলাল চৌধুরী। সদরঘাটে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর ভাসমান হোটেল। সানন্দে সম্মতি দেন গ্রাস দম্পতি। দুপুরে ফুলকপি ভাজি, তাজা রুইমাছ, ডাল এবং সালাদ। আধঘণ্টার মধ্যে ধোঁয়া উড়িয়ে বুড়িগঙ্গার ভাসমান রেস্টুরেন্টের টেবিলে বাংলা খাবার তৈরি। আমাদের সঙ্গে ছিলেন কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান। দেখলাম সুলতানকে গ্রাসের বেশ মনে ধরেছে, সমীহ করে কথা বলেন। কিন্তু শিল্পী সুলতান নির্বিকার। খাওয়া হয়। আড্ডা হয়। চায়ের অর্ডার দেওয়া হয়, গরুর দুধের চা। হঠাৎ ব্যাগ থেকে স্কেচ খাতাটা বের করে সুলতানের দিকে মনোযোগ দিলেন গ্যুন্টার গ্রাস। তাঁর ছবি আঁকলেন। 

১২.৮
গ্যুন্টার গ্রাসের সঙ্গে একটি সন্ধ্যা
ঢাকায় ‘গ্যুন্টার গ্রাসের সঙ্গে একটি সন্ধ্যা’র আয়োজন করেছিল জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। সেখানে বক্তৃতায় তিনি বলেছেন মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে থাকা মানুষজনদের দুর্দশার কথা। দর্শকদের মধ্য থেকে লেখক আহমদ ছফা দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘হোল বাংলাদেশ ইজ এ জেনেভা ক্যাম্প।’ 

বিদায়ের মুহূর্তে গ্যুন্টার গ্রাসের হাতে অনেক দুর্লভ স্মৃতি উপহার দিতেই সেই পরিচিত হাসি। আমার মনে হয়েছিল, তিনি ছবি তুলতে আগ্রহী। আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে নীল স্যুটকেসের তলায় যত্ন করে ছবিগুলো রাখতে দেখলাম। পরে জেনেছি, ঢাকায় তোলা ছবিগুলো তিনি জার্মানিতে নিয়ে যেতে পারেননি। চুরি হয়ে যায় আমার ক্যামেরায় তোলা তাঁর দুর্লভ মুহূর্তগুলো। 

১৯৯৯ সালে গ্রাস যখন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারটি জয় করেছিলেন, তখন ঢাকা ও কলকাতার অনেকে বলছিলেন পুরস্কারের অর্ধেক আমাদেরও। কলকাতার সঙ্গে এই মানবতাবাদী লেখকের তীব্র নৈকট্য উসকে দিয়েছিল এই দাবির সমর্থনকে। 

জিব কাটো লজ্জায়–বইটিতে (জার্মান ভাষায় সুঙ্গে সাইগেন) তিনি কলকাতা ও ঢাকাকে যেভাবে বর্ণনা করেছেন, সেটি কারও কারও অপছন্দ ছিল। তবুও যে মানবিক বিষয়গুলো তাঁর প্রকাশিত বইয়ে বিশ্বসাহিত্যের পাঠকদের সামনে তিনি তুলে ধরেছেন সেটি অনন্য। তাই তিনি যখন নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, সেটি মানসিকভাবে ভাগাভাগি করে নিতে দ্বিধা করিনি আমরা, অন্তত যারা ছিলাম গ্রাসের।

১৩.
‘বিশ্বসাহিত্যিককে কাছ থেকে দেখা’ শিরোনামে জার্মানির বাঙালি সাংবাদিক সরাফ আহমেদ লিখেছেন স্মৃতিকথা।সেটি পাঠ করা যাক।-
‘থাকতেন একদম নিভৃতে বড় কোনো শহর বা নগর নয়, জার্মানির প্রায় একদম দক্ষিণে ছোট লুবেক শহরের প্রান্তে, বেলেনডর্ফে। খামারবাড়ির আদলের বাড়ি, সঙ্গে আপেল বাগান আর বহমান খাল। 

নিভৃতে থাকতেন বটে, তবে যেখানেই যেতেন, থাকতেন শিরোমণি হয়ে। সেবার ২০০৪ সালের ৯ নভেম্বর ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় তাঁর প্রকাশিত বই আমার শতাব্দী থেকে পাঠকদের সামনে পাঠ করবেন। কয়েক শ সাহিত্যপ্রেমী মানুষ ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার বিশাল হলরুমের কার্পেট বিছানো মেঝেতে বসে আছেন। মধ্যখানে লাল কার্পেট বিছানো চৌকিসম মঞ্চে এসে সোফায় বসলেন বিশ্বসাহিত্যের এই মহানায়ক, পাশে বসলেন তাঁর বইয়ের প্রকাশক বন্ধু গেরহার্ড স্টাইডেল। তাঁর লেখা থেকে পাঠ করছেন, মাঝেমধ্যে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে পানীয়র গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন। দুই ঘণ্টার সেই অনুষ্ঠানে মাঝে মাঝে গ্যুন্টার তাঁর লেখার অনুপ্রেরণা বা পটভূমির কথা তাঁর কলকাতা ও ঢাকা শহরের অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন। 
তাঁর আড্ডাধর্মী এসব পাঠ অনুষ্ঠানে কয়েকবার থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছে—তিনি সব অনুষ্ঠানেই তাঁর লেখার বইয়ের বিষয়ে ঢুকে পড়তেন, খুব সহজ করে বলতেন জার্মানির সমাজব্যবস্থা, ইউরোপীয় ও বিশ্বরাজনীতির অপছন্দের বিষয়গুলো নিয়ে। 

হ্যানোভার শহরে থাকতেন তাঁর কাছের বন্ধু হ্যানোভার বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ওসকার নেগট। সেই সূত্রে প্রায় প্রতিবছরই আসতেন এই শহরে আর এলে হ্যানোভার বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিওম্যাক্স মিলনায়তনে গ্যুন্টার গ্রাসের পাঠচক্র বসত। ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে সেই আড্ডাধর্মী বই পড়ার অনুষ্ঠানে হলভর্তি ঠাসা মানুষ। এই বিশ্বসাহিত্যিকের প্রয়াণের ঠিক আগে মার্চ মাসে দুটি অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন হামবুর্গের টাইলা থিয়েটারে নিজের বিখ্যাত লেখা টিন ড্রামের মিউজিক্যাল শো দেখতে আর লুবেক শহরের দশম লেখক সম্মেলনে। 

গ্যুন্টার গ্রাসের মৃত্যুর এক দিন পরই তাঁর প্রকাশক বন্ধু গেরহার্ড স্টাইডেল জানিয়েছেন, গ্রাসের লেখা সর্বশেষ বইটির সব কাজ লেখক সপ্তাহ খানেক আগেই শেষ করেছিলেন ফন এন্ডলিশকাইট বা সবকিছুর শেষে নামের বইটি আগামী জুলাই-আগস্ট মাসে প্রকাশিত হবে। বইয়ের প্রতিপাদ্য বিষেয় গেরহার্ড স্টাইডেল শুধু বলেছেন, এই বইটি হবে কবিতা ও গদ্য সাহিত্য নিয়ে ছোট পরীক্ষা-নিরীক্ষা। 

গ্যুন্টার গ্রাস ১৯৫৯ সালে তাঁর সাড়া জাগানো উপন্যাস টিন ড্রাম–এ যেমন বিশ্ব বিবেককে শুনিয়েছিলেন নাৎসিদের যুদ্ধ-বর্বরতার কাহিনি, তেমনটি ৫৬ বছর পর জীবনসায়াহ্নে এসেও অত্যন্ত সাদামাটা ভাষায় সহজ সত্য কথা বলে গেছেন। তিনি তাঁর কলম শাণিত করেছেন যুদ্ধ-বর্বরতা আর সব অপশক্তির বিরুদ্ধে, কখনো বিতর্কের ভয়ে মুখ বন্ধ রাখেননি। মানুষ হিসেবে এখানেই এই মানবতাবাদী সাহিত্যিকের আসল সার্থকতা। (১৪ এপ্রিল ২০১৫)

১৪.
‘গুন্টার গ্রাসের মাহাত্ম্য’শিরোনামে বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক সালমান রুশদী লিখেছিলেন স্মৃতিকথা। সেটিও পাঠ করা যেতে পারে। -

১৪.২
সালমান রুশদী লিখছেন, ‘১৯৮২ সালের কথা, আমি তখন 'মিডনাইটস চিলড্রেন'-এর জার্মান ভাষার সংস্করণের কাজে হামবুর্গে অবস্থান করছিলাম, আমার প্রকাশক আমার কাছে জানতে চাইলেন আমি গুন্টার গ্রাসের সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী কি-না। অবশ্যই, আমি তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলাম এবং হামবুর্গ থেকে দূরে উইউইলসফ্লেথ গ্রামের দিকে রওনা হলাম, এখানে পরে গুন্টার গ্রাস বাস করতেন। গ্রামের মধ্যে তার দুটি ঘর ছিল, একটি ঘরে তিনি বসবাস করতেন ও লিখতেন এবং অন্যটি তার আর্ট স্টুডিও হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বেশকিছু বেড়ার দেয়াল পার হয়ে, তার চেয়ে বয়সে ছোট লেখক হিসেবে আমি যেভাবে আশা করেছিলাম ঠিক সেভাবেই তাকে আমার প্রণাম জানালাম, তার সামনে আসতে পেরে আমি আনন্দিত ছিলাম, তিনিও আমাকে সাদরে গ্রহণ করলেন এবং তার ক্যাবিনেটের দিকে আমাকে নিয়ে গেলেন যেখানে তার পুরনো গ্গ্নাসের সংগ্রহশালা রয়েছে এবং আমাকে একটি বেছে নেওয়ার জন্য বললেন। তারপর তিনি স্ন্যাপসের একটি বোতল বের করলেন এবং বোতলের তলানিতে যেতে যেতে আমরা একে অপরের বন্ধু হয়ে গেলাম। এর কিছু সময় পর আমরা তার আর্ট স্টুডিও দেখতে গেলাম এবং সেখানে গিয়ে আমি যা দেখলাম তাতে মুগ্ধ হলাম। তার উপন্যাসের অনেক বিষয় যা আমি চিনতে পারলাম একবার দেখেই। সেগুলোর মধ্যে ছিল_ ব্রোঞ্জের বানমাছ, টেরাকোটার বিশাল মাছ, নকশাকাটা কাঠে একটি ছেলে টিনের ড্রাম বাজাচ্ছে। আমি তার সাহিত্যে কৃতির জন্য তাকে যতটা প্রশংসা করি, তার অনন্যসাধারণ শিল্পের জন্যও তাকে ততটা প্রশংসা করলাম। একদিনের লেখার কাজ শেষ করে, রাস্তা দিয়ে হেঁটে গিয়ে তিনি একজন অন্য শিল্প মাধ্যমের মানুষ হয়ে যান, এটা সত্যিই চমৎকার। তিনি তার নিজের বইয়ের প্রচ্ছদগুলোও করেন; কুকুর, ইঁদুর, ব্যাঙগুলো তার কলম থেকে বের হয়ে যেন তার ধুলো মাখা জ্যাকেটের দিকে যেতে থাকে। 

১৪.৩
গুন্টার গ্রাসের সঙ্গে ওই সাক্ষাতের পর, যতজন জার্মান সাংবাদিকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাদের আমি গুন্টার গ্রাস সম্পর্কে আমার চিন্তা কী_ এটা জানানোর জন্য তাদের প্রশ্ন করতে বললাম এবং যখন তাদের আমি বললাম_ আমি বিশ্বাস করি তিনি হচ্ছেন পৃথিবীর দুই বা তিনজন জীবিত মহান লেখকদের মধ্যে একজন। কয়েকজন সাংবাদিক আমার এই কথায় হতাশ হলো এবং তারা বললেন_ ''হ্যাঁ, তা ঠিকই, 'দ্য টিন ড্রাম', তবে এটা অনেক দিন আগের পুরনো নয় কি?'' তাদের এই কথার উত্তরে আমি বলতে চাইলাম, গ্রাস যদি এই উপন্যাসটি না-ও লিখতেন, তার অন্য বইগুলো আমার প্রশংসা ও সম্মাননা পাবার জন্য যথেষ্ট ছিল কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে তিনি 'দ্য টিন ড্রাম' লিখেছেন, যা তাকে অমরত্বের কাতারে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। সন্দেহপ্রবণ এই সাংবাদিকদের হতাশ দেখাল। তারা আমার কাছে নেতিবাচক কিছু শুনতে চেয়েছিল, কিন্তু নেতিবাচক হিংসাত্মক কিছু আমার বলার ছিল না। 

১৪.৪
তার লেখার জন্য তাকে ভালোবাসতাম, অবশ্যই গ্রিম টেলসের প্রতি তার আগ্রহ, যেগুলো তিনি আধুনিক পোশাকে নতুন করে লিখেছিলেন, তার ব্ল্যাক কমেডি যেগুলো তিনি ইতিহাসের নিরীক্ষণে ব্যবহার করেছেন, তার কৌতুকপূর্ণ গাম্ভীর্যতা, তার সময়কার অশুভ অনেক বিষয় তিনি যেগুলোর মুখোমুখি হয়েছিলেন এবং মূল্য দিয়েছিলেন মহান শিল্পের নানা দিক নিয়ে, যা কখনও বলা হয়নি, এমন সব বিষয়ে তার সাহস প্রদর্শন ছিল অবিস্মরণীয়। [পরবর্তী সময়ে লোকজন যখন তাকে নাৎসি, এন্টি সেমিটি বলে নিন্দা করতে লাগল_ আমি ভাবলাম; তার বইগুলো তার হয়ে কথা বলুক, নাৎসিবিরোধী সেরা সব লেখা যা তিনি লিখেছেন, যেখানে অন্ধ জার্মানদের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের কথা বলা হয়েছে যেসব কথা কোনো এন্টি সেমিটি লেখক লিখতে পারেন] তার সত্তরতম জন্মদিনে, থালিয়া থিয়েটার হামবুর্গে অনেক লেখক সমবেত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে নাদিন গোর্ডিমার, জন আরভিং এবং পুরো জার্মান সাহিত্যের রথী-মহারথীরা ছিলেন অন্যতম। সবাই এক হয়ে তার প্রশংসাসূচক গান গেয়েছিলেন কিন্তু এত কিছুর মধ্যে আমি শুধু এটাই মনে করতে পারি যে, প্রশংসা গান শেষ হবার পর মিউজিক বেজে উঠল, থিয়েটারের স্টেজ ড্যান্স ফ্লোরে পরিণত হয়ে গেল, গ্রাসকে তখন একজন নাচের মাস্টার হিসেবে আবিষ্কার করলাম। তিনি ওয়াল্টজ, পোলকা, ফক্সট্রট, ট্যাঙ্গো ও গেভোট নাচ পারতেন এবং দেখা গেল যে, সব জার্মান সুন্দরী লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল তার সঙ্গে নাচবে বলে। তিনি আনন্দের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে নাচলেন, আমি বুঝলাম, এ মানুষটি হচ্ছেন সেই মানুষ যিনি জার্মান সাহিত্যের সেরা নাচিয়ে, যিনি ইতিহাসের কদর্যতা ও আতঙ্ককে সাহিত্যের সৌন্দর্যে রূপান্তরিত করেছেন, আপন মনের করুণায় অশুভর সঙ্গ দিয়েছেন, তার কৌতুকজ্ঞান ছিল সত্যিকার অর্থে কৌতুকময়। ১৯৮২ সালে যেসব সাংবাদিক এমনটা চেয়েছিলেন যে, তাকে বিদ্রূপ করি, তাদের আমি বলেছিলাম- 'তার মৃত্যুর পর তোমরা হয়তো বুঝবে একজন মহান লোক তোমরা হারিয়েছো।' সেই সময় এখন এসেছে। আমি আশা করছি তারা এখন বুঝতে সক্ষম হবে।’ ( নিউইয়র্কার পত্রিকায় ২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল প্রকাশিত রচনা থেকে ভাষান্তর করেছেন আহমাদ শামীম)।

(তথ্যসূত্র : উইকপিডিয়া, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক কালের কণ্ঠ, ইন্টারনেট)

লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন 
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত