মুক্তিযুদ্ধের অস্তিত্বহীনতা ও ধর্মের রাজনৈতিক অনুশীলন প্রবণতা

প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০১৬, ২০:০১

রাজনৈতিক পথ-মতে সংস্কার প্রয়োজন। কাউকে জঙ্গি হিসেবে গড়ে তুলতে দুটো প্রবণতা একসাথে কাজ করে, যার একটি মোটিভেশন এবং অপরটি মিলিটেন্সি। আমার মনে হয়, এই মোটিভেশন আসে ১) দেশে দেশে আগ্রাসন, ২) দারিদ্র্যদশা, ৩) উচ্চাশা, ৪) ধর্মবোধ, ৫) ক্ষমতার চর্চা ইত্যাদি। আর মিলিটেন্সি আসে ১) ধর্মীয় উগ্রপন্থায় আনুগত্য বোধ, ২) আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারেরর দুর্বার আকাঙ্খা থেকে, যা মোটিভেটেড ব্যক্তিদের সনাক্ত ও বাছাই করার পর প্রশিক্ষণ প্রদান, নেশাগ্রস্ত হওয়া ও ক্ষমতা চর্চায় অস্ত্র ব্যবহারই একমাত্র অবলম্বন-এই দিক্ষা দিয়ে জঙ্গি হিসেবে গড়ে তোলে।

এই প্রবণতাগুলো রুখতে বাংলাদেশে তেমন কোনো কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না। বরং অনাস্থা-অবিশ্বাসের সংস্কৃতি আর পরিবর্তীত বৈশ্বিক পরিস্থিতি এই প্রবণতাগুলোকে পরিণতি দিয়ে চলেছে দিনের পর দিন। এ ধরনের প্রেক্ষাপটে যারা মনে করেন কিছু তরুনের বিপষথগামী হওয়াটা বড় কোনো সামাজিক অবক্ষয় নয় তারাও যেমন ভুল করছেন তেমনি যারা মনে করেন বাংলাদেশ রসাতলে গেছে অথবা জঙ্গিবাদের চূড়ান্ত পর্যায়ে অবস্থান করছে, তারাও ভুল করছেন।

বিপথগামী হওয়াটাই যে সামাজিক অবক্ষয়-এমন ধারণা ঠিক না। তবে একসময় তা অবক্ষয় হতে পারে। যেমন- বিপথগামীরা যখন সমাজে শেকড় গেড়ে বসবে এবং তাদের সংখ্যা বাড়াতে বাড়াতে এমন এক জায়গায় নিয়ে যাবে যখন এই বিপথগামিতাই সমাজের স্বাভাবিকতা কিংবা স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হবে তখনই কেবল একে অবক্ষয় বলা যেতে পারে। তবে এটি অস্বীকার করা যাবে না যে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই বিপথগামিতা সমাজে চলমান ক্ষয়িষ্ণু ধারা যা অবক্ষয়ের পথে চালিত করছে তার তাৎক্ষণিক-ভয়ঙ্কর একটি ফলাফল।

বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই জাতি গঠনে বন্ধ্যাত্ব এই অবক্ষয়ের পথে আমাদের চলতে বাধ্য করছে। কিন্তু এর বিপরীতে বহুমুখী চেতনাজীবির সৃষ্টি থেমে থাকেনি। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রাজনীতির দ্বন্দ্ব, সদ্যভূমিষ্ঠ রাষ্ট্রে রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার আড়ালে গুপ্ত সমরশক্তির উত্থান ও আত্মগোপনে থাকা মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত ও বিরোধী শক্তির ঐক্য, সেনা-রক্ষি বাহিনীর মর্যাদার প্রকাশ্য লড়াই ইত্যাদির পরিণতিতে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র এবং জাতির জনককে হত্যার ঘটনাকে আড়াল করার জন্য একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুত সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের স্বপ্নে দেশের মানুষকে বিভোর রাখার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো, সেটিই চলেছে আজও পর্যন্ত।

এ জন্য জিয়াউর রহমানের বহুদলীয়গণতন্ত্রের বাতাবরণে নিষিদ্ধ ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রকাশ্য রাজনীতিতে পুনর্বাসন, মুক্তিযুদ্ধের অমূল্য সম্পদ সংবিধানের ধর্মান্তরকরণ, বাংলাদেশ বিরোধীদের রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার বানানো, এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম, যুদ্ধাপরাধীদের সাথে নিয়ে বিএনপির জোটভিত্তিক রাজনীতির চর্চা এবং অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের ক্ষমতারোহনের কৌশল-পদ্ধতিতে পূর্ববর্তীদের অনুসরণ; একটি রাষ্ট্রভাবনায় প্রগতিশীলতার চর্চায় ব্যত্যয় ঘটিয়েছে-মুক্তিযুদ্ধের পথে বাঙ্গালীর মনন গঠনের কাজটি হয়নি বা করতে দেয়নি।

কিন্তু যারা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ চায়নি তারা কি বসে থেকেছে? মোটেও না। তারা এই পরিস্থিতির আওতায় তাদের মতবাদ গঠন করে চলেছে; আমাদের-রাষ্ট্রকেই কাজে লাগিয়ে, রাজনীতি আজ তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত! 

এ অবস্থা অবধারিতভাবেই বর্তমান ও আগামির বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক ভোট আয়ত্ব করার প্রতিযোগিতা ক্ষেত্র হিসেবে সুসংহতভাবে গড়ে তুলছে, যা কিনা চলমান ক্ষয়িষ্ণু ধারার প্রতিভূ; জঙ্গিবাদ বিস্তারের নিয়ামক শক্তি।

তা্ই বৈশ্বির সন্ত্রাসবাদের মূল্যায়ন এবং দখলের দায় বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা খুব সহজেই কাজে লাগানো যাচ্ছে। সুদূর ইসলামিক স্টেট অব ইরাক-সিরিয়া (আইএসআইএস) দর্শন সম্মোহনীশক্তির মতো কাজে আসছে, যদিও তারা বাংলাদেশের ধর্মীয় সামরিকপন্থার চাইতে নবীন কিংবা নিকটবর্তী কোনো ভৌগলিক সম্পর্কের নয়, মিল নেই সংস্কৃতির সাথে, তবুও আমরা প্রতিনিয়তই অপদস্ত হয়ে চলেছি; বাংলাদেশ রসাতলে গেছে বা আমাদের জঙ্গিবাদ চূড়ান্ত পর্যায়ের!এটি যে ষড়যন্ত্র তা বুঝে ওঠা খুব কষ্টের নয়। কিন্তু মোড়লপনার বিশ্বব্যবস্থায় এখান থেকে বের হওয়াটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ এবং বের হতে পারলেই কেবল সভ্যতা-সংস্কৃতি-ইতিহাস ধারণ করে টিকে থাকা সম্ভব। যদি বের হয়ে আসতেই চাই তাহলে বিদ্যমান রাজনৈতিক পথ-মতে জরুরি সংস্কার প্রয়োজন, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের অস্তিত্বহীনতা ও ধর্মের রাজনৈতিক অনুশীলন প্রবণতা থাকবে না। আমরা কি পারবো রাজনীতির সংস্কার মেনে নিতে?

জীবন জয়ন্ত এর ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত