বঙ্গবন্ধুকে তুলে রেখেছি আলমারি আর কাঁচের ফ্রেমে

প্রকাশ : ০৮ নভেম্বর ২০১৬, ১৬:২৯

(১) 
গাইবান্ধাতে সাঁওতালদের উপর যে বর্বরতা হয়েছে সেটা নিয়ে কি বলবো? ফেসবুকে না হয় একটা পোস্ট লিখলাম, আপনারা লাইক মারলেন। তাতে কী হবে? ঘোড়ার ডিম হবে। আমরা কি সভ্য দেশে আছি নাকি যে জনগণের রাগ ক্রোধ কিংবা ক্ষোভের কথা কেউ শুনবে? ছোট একটা জনগোষ্ঠী, যারা এই দেশের আদিবাসী, যারা এই ভূমিতে মানুষের বসবাস শুরুর লগ্ন থেকে ছিল, ওদেরকে আমরা ইচ্ছা হলেই ভিটামাটি থেকে তুলে দিচ্ছি। চাষের জমি কেড়ে নিচ্ছ। আর ওরা যদি তাতে একটু ট্যাঁ ফো করে তো পুলিশ পাঠিয়ে দিই, পুলিশের লোকেরা ইচ্ছামতো গুলি করতে থাকে। একটা ভিডিওতে দেখলাম ওদের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে আর লোকজন দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাচ্ছে।

বাড়িঘরে আগুন, লোকজন পালাচ্ছে। আর পুলিশকে দেখলাম বেশ কায়দা করে হাঁটু গেঁড়ে বসে কাঁধে রাইফেল রেখে, এক চোখ বন্ধ করে নিপুণ নিশানায় গুলি করছে কালো কালো সেই পলায়নপর মানুষগুলির দিকে। পুলিশটাকে দেখে বেশ লাগলো। আমাদের পুলিশ কতো স্মার্ট হয়েছে দেখেন, ভুঁড়ি নাই মেদ নাই, আর মানুষ মারে কী নিখুঁত দক্ষতায়! আর পুলিশেরই বা দোষ কী দিবেন। পুলিশ তো হুকুমের গোলাম। ওদেরকে নির্দেশ দিয়েছে, যে কোনভাবেই হক, মেরে হোক ধরে হোক এই সাঁওতালের বাচ্চাদেরকে উৎখাত করতে হবে।

আপনি ফেসবুকে এইসব নিয়ে পোস্ট লিখবেন? লিখে কী হবে? এই দেশে কোন আদিবাসীকে আমরা থাকতে দিব না। এখানে শুধু মুসলমানরা থাকবে। আপনি সংবিধান দেখাবেন? গুল্লি মারেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দেখাবেন? ভুলে যান সেইসব কথা। বঙ্গবন্ধুর দোহাই দিবেন? বঙ্গবন্ধুকেও আমরা তুলে রেখেছি আলমারিতে আর কাঁচের ফ্রেমে। ঐটা দেখিয়ে মানুষকে শুধু দলে ভিড়ানো হয়। ঐ নামটার আর কোন ব্যবহার নাই।

এইসব ফেসবুক পোস্টে কিসসু হবে না। যদি পারেন লড়াই করতে নামেন। না পারলে চুপচাপ দেখে যান।

(২) 
নামের শেষে হেমব্রম, মুরমু, সরেন বা মারদি পদবী আছে এরকম কারো কাছ থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেলে আমি সাধারণত চট করে সেটা একসেপ্ট করে ফেলি। এই পদবীগুলি সাঁওতালদের একেকটা গোত্রের নাম। সকলের মতোই সাঁওতালদের প্রতি আমার অসীম শ্রদ্ধা আর মুগ্ধতা। একারণে একজন সাঁওতাল তরুণ বা তরুণী যদি আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় (ভিন্নরকম কোন বিশেষ কারণ না থাকলে) আমি মহা আনন্দে সেটা গ্রহণ করি। এমনকি একজনও মিউচ্যুয়াল ফ্রেন্ড নাই সেরকম হলেও। সাঁওতালদের প্রতি এইরকম শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতা কেন? সাঁওতালদের সংগ্রামী ইতিহাসের জন্যে।

আপনি যদি কলোনিয়াল সময়ের শুরু থেকে এই উপমহাদেশে বিদ্রোহের ইতিহাস দেখেন, স্বাধীনতা ও অধিকারের জন্যে লড়াইয়ের ইতিহাস দেখেন, দেখবেন সাঁওতালরা সব সময়ই লড়েছে। লড়েছে কেবল যে নিজেদের অধিকারের জন্যে টা নয়, সকলের অধিকার ও মুক্তির জন্যেও সাঁওতালরা লড়াই করেছে ন্যায়ের পক্ষে। তেভাগা আন্দোলনের কথা সকলেই জানেন, ইলা মিত্রের নামও জানেন। সেই আন্দোলনে নাচোলের সাঁওতালরা লড়াই করে কতজন যে প্রাণ দিয়েছে ওঁদের নাম হয়তো আমরা জানিনা।

কারা এই সাঁওতালরা? এই সাঁওতালরা হচ্ছে আমাদের এই ভূমিতে আদিবাসী। আদিবাসী শব্দটা নিয়ে নানাপ্রকার অস্বস্তি আছে আমাদের সরকার ও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মধ্যে। সে যতপ্রকার অস্বস্তিই থাক না কেন, সাঁওতালরা যে এই ভূমিতে আদিবাসী সেটা নিয়ে আর তর্ক করতে পারবেন না আরকি। আদিবাসী শব্দটির যতরকম অর্থ আছে সব অর্থেই সাঁওতালরা এদেশের আদিবাসী। এখন সংখ্যায় কমেছে। কালের যাত্রায় ওদের বেশীরভাগ খৃস্ট ধর্ম গ্রহণ করেছে। সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন এসেছে অনেক- সে তো আসবেই, সংস্কৃতি কথাটিতেই তো পরিবর্তন অন্তর্ভুক্ত।

সংখ্যায়ও ওরা দিনে দিনে লঘু থেকে লঘুতর হয়েছে। কিন্তু সবকিছুর পরেও এই সত্যটি থেকেই যায়- সাঁওতালরা এদেশের আদিবাসী। সব অর্থেই আদিবাসী। আক্ষরিক অর্থেও, কনভেনশনের সংজ্ঞায়ও। সাঁওতালরা হচ্ছে আমাদের এখানে ভূমিপুত্র।

(৩) 
এই আদিবাসীদের সাথে আমরা যেরকম আচরণ করছি সেটা বর্বরতা। অন্যায়। অপরাধ। সংখ্যায় কম বলে আর সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের সাথে সাংস্কৃতিক ভিন্নতার কারণে ওরা অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদই রয়ে গেছে। বেশিরভাগই চাষবাস করে, জমিতে কাজ করে কোনওরকমে দুইবেলা খাবার জোটায়। লজ্জার ব্যাপার হলো, আমরা বাঙালিরা পণ করেছি এইসব আদিবাসীদেরকে আমরা এই দেশে বেঁচে থাকতে দিব না। আমাদের কাজকর্ম দেখে যে কেউই বলতে পারবেন, আমরা এইসব ভূমিপুত্রদের নিজ ভূমি থেকে উৎখাত করেই ছাড়বো ইনশাল্লাহ।

প্রথমে একত্ব একথা বুঝেন। এই দেশে, এই বদ্বীপটাতে সবার আগে যারা বসবাস করা শুরু করেছিল সাঁওতালরা সম্ভবত ওদের মধ্যেই পরে। যারা নৃতত্ব পড়েছেন ওরা ভাল করে বলতে পারবেন। ওরা তো অনাদিকাল থেকেই এই ভূমিতে বাস করছে, এই ভূমি ব্যবহার করে আসছে। ওদেরই তো ভূমি। আপনারা বাবুরা তো পরে গজিয়েছেন। পরে সাহেবরা এসেছেন কাগজপত্র বানিয়েছেন, জমি ভাগাভাগি লেখালেখি করেছেন। আরে যারা আদি থেকে ছিল ওদের আবার কাগজ কিসের? আপনারা নিজের আনিজের কীসব কাগজপত্র বানিয়ে জমির মালিককে বলবেন হটো! এইটা কি ধরনের সভ্য আচরণ সেটা আমাকে একটু বুঝিয়ে বলেনে।

গাইবান্ধায় এই সাঁওতাল পরিবারগুলি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এখানে বসবাস করছে। এইসব ভূমি নাকি সরকার অধিগ্রহণ করেছে। যতটুকু জেনেছি এইসব জায়গায় চিনিকলের জন্যে আখ চাষ হবে বলে অধিগ্রহণ করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সেখানে আখ চাষ হয়নাই। চিনিকলও নাকি কিছুদিন চলেছে কিছুদিন চলেনি এই অবস্থা। বিস্তারিত জানিনা, সম্ভবত সম্প্রতি এই চিনিকলটি বেসরকারি মালিকানায় দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাঁদেরকে চিনিকল দিয়ে দিয়েছে ওদের জন্যে ভূমি উদ্ধারের নামে সাঁওতাল পরিবারগুলিকে উচ্ছেদের পাঁয়তারা চলেছে বেশ কিছুদিন ধরে। তারই চূড়ান্ত পর্যায় হচ্ছে এই ঘটনা।

পুলিশ গিয়েছে। সাথে গুণ্ডা পাণ্ডা ধরনের লোক গেছে ট্রাক ভর্তি করে। সাঁওতালদের বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে বানানো কাঁচা ঘর। সেইসব ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। যে কয়েকজন একটু বাধা দিতে এসেছে ওদেরকে গুলি করে তাড়ানো হয়েছে। বাহ, জমি দখল করার কি অভিনব কিন্তু মোক্ষম পদ্ধতি।

(৪) 
ভাই একটু তো চিন্তা করবেন, নাকি? এই দরিদ্র সাঁওতালরা কোথায় বাস করবে? এখানে বাড়িঘর করে থাকতো, এখন কোথায় যাবে? এখানে একটু চাষবাস করে খাবার জোগাড় করতো, এখন এই পরিবারগুলি কী করবে? ছয়শর মতো পরিবার, এইভাবে আগুন দিয়ে বাড়িঘর পুড়িয়ে ওদের তাড়ালেন। ওরা এই দেশের মানুষ না? ওদের অন্ন বস্ত্র শিক্ষা চিকিৎসা বাসস্থানের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব না? ভাত দেওয়ার মুরদ নাই, কিল মারার গোঁসাই!

মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটা মহান প্রজাতন্ত্র বানিয়েছি। প্রজাতন্ত্র পত্তনের সময়ই তো সংবিধানে ঘোষণা দেওয়া আছে এই রাষ্ট্রটি এইসব মানুষের অন্ন বস্ত্র শিক্ষা চিকিৎসা বাসস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাবে। এই হচ্ছে সেই কাজ? এইটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা? সাঁওতালরা তো আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকজনের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিল। এইজন্যে করেছিল? ইংরেজ শাসকের পরিবর্তে বাঙালি নিপীড়ক চেপে বসেছে ওদের কাঁধের উপর। তাইলে ওদের স্বাধীনতা এসেছে? স্বাধীনতা স্বাধীনতার চেতনা এইসব কি কেবল বাঙালি মুসলমানের জন্যে?

কেউ যদি বলতে চান যে এইসব জায়গা একোয়ার করার সময় ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছিল তাইলে বলবো যে, ভাই আমাকে মাফ করেন। এইসব ক্ষতিপূরণের টাকার কথা আমার কাছে বলতে আসবেন না। ক্ষতিপূরণের টাকার মহিমা আমরা কাপ্তাই বাঁধের সময় দেখেছি। সাম্প্রতিক ইতিহাসে ভারতে নর্মদা বাঁধের ঘটনা সহ বিভিন্ন সময় এইগুলি নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। ক্ষতিপূরণের ঐ কয়েকটা টাকার মূল্যে জীবন জীবিকা চালানোর একমাত্র উপায় ঐ কয়েকটুকরা জায়গার মূল্য হয়না। আর অন্য সব বিষয় না হয় বাদই দিলাম। এইভাবে মানুষকে মানুষ উচ্ছেদ করে? বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে, মানুষের উপর গুলি চালিয়ে?

(৫) 
সঞ্জীব দ্রং একটা বই লিখেছেন ‘বাংলাদেশে বিপন্ন আদিবাসী’ এই নামে। এই বইতে সঞ্জীব দ্রং লিখছেন নাচোলের কাছাকাছি একটা সাঁওতাল গ্রামে একদিন তিনি শুনতে পেলেন এক আদিবাসী মেয়ে গান করছে, ‘যদি রাত পোহালে শুনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই’। সঞ্জীব দ্রংএর মনে প্রশ্ন, এই মেয়েটি যে গানটি গাইছে এই গানটির অর্থ কি সে জানে? বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আদিবাসীরা কি আজকের মতো এতোটা অসহার অবস্থায় থাকতো?

বঙ্গবন্ধুর নাম করে দল চালান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে সরকার চালান। এইরকম করে মানুষের উপর অত্যাচার করার জন্যে? মানুষের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে উচ্ছেদ করা, এই ক্ষমতা আপনাকে কে দিয়েছে?

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত