কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়

প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০১৭, ১২:২২

পঞ্চাশ দশকের প্রধান কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তাঁর জন্ম পঁচিশে নভেম্বর ১৯৩৪। প্রথম জীবনে গল্প রচনা করতেন স্ফুলিঙ্গ সমাদ্দার ছদ্মনামে। ‘কবিতা’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকাকে ঘিরে তাঁর খ্যাতি লাভ।

তাঁর প্রথম পর্বের কবিতায় নিয়ম শাসিত জীবনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, নিয়ম ভাঙ্গা জীবন যাপনের গৌরবায়ণ দেখতে পাওয়া যায়। সেই সময় হাংরি জেনারেশন বা হিংরিয়ালিস্ট আন্দোলন -এর নেতৃত্বে দেখা যায়। তবে তাঁর জীবনের পরবর্তী পর্বে এই উত্তালতা স্তিমিত হয়ে আসে। 

১৯৬১ সালের নভেম্বরে ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে যে চারজন কবিকে হাংরি আন্দোলনের জনক মনে করা হয় তাঁদের মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় অন্যতম । অন্য তিনজন হলেন সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায় এবং মলয় রায়চৌধুরী। শেষোক্ত তিনজনের সঙ্গে সাহিত্যিক মতান্তরের জন্য ১৯৬৩ সালে তিনি হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীতে যোগ দেন । তিনি প্রায় ৫০টি হাংরি বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন। পরবর্তীকালে কৃত্তিবাসের কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নাম সাহিত্যিক মহলে একত্রে উচ্চারিত হতো, যদিও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হাংরি আন্দোলন-এর ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং কৃত্তিবাস পত্রিকায় ১৯৬৬ সালে সেই মনোভাব প্রকাশ করে সম্পাদকীয় লিখে ছিলেন ।

বন্ধুত্ব, নারী, মানব সংসর্গ, জীবনের আনন্দ ও ব্যর্থতা বোধ নিয়ে শক্তি’র কবিতা। প্রকৃতির প্রতি তীব্র আকর্ষণ, নারীর ভালবাসা প্রভৃতি তাঁর কাব্য জগতের প্রধান উপকরণ। তাঁর নিজস্ব ছন্দস্পন্দ এবং বলিষ্ঠ ভাষা তাঁকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। শক্তির যখন তিরিশ, তার একটু আগে থেকেই বীরভূমে তাঁর আসা যাওয়া বেড়ে গেল। অনিবার্য গন্তব্য হয়ে উঠল ভুবনডাঙা-শান্তিনিকেতন। কখনও রামকিঙ্করের ডেরা। কখনও সিউড়ির অনতিদূরে কেঁদুয়া।

সুলতানপুর ইস্কুলের পিওনের চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ততদিনে নবনী দাস বাউল আখড়া গেড়েছেন কেঁদুয়াতে। সেই আখড়ায় দিনের পর দিন পড়ে থেকেছেন শক্তি। দাওয়ায় বসে নবনী গান ধরেছেন লালনের, ‘‘সময় গেলে সাধন হবে না/ দিন থাকতে দীনের সাধন কেন জানলে না…।’’ চুর হয়ে শুনছেন শক্তি কবিয়াল। গান শেষে আড় ভাঙে কবির। আশমান-উপুড় ভাল লাগায় জড়িয়ে ধরেন নবনীকে। তাঁকে নিয়ে ‘এলেজি’ও লেখেন। জয়দেব-কেঁদুলির মেলায় বাউলরাও প্রায় সকলেই শক্তিকে চিনতেন। তাঁর স্বজন ছিলেন তাঁরা। শুধু মুখচেনা নয়, শক্তি তাঁদের ঘর গেরস্থালির খবরও রাখতেন। কখনও বা জানুয়ারির রাত্তিরে হাড় হিম করা ঠাণ্ডায়, অজয়ের নদীগর্ভে বসে গীতবিতান উজাড় করে শক্তি একের পর এক রবিঠাকুর গাইছেন। কখনও মধ্যরাত কাঁপিয়ে তাঁর দরাজ গলায় খাম্বাজে ধরেছেন- 'আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়'- এখনও ভোলেনি কেঁদুলির গাঁ-ঘর, বাউল-বসতি!

১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫। এই তিন বছর, শক্তির দোস্ত আয়ান রশিদ খান ছিলেন বীরভূমের পুলিশ সুপার। এই সময়ের সিংহভাগ শান্তিনিকেতন, সিউড়ি, দুবরাজপুর, জয়দেব, রামপুরহাটে কেটেছে শক্তির। তাঁর সঙ্গে কখনও সঙ্গ দিয়েছেন সন্দীপন-ইন্দ্রনাথ, কখনও সুনীল। কখনও একা।

রশিদের সঙ্গে গালিব-তর্জমায় মেতেছিলেন শক্তি। প্রকাশিত হয় ‘গালিবের কবিতা’। বইয়ের ভূমিকায় শক্তি লিখছেন, "আজ বছর দেড়েক হলো। এখনো হালে পানি পাওয়া যায়নি। যাবে কী করে? দুরন্ত দিনপঞ্জী বশে এনে তবেই গালিব-তর্জমা! ... বাসে অর্থ খেলো। আমোদে খেলো শতগুণ।" শেষে বোলপুর ট্যুরিস্ট লজ। শান্তিনিকেতনের নিভৃতিতে একদিন শেষ হল অনুবাদের কাজ। শক্তি তত দিনে গালিবে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছেন।

 রশিদ সেই সময়ের শক্তির কথা বলতে গিয়ে লিখছেন, "দেখেছিলাম গালিবের প্রতিটি পঙক্তি কীভাবে তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। শক্তি-গালিব বা গালিব-শক্তি একাকার হয়েছিল তার অনুবাদে :
কাঁদতে কাঁদতে ফুরিয়ে যাওয়া এমন সহজ আমার কাছে
যেমন সহজ মেঘ ঘনালে ছটফটিয়ে বৃষ্টি বাজে।"

১৯৭৫ সালে সালে শক্তি চট্টোপাধ্যায় আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত হন এবং ১৯৮৪ তে পান সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। ২৩ মার্চ ১৯৯৫ সালে তাঁর আকস্মিক অকালপ্রয়াণের সময় তিনি বিশ্বভারতীর অতিথি অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। শক্তি নিজের কবিতাকে বলতেন পদ্য।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত