দুইজন মানুষের ভালবাসাবাসির ফলে তোমার জন্ম

প্রকাশ : ০৫ জুলাই ২০১৬, ১৪:১৯

(১) 
একটু পড়াশুনা করা দরকার। পড়তে বসবো। তার আগে উদ্বিগ্ন পিতামাতাদের সাথে একটা বিষয় বলে যাই। কোন পিতামাতা? সাধারণ মধ্যবিত্ত বা বিত্তবান মুসলিম পিতামাতা, যারা চান যে ছেলেমেয়েরা ধর্মকর্ম করুক, নামাজ রোজা করুক, উচ্চ নৈতিক মান অর্জন করুক, মুসলিম ভ্যালুস ধারণ করুক, কিন্তু জঙ্গি যেন না হয়। অথবা সেইসব পিতামাতা যারা মনে করেন ছেলেমেয়েরা ভাল মুসলিম হোক, কেননা একজন ভালো সহি মুসলিম নাকি সবসময়ই ভাল মানুষ হয়- কিন্তু জঙ্গি যেন না হয়। অথবা সেইসব পিতামাতা যারা চান ছেলেমেয়েরা আধুনিক হোক, বড় হয়ে ভাল এক্সিকিউটিভ হোক আবার সেই সাথে কোর মুসলিম ভ্যালুস ধারণ করুক। এরা। এইসব পিতামাতার উদ্দেশ্যে এইসব কথা বলা।

আর যেইসব পিতামাতা ভাবে ছেলেমেয়েরা লিবারেল চিন্তা করবে, সমাজ সংসার সম্পর্কে ভাববে, ইচ্ছামত বই পড়বে, একটু সামাজিক সাংস্কৃতিক খোঁজ খবর রাখবে, ডেমোক্রেটিক ভ্যালুস শিখুক, মানুষকে শ্রদ্ধা করতে শিখুক, যারা পুরনো সংস্কার দিয়ে ছেলেমেয়েদেরকে আচ্ছন্ন করতে চান না, আর যারা জীবনযাপনে নিজেরাও সৎ এবং সেক্যুলার এবং সন্তানদেরকেও চান যে সৎ ও সেক্যুলার হোক- ভালো মানুষ হোক, আপনাদের এই পোস্ট পড়ার দরকার নাই। কারণ সন্তান মানুষ করার আসল কায়দাটা আপনারা ইতিমধ্যে জেনে গেছেন এবং আপনার সন্তানের জঙ্গি হয়ে যাওয়ার ভয় নাই।

প্রথমেই ছেলেমেয়ে মানুষ করার একটা সংক্ষিপ্ত কিন্তু নিশ্চিত পথ বলে দিই। একদম সোজা পথ- সিরাতুল মুস্তাকিম। ছেলেমেয়েকে বলুন ওরা যেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হয় আর ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিটা মনোযোগ গিয়ে করে। ব্যাস। আর কিছু না। ওদেরকে বলেন আমাদের লাকি আক্তার, লিটন নন্দী, সুমন সেনগুপ্ত বা অমিত দের মতো হতে। আমার বয়স পঞ্চাশ পার হয়ে গেছে, পেশাগতভাবে সাফল্য খানিকটা আছে, সমাজে আমাকে মানুষ মন্দলোক বলে না। আমি আমার এই অর্ধ শতাব্দী ধরে অর্জিত সকল সুনাম আর বৈষয়িক অর্জন সবকিছু বাজি রেখে বলতে পারি- আপনার ছেলে এই দেশের সাচ্চা সন্তান হবে, যাকে নিয়ে কেবল আপনি না, আপনার পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন আর পরবর্তী চতুর্দশ অধস্তন প্রজন্ম অহংকার করবে।

বিল্পব ওরা কবে করবে জানিনা- কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েরা যারা ছাত্র ইউনিয়ন করে, ওরাই দেশের সেরা ছেলেমেয়েরা। এরাই আমাদের সংসপ্তক এরাই আমাদের ফিনিক্স। এরা লড়বে, লড়তেই থাকবে, লড়তে লড়তে মরে যাবে, একজনের জায়গায় আরেকজনের জন্ম হবে। কিন্তু এই যোদ্ধারা হাল ছাড়বে না। আপনার ছেলে বা মেয়ে যদি ছাত্র ইউনিয়ন করে, আপনি নিজেই একদিন দেখবেন, অবাক হয়ে দেখবেন আপনার পরম ভালোবাসার শিশুটি মানুষ হিসেবে আপনার বা আমার চেয়ে অনেক অনেক অনেক বড় হয়ে গেছে।

(২) 
না, ছাত্র ইউনিয়ন না করলেও ছেলে মেয়েরা ভাল মানুষ হতে পারে। কেন নয়? কিন্তু কিভাবে করবেন?

প্রথমে আপনি নিয়ত ঠিক করেন। সন্তানকে কি মানুষ করতে চান? নাকি শুধু কেরানী বানাতে চান? কেরানী বললাম বলে রাগ করবেন না। আপনারা যাদেরকে এক্সিকিউটিভ বলেন, এরা আসলে সকলেই কেরানী। জীবন ধারণের জন্যে এইসব কাজ করতে হয় করবে, কিন্তু এইরকম 'সফল' কেরানী হওয়া মানে মানুষ হওয়া না। একইভাবে ডাক্তার উকিল ইঞ্জিনিয়ারদের ক্ষেত্রেও বলা যায়। শুদ্ধ পেশাজীবী হওয়াও কোন সাফল্যের চিহ্ন না। একজন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বা উকিল বা আর্কিটেক্ট যদি নিজের জীবনে ভাল মানুষ না হয় তাইলে সে তার পেশায়ও ভাল হবে না। পেশাগত স্কিল ওদেরকে ওদের প্রফেশনাল স্কুলে শিখাবে বটে, কিন্তু প্রতিটা পেশারই দার্শনিক দিক আছে, সেগুলি না শিখলে ওরা কেবল মিডিওকারের চেয়ে একটু নীচের মানেই থেকে যাবে।

মানুষ হিসাবে সন্তানকে গড়তে চাইলে ওকে প্রথমেই কি শিখাবেন? এটা খুবই একটা সহজ প্রশ্ন যার উত্তরও খুবই সহজ কিন্তু আমরা অনেকেই এই সোজা কাজটা করি না। সন্তানকে মানুষ করতে চাইলে প্রথমেই ওকে শিখাবেন যে, আমার সোনা বাবুটা, তুমি একজন মানুষ। হ্যাঁ। এই কথাটা প্রথম শিখাবেন, দ্বিতীয়বারও এই কথাটাই শিখাবেন আর ওর তৃতীয় লেসনটা হবে যে 'তুমি, আমি আর আমাদের চারপাশে সকলে, সকলেই মানুষ এবং আমরা সকলেই একইরকম। খুব কঠিন কাজ মনে হচ্ছে? কঠিন হবে কেন? আপনি তো আপনার ছেলেকে বা মেয়েকে মানুষই করতে চান। তাইলে ওর বুদ্ধির বিকাশের প্রথম ধাপেই মুল ভিত্তিটা স্থাপন করে দেন- ওকে বলে দেন যে সে একজন মানুষ।

সন্তানকে বলুন, তুমি মানুষ হয়ে জন্মেছ। একজন মানুষের পেটে জন্মেছ। দুইজন মানুষের ভালবাসাবাসির ফলে তোমার জন্ম। তোমাকে মায়ের পেট থেকে টেনে বের করেছে আরেকজন মানুষ, তোমাকে নাড়ি কেটে মায়ের দেহ থেকে আলাদা করে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব দিয়েছে আরেকজন মানুষ। তারপর তোমাকে কোলে করেছে আরেকজন মানুষ। চারিদিকে কেবল মানুষ আর মানুষই মানুষের হাত ধরে মানুষকে মানুষ করে তোলে। এই বোধটা আপনার সন্তানকে শিখাতে চেষ্টা করেন। সে যখন মৃত্যু শিখবে, তখন যেন সে বুঝতে পারে মৃত্যুতেই মানুষই তাকে কাঁধে করে নিয়ে যাবে সে যেখানে যেতে চায়। তাইলে আপনার সন্তান নিজে থেকেই একদিন বলবে, তাইতো! মানুষই তো মানুষের অন্তিম আশ্রয়। আমাকে মানুষ হতে হবে।

(৩) 
আপনার সন্তান যখন নিজেকে মানুষ বিবেচনা করবে, সে নিজের মানুষ পরিচয়ের মর্যাদায় অহংকারী হবে, তখন সকল মানুষের প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ জন্ম নিবে। আপনাকে আর আলাদা করে শিখাতে হবে না যে, না, দেখ সে ড্রাইভার হলেও মানুষ, বা সে চাকর হলেও মানুষ, বা সে মুচি হলেও মানুষ। এইরকম যে বলেন আপনারা- যে সে মুচি হলেও মানুষ, এইরকম বলা ঠিক না। কেন? কারণ এটার মধ্যে মানুষকে নিচু করার একটা ইয়ে লুকিয়ে থাকে। একধরনের অহং- যে দেখ, তুমি উঁচু মানুষ আর সে নিচু মানুষ, তুমি দয়া করে ওকে মানুষ বিবেচনা কর। সেটার দরকার নাই। একজন মানুষের বাচ্চা যখন নিজের মানুষ পরিচয়টা সবার উপরে রাখবে সে তখন সকলকেই সম্মান করবে। কেননা মানুষ পরিচয়ই তো তার নিজের বড় পরিচয় এবং এইটাই তার মর্যাদার জায়গা।

এবং তার পক্ষে তখন অসৎ হওয়া কঠিন হয়ে যাবে। আপনাকে ভয় দেখাতে হবে না, লোভ দেখাতে হবে না। যে মানুষ অপরের প্রতি সম্মানটা মানুষ জীবনের প্রথম নিয়মগুলির মধ্যে একটা মানে, তার পক্ষে অসৎ হওয়া কঠিন। এতো কঠিন যে আপনি সেটাকে প্রায় অসম্ভব বলতে পারেন। কিভাবে এটা হয়? কারণ মানুষের প্রতি সম্মান থাকার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হচ্ছে নিজের প্রতি সম্মান। নিজের ডিগনিটি আর ইন্টিগ্রিটি জাদই না থাকে তাইলে প্রথমে সে তার নিজের প্রতি সম্মান হারাবে আর এরপর সে তার সহজীবি মানুষের চোখে নিচে নেমে যাবে। যে নিজের মানুষ পরিচয়টা সবার উপরে রাখে আর যে মানুষের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান ধরন করে, তার পক্ষে নিজের চোখে আর সমাজের চোখে পরে যাওয়া আর মরে যাওয়া একই কথা।

এই জন্য দেখবেন যে পৃথিবীর যে কোন সমাজে নাস্তিকরা সাধারণত কোন নৈতিক অপরাধের সাথে জড়িত থাকে না। নাস্তিকরা সকলেই সাধারণত সৎ মানুষ হয়। কারণ নাস্তিকরা জানে যে উপরে আর নিচে কিছু নাই- মানুষই মানুষের অন্তিম আশ্রয়।

এই কথাটা আমি যখনই কাউকে বলি, একশ তেত্রিশজন মানুষকে যদি এই কথাটা বলি ওর মধ্যে একশ তেইশজনই অবিশ্বাসের চোখে আমার দিকে তাকায়। আর বাকি দশজনের মধ্যে নয়জন মনে করে আমি বুঝি ঠাট্টা করছি। কেন জানেন? আমরা হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের মধ্যে ঠুসে ঠুসে এই জিনিসটা ঢুকিয়েছি যে মানুষ হচ্ছে কুকুর বিড়াল বা গাধার মত। ওকে খাবারের লোভ দেখাতে হবে আবার লাঠির ভয়ও দেখাতে হবে। ইংরেজিতে ওরা বলে 'কেরট অ্যান্ড স্টিক'- গাধার সামনে ঝুলিয়ে রাখবেন সুন্দর কমলা রঙের গাজরের খোয়াব আর মাথার উপরে রাখবেন লাঠি।

এই শিক্ষা তো আমরা মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে রেখেছি আদিম সাম্যবাদী সমাজ ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই। একারণেই দেখবেন, কেরট আর স্টিক ছাড়া মানুষ সৎ থাকতে পারে এই কথাটা কেউ অনুধাবনই করতে পারেনা। কিন্তু এই শিক্ষা তো মানুষের প্রতি সম্মান শিখাচ্ছে না। এই শিক্ষা থেকে আনার সন্তানকে ডিব্রিফিং করতে হবে। ওকে শিখবেন যে, মানুষই মানুষের অন্তিম আশ্রয়, মানুষের উপর কিছু নাই- নাড়ি পুরুষ হিন্দু মুসলমান বাঙালী অবাঙ্গালী এইসব পরিচয় আসে মানুষ পরিচয়ের পরে।

(৪) 
আপনি যদি এই কাজটি করতে পারেন- মানে আপনার ছেলে বা মেয়েকে যদি শিখাতে পারেন যে সে একজন মানুষ এবং মানুষ পরিচয়ই তার প্রথম পরিচয়, তাইলে আপনার ছেলে বা মেয়ে মানুষ হয়ে গেছে। একদম। সে পৃথিবীর সেরা মানুষদের কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে। পিতা বা মাতা হিসাবে আপনার কাজ আপনি প্রায় শতভাগই সেরে ফেলেছেন। কেননা সন্তানকে মানুষ পরিচয়টি ধরিয়ে দেওয়া সবচেয়ে কঠিন কাজ। সেই কাজটিই আপনি করে ফেলেছেন।

বাকি শিক্ষা? বাকি থাকে দুইটা শিক্ষা- এক নম্বর হচ্ছে রুটি রুজি আহরণের জন্যে একটা বিদ্যা শিখানো। সতা হতে পারে চিকিৎসা বিদ্যা, ওকালতি, প্রকৌশলবিদ্যা, মাস্টারি কেরানিগিরি কতকিছু। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে মানুষ হিসাবে মানুষের হাজার বছরের অর্জিত জ্ঞানের যতটুকু সম্ভব জানা আর জীবনকে উপভোগ করার বিদ্যা।
কখনো কখনো এই দুইটা এক হয়ে যায় এবং সেইটাই সাফল্য। অর্থাৎ একজন যখন নিজের জীবনকে উপভোগ করে বা তার পছন্দের কাজটি করে বা জ্ঞানার্জনের পথে থেকেই রুটি রুজি কামাতে পারে তারচেয়ে সফল জীবন আর নেই। যেমন যে ছেলেটি গান করতে ভালোবাসে সে যদি গান করেই জীবিকা নির্বাহ করতে পারে, বা যে মেয়েটি ছবি আঁকে সে যদি ছবি একেই জীবন ধারণের জন্যে দুইটা তাকা কামাতে পারে, বা যে ছেলেটি ইতিহাস পড়তে পছন্দ করে সে যদি ইতিহাসের অধ্যাপনা করতে পারে, বা যেই ছেলেটি বিপ্লব করতে চায় সে যদি বিপ্লবের জন্যে তার জীবন ব্যয় করতে পারে এইটাই তো সাফল্য। আমার আনন্দের কাজটি করলাম আর সেই আমার রুটিরুজি এর চেয়ে আর সফল জীবন কি আছে?

সুতরাং সন্তানকে যখন বিদ্যা শিক্ষা দিতে যাচ্ছেন- আপনি তো ইতিমধ্যেই তাকে মানুষ পরিচয় শিখিয়ে দিয়েছেন- তখন সে কি পড়বে সেটা তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে দিন। আপনি তো অবশ্যই তাকে সাহায্য করবেন। আপনার জীবনের অভিজ্ঞতা আপনার সন্তানের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু সিদ্ধান্তটা তাকেই নিতে দেন। আর এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়গুলি কখন আসে? মোটামুটিভাবে আপনার সন্তানের ১৩ বা ১৪ বছর বয়স থেকে শুরু করে ২৩ বা ২৪ বছর বয়স পর্যন্ত কয়েকটা ধাপে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আসে। এর মধ্যেই আপনার সন্তান জীবন সম্পর্কে অনেককিছু জেনে গেছে। ওর অর্জন ওর প্রজ্ঞা বা ওর অপছন্দ অপছন্দকে অবজ্ঞা করবেন না। আপনি যদি মনে করেন আপনার ১৪ বছরের ছেলেটি বা মেয়েটি নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না তাইলে আপনি মেনে নিচ্ছেন পিতা বা মাতা হিসেবে আপনি ব্যর্থ।

সন্তানকেই সিদ্ধান্ত নিতে দিন। মনে রাখবেন এটা ওর জীবন। আপনি তাঁকে আপনার জ্ঞান বুদ্ধি অভিজ্ঞতা দিয়ে সহায়তা করবেন, কিন্তু কিছু চাপিয়ে দিবেন না। এই সময় যদি ওর পছন্দের বিরুদ্ধে কিছু চাপিয়ে দেন, তাইলে হয়তো আপনি আপনার সন্তানের বাকি জীবনটাই দুর্বিষহ করে দিলেন। মনে রাখবেন, আপনার সন্তান যদি বুদ্ধিমান হয় আর সৎ হয় আর তার নৈতিকমান যদি ভালো হয়, তাইলে যে যাই পড়ুক তার আয় উপরজন যাই হোক সে একজন ভালো মানুষ হিসাবে আনন্দময় জীবন যাপন করতে পারবে।

(৫) 
আপনি হয়তো ভাবছেন ছেলেমেয়েকে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালে ভাল হবে আর কোথায় পড়ালে জঙ্গি হয়ে যেতে পারে সেটা কিয়ে আলোচনা করছি না কেন? এইখানে পিতামাতার সাথে সাথে রাষ্ট্রেরও খানিকটা দায়িত্ব আছে। সব কলেজ বা সব বিশ্ববিদ্যালয়েরই নানারকম সীমাবদ্ধতা আছে। দেশে পড়ানো যেরকম ভালো বিদেশের পড়ানোও ভাল। আবার দুইটাতেই মন্দ ফল হতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ছেলেমেয়েকে মানুষ পরিচয়টি ধরিয়ে দেওয়া।

আর বিশ্ববিদ্যালয়? পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়টি হতে পারে আপনার ঘর এবং আপনার এবং আপনার সন্তানের বন্ধুবান্ধব। ঘর কিভাবে? সন্তানকে পড়তে উৎসাহ দিবেন। সেখানে বাছ বিচার করবেন না। শুধু উৎসাহ দিবেন সে যেন সবকিছু পড়ে। সবকিছু মানে সবকিছু- নির্ধারিত সিলেবাস করে দিবেন না। সে গল্প পড়বে, কবিতা পড়বে, ইতিহাস পড়বে, প্রবন্ধ পড়বে, সিনেমার গসিপ পড়বে, ধর্মগ্রন্থ পড়বে, পর্নগ্রাফি পড়বে, ফেমিনিজম পড়বে, মারক্সিজম পড়বে। সবকিছুই পড়বে। নিজের কথা বলতে চাচ্ছিলাম না, তবু বলে দিই। আমার মেয়েরা জানতে চেয়েছে ফিফটি শেডস অভ গ্রে বইটা কিরকম? আমরা ওদেরকে সেটা কিনে দিয়েছি, যে পড়ে দেখ কি জিনিস। আমি বইটা পড়িনি, আমার স্ত্রী বইটা পড়ে প্রথমে বিরক্ত হয়েছেন- তুমি এইটা বাচ্চাদেরকে কি বই কিনে দিলা? কিন্তু পরে তিনি উপলব্ধি করেছেন যে না, পড়ুক, কি আছে।

কোনকিছু পড়েই আপনার সন্তানের কোন ক্ষতি হবে না যদি সে তার পড়ার দরোজাটা উম্মুক্ত রাখে। সবকিছু পড়বে, সেখান থেকে সে নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। আপনি যদি ওর পড়ার লাইনটা সীমিত করে দেন তাইলেই অসুবিধা।

ঘরকে বিশ্ববিদ্যালয় কেন বলছি? আপনার সন্তানের বয়স যখন ২০এর দিকে যাচ্ছে তখন তো আপনি, সাধারণ গড় হিসাবে, পঞ্চাশের দিকে যাবেন। এই পঞ্চাশ বছর বয়সে আপানর ঘরে যদি এক দুই হাজার বই জমে না যায় তাইলে হবে না। কিন্তু আপনার ঘরে যদি এক দেড় বা দুই হাজার বই জমে যায়, তাইলে আপনার সন্তানের সামনে সারা বিশ্ব উম্মোচিত হয়ে যাবে। এই ধি হাজার বইই হয়তো সে পড়বে না বা এই দুই হাজার বইতেই সারা দুনিয়ার জ্ঞান জমা নাই। কিন্তু এইখান থেকে কিছু কিছু বই সে পড়বে আর তাতে করে তার পড়ার আগ্রহ তৈরি হবে আর সে আরও বই সম্পর্কে জানবে আর আপনাকে বলবে সেইসব বই কিনে দিতে। আপনি ওকে কনভার্স কোনে দিতে পারেন বা না পারেন বই তো কিনে দিতে পারবেন। নাকি? একটা বইয়ের দাম হয়তো দেখেন একজোড়া মোজা না একজোড়া ফ্রাইড চিকেনের চেয়ে কম খরচে পাওয়া যায়।

ঘরে যদি বইয়ের সংগ্রহ থাকে, তাইলে আপনি যেন ছেলেকে বা মেয়েকে একটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিই করিয়ে দিলেন।

(৬) 
কিন্তু তবু বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ওর জ্ঞান লাভ হবে না। কিভাবে জ্ঞানার্জন করতে হয় সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিখানো হয়। এই ব্যাপারটা মনে রাখবেন। বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু পণ্ডিত বানানোর বিদ্যালয় না। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে কিভাবে জ্ঞানার্জন করবেন সেটা শিখানোর স্কুল। বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু প্রশিক্ষণের বা স্কিল ট্রেইনিং এঁর জায়গাও না। খানিকটা স্কিল ট্রেইনিং হতে পারে- কিন্তু এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুল কাজ না। আর যেসব বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠান শুধুই স্কিল ট্রেইনিং আর ক্যারিয়ার তৈরির কথা বলে, ওরা বিশ্ববিদ্যালয়ই না। এদেরকে আপনি পলিটেকনিক বলতে পারেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় না।

আরেকটা জিনিস খেয়াল রাখবেন। তর্ক ছাড়া জ্ঞান অর্জন হয়না। আইডিয়ালি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ছাত্রদেরকে তর্ক করতে শিখানো উচিৎ। ছাত্ররা তর্ক করতে থাকলে ওদের জ্ঞান বাড়ে, ওদের এতনার মান বাড়ে আর ওরা গণতন্ত্র শিখে। কেননা তর্কই গণতন্ত্র আর গণতন্ত্র মানেই তর্ক। তাইলে কি দাঁড়ায় ব্যাপারটা? বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েরা তর্ক করবে তর্ক প্র্যাকটিস করবে। মানে? মানে ওরা রাজনীতি করবে, রাজনীতি পাঠ করবে, রাজনৈতিক ও দার্শনিক গ্রুপ বানাবে, দল বানাবে, দলে দলে তর্ক করবে, প্রতিযোগিতা করবে, নির্বাচন করবে সবকিছু করবে। কেউ উগ্র জাতীয়তাবাদী হবে, কেউ এনারকিস্ট হবে, কেউ মার্ক্সিস্ট হবে, কেউ ট্রটস্কিবাদি হবে, কেউ মাওবাদী হবে, কেউ মৌলবাদী হবে। সবই থাকতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে, ওরা ইন্টেলেকচুয়ালি এবং ডেমোক্রেটিক পন্থায় পরস্পরের সাথে মিথস্ক্রিয়া করবে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলির রাষ্ট্রের কাজ কি? রাষ্ট্র আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলি নিশ্চিত করবে যে ছেলেমেয়েরা যে এই চর্চাগুলি করতে পারে এবং নিঃসঙ্কোচে করতে পারে। এই জন্যে রাষ্ট্র ও বিশ্ববিদ্যালয় সযুগ করে দিবে, ছাত্র সংসদের নির্বাচন দিবে। ছাত্রদের বিছিন্ন গ্রুপ যাতে তাঁদের মতবাদ প্রচার করতে পারে সেই কাজে সাহায্য করবে। এইটাই ছাত্রদের জ্ঞান বিকাশের পথ- এবং দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরির পথ। পরীক্ষিত পথ। বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে যদি ছেলেমেয়েরা রাজনীতি না করে আর সেখানে যদি ছাত্ররা গণতন্ত্র চর্চা করতে না পারে সেটা বিশ্ববিদ্যালয় না। সেটাকে আপনি মাদ্রাসা বলতে পারেন, বড় বিদ্যালয় বলতে পারেন, সাবালকদের কিন্ডারগার্টেন বলতে পারেন- বিশ্ববিদ্যালয় না।

আপনার ছেলেকে বা মেয়েকে যদি এমন প্রতিষ্ঠানে পড়তে পাঠান যেটা নামে বিশ্ববিদ্যালয় বটে, কিন্তু কার্যত একটি মাদ্রাসা বা সাবালকদের কিন্ডারগার্টেন, আপনার সন্তান আর যাই হোক, জ্ঞান লাভ করবে না। সে বিশ্বাসের ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে, এইডসের ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে, সে একজন তস্কর হতে পারে বা চৌর্যবৃত্তি শিখতে পারে- কিন্তু যে গণতন্ত্র শিখবে না। স্যাঁতসেঁতে জায়গায় যেমন ছাতা জন্মায় এইসব জায়গায়ই জঙ্গি জন্মায়।

(৭) 
আর দুইটা কথা।

আপনি নিজে যদি অসৎ বা চোর হয়ে থাকেন, আপনার জ্ঞাত আয়ের উৎস যদি আপনার জীবনযাত্রার মানের সাথে না মিলে, তাইলে আপনি যতই পয়সা খরচ করেন, দেশে বিদেশে যেখানেই ছেলেকে বা মেয়েকে পাঠান, ছেলেমেয়ে মানুষ করা কঠিন। নানাকিছু শিখাতে পারেন ওদেরকে, কিন্তু ঐযে বলেছি, মানুষ পরিচয়, সেটা অর্জন করা ওদের জন্যে কঠিন হয়ে যাবে। চোরের ছেলে চোর আমাদের রাজনীতিতে আছে, এরকম বড় বড় তরুণ নেতা আপনারা চিনেন, মানুষ হিসাবে ওরা বড়ই নিকৃষ্ট।

আর আপনি নিজে যদি সাম্প্রদায়িক হন, বুকের ভেতরে সাম্প্রদায়িকতা পোষণ করেন, তাইলে আপনার ছেলের মুসলিম-সন্ত্রাসী হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশী। মানুষের মধ্যে এক ধরনের ট্রাইবাল অনুভূতি সুপ্ত থাকে- নিজের গোত্রের কেউ মন্দ কাজ করলেও আমরা সহজে নিন্দা করতে চাই না। বিদেশে কোন মুসলিম সন্ত্রাসী যখন ৭২জন মানুষ মেরে ফেলে, আমরা তখন ওকে সরাসরি সমালোচনা করি না। নিজের অজ্ঞাতেই নানারকম ডিফেন্সিভ কথা বলি। আপনি কিন্তু ছেলেকে সন্ত্রাসী হওয়ার জন্য উৎসাহ দিচ্ছেন। আপনি যদি ছেলে মেয়েকে শিখান যে, না, আমার ধর্মবিশ্বাসই শ্রেষ্ঠ, অন্যরা কাফের, কাফেররা খারাপ। তাইলে আপনি ছেলেমেয়েকে সন্ত্রাসী বানাচ্ছেন।

নিজেমানুষ হতে চেষ্টা করেন। আর একটু রাষ্ট্রের উপর চাপ তৈরি করতে চেষ্টা করেন। দেশের সর্বত্র গণতন্ত্র দরকার। না হলে এইগুলি ঠেকাতে পারবেন না। আজকে ছয়টা ছেলে ইসলামী-জঙ্গি মারা গেছে, কালকে আপনার ছেলে হবে। দেশে গণতন্ত্র দরকার- প্রকৃত গণতন্ত্র, সর্বত্র গণতন্ত্র- কেবল প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের গণতন্ত্র না। এইটা একটা বড় আলাপ আরেকদিন করি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত