আজ ইয়াসমিন ট্র্যাজেডি দিবস

প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০১৬, ০৮:৪৫

সাহস ডেস্ক

আজ ২৪ আগস্ট। বাংলাদেশের ইতিহাসের জঘন্যতম বর্বরোচিত ঘটনা পুলিশ হেফাজতে কিশোরী ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার ২২তম বছর। ১৯৯৫ সালের এই দিনে দিনাজপুরের কয়েকজন বিপদগামী পুলিশ সদস্য ওই কিশোরীকে ধর্ষণ ও হত্যা করে। ওই ঘটনার পর থেকেই দিনটি ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

ইয়াসমিনের মা শরিফা খাতুন দেশের সকল রাজনৈতিক দলসহ সামাজিক সংগঠনের নেতাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শিশু ও নারী নির্যাতন বন্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং সামাজিক আন্দোলনে শরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

দিনাজপুর শহরের রামনগর এলাকার গরিব ঘরের শরীফা বেগমের মেয়ে ইয়াসমিন। গরিব পরিবারে জন্ম নেয়ায় চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে পেরেছিল সে। টাকা জমিয়ে আবার লেখাপড়া করার স্বপ্ন বুকে নিয়েই পাড়ি জমায় ঢাকায়। ঢাকায় এসে একটি বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ নেয়। আট-নয় মাস কাজ করার পর নিজের বাড়িতে যেতে চায়। কিন্তু গৃহকর্তা তাকে দুর্গা পূজায় বাড়িতে যেতে বলেন। কিন্তু মায়ের জন্য মন ছুটে যায় ইয়াসমিনের। আর সে কারণেই হয়তো ২৩ আগস্ট ওই পরিবারের ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে একাই দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয় ইয়াসমিন।

১৯৯৫ সালের ২৩ আগস্ট ঢাকা থেকে বাড়িতে ফিরছিল কিশোরী ইয়াসমিন। ভুল করে ঠাকুরগাঁওগামী নৈশকোচ হাছনা এন্টারপ্রাইজে উঠে পড়ে সে। বাসটি রাত ৩টার পরে দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও-রংপুরের সংযোগ মোড় দশমাইল এলাকায় এসে পৌঁছায়। তিন রাস্তার মোড় বলে সেখানে রাতেও চায়ের স্টল, খাবারের দোকান প্রায়ই খোলা থাকে। বাসের সুপারভাইজার খোরসেদ আলম ও হেলপার সিদ্দিকুর রহমান ইয়াসমিনকে সেখানে নামিয়ে জনৈক চা দোকানদার জোবেদ আলীকে অনুরোধ করেন, যেন ইয়াসমিনকে দিনাজপুরগামী কোনো গাড়িতে উঠিয়ে দেন।

সে সময় জয়ন্ত নামে একজন যাত্রীও বাস থেকে নামেন। বাস থেকে নেমে জয়ন্ত ও ইয়াসমিন জোবেদ আলীর চায়ের দোকানের পাশেই একটি দোকানে নাস্তা খায়। আবদুর রহিম নামে এক পান দোকানদার ইয়াসমিন কীভাবে দিনাজপুরের রামনগরে যাবে জানতে চাইলে জয়ন্ত তাকে পৌঁছে দেবে বলে জানান। এ সময় উপস্থিত কয়েকজন আপত্তি জানিয়ে ইয়াসমিনকে তারাই দিনাজপুরগামী গাড়িতে তুলে দিতে চান।

এরপর বীরগঞ্জ থেকে আসা পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যানের (নং-ম-০২-০০০৭) চালক অমৃতলাল বিষয়টি জানতে চান। পিকআপ ভ্যানে পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মইনুল এবং আব্দুস সাত্তার বসেছিলেন। অমৃতলাল এ সময় ইয়াসমিনকে তাদের সঙ্গে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। তবে ইয়াসমিন সকাল না হওয়ায় যেতে সাহস পায়নি। এরপর অমৃতলাল ধমক দিয়ে তাকে পৌঁছে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে নিয়ে যান।

যাওয়ার সময় ইয়াসমিন তাদের কুমতলব আঁচ করতে পেরে অন্ধকারে পিকাপ থেকে লাফ দিয়ে নেমে যায়। এরপর পিকআপ ভ্যানটি আনুমানিক তিনশ গজ দূরে সাধনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে দাঁড় করিয়ে পুলিশ টর্চ দিয়ে তাকে খুঁজতে থাকে। এ সময় দুজন ভ্যান-রিকশাচালকের কাছে পুলিশ জানতে চায়, তাদের পিকআপ ভ্যান থেকে যে মেয়েটি লাফ দিয়েছে, তাকে তারা দেখেছে কিনা? ঠিক ওই মুহূর্তে ঢাকা থেকে দিনাজপুরগামী একটি নৈশ কোচের হেডলাইটের আলোয় পুলিশ এবং রিকশাচালকরা ইয়াসমিনকে রাস্তার ওপর পড়ে থাকতে দেখেন। এরপর পুলিশ আবার ইয়াসমিনকে পিকআপ ভ্যানে তুলে নেয়।

পরে ওই এলাকার লোকজন রাস্তায় রক্তের দাগ, পাশে ইয়াসমিনের জুতা, রুমাল, হাতপাখা ও ভাঙা চুড়িও পড়ে থাকতে দেখেন। এর ঘণ্টা তিনেক পরে গোবিন্দপুর সড়কে ব্র্যাক অফিসের সামনে ইয়াসমিনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। এরপর উত্তর গোবিন্দপুর এলাকায় পড়ে থাকা ইয়াসমিনের লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির উদ্দেশে কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক স্বপন কুমার প্রকাশ্যে লাশ বিবস্ত্র করে ফেললে উৎসুক জনতার মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয় এবং ঘটনার পরদিনই দিনাজপুরে এ হত্যার প্রতিবাদে এবং হত্যা ও ধর্ষণের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, দিনাজপুর কোতোয়ালি পুলিশ বিষয়টি সামাল দেয়ার জন্য ‘একজন অজ্ঞাতপরিচয়ের লাশ উদ্ধার’ মর্মে ঘটনাটি সাজিয়ে থানায় একটি ইউডি মামলা করে। লাশের তড়িঘড়ি ময়নাতদন্ত শেষে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে বালুবাড়ি শেখ জাহাঙ্গীর গোরস্থানে দাফন করা হয়। লাশের কোনো ধরনের গোসল ও জানাজা পড়ানো হয়নি।

২৫ আগস্টের বিক্ষোভে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন। মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান তিনজন। আহত হয় আরও শতাধিক। ঘটনার পর বিভিন্ন মহল থেকে ইয়াসমিনের পরিবারকে হুমকিও দেওয়া হয় অনেকবার।

তখন একজন ইয়াসমিন আর একজন ইয়াসমিন থাকেনি ইয়াসমিন হয়ে উঠেছিলো নারী নির্যাতনের প্রতিরোধ মিছিলের দীপ্তশীখা। সারা দেশব্যাপী শুরু হয় দুর্বার আন্দোলন।

উত্তাল আন্দোলনের মুখে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দিনাজপুরের পুরো পুলিশ বাহিনীকে লাইনে ক্লোজড করা হয়। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার শহরের নিয়ন্ত্রণ হারান। ১৪৪ ধারা ও কারফিউ জারি করে বিজিবি (তৎকালীন বিডিআর) নামিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। তারপর দেশব্যাপী আন্দোলন যখন নিয়ন্ত্রণে ব্যার্থ হয় সরকার তখন অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর আন্দোলন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়।

ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দিনাজপুরের তৎকালীন কোতোয়ালি থানার সহকারী উপপরিদর্শক মইনুল হোসেন, কনস্টেবল আবদুস সাত্তার এবং পুলিশ পিকআপচালক অমৃতলাল রায়ের ফাঁসি ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে কার্যকর করা হয়।

ইয়াসমিন এখন শুধু আর নিহত হতভাগ্য এক কিশোরীর নাম নয়। বরং সে এখন নারী নির্যাতনের এক প্রতীকের নাম। আর তাই প্রতিবছর ২৪ আগস্ট পালিত হয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত