ভয়াল ১২ নভেম্বর আজ

প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০১৮, ১১:৫৮

সাহস ডেস্ক

ভয়াল ১২ নভেম্বর আজ। ১৯৭০ সালের এই দিনে মহাপ্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছিল। সেই স্মৃতি বয়ে আজও যারা বেঁচে রয়েছেন কিংবা স্বজনদের হারিয়েছেন, কেবল তারাই অনুভব করেন সেদিনের ভয়াবহতা। ১০ ফুট উচ্চতার এই জলোচ্ছ্বাসে সেদিন স্রোতের টানে ভেসে যায় কয়েক লাখ মানুষ, গবাদি পশু ও ঘরবাড়ি। ক্ষতিগ্রস্থ হয় হাজার হাজার একর ফসলী জমি। লণ্ড ভণ্ড হয়ে যায় উপকূলীয় এলাকার বিস্তৃীর্ণ জনপদ।

সত্তরের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের পর মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধ্বংসযজ্ঞ ও বেদনাহতদের দেখতে যান, এসব দৃশ্য দেখে শোকবিহ্বল হয়ে পড়েন।

ধারণা করা হয়, সেই দুর্যোগে প্রায় ১০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। এর মধ্যে ভোলা জেলাতেই লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বিরান হয় অসংখ্য জনপদ। সেদিন উত্তাল মেঘনা নদী আর তার শাখা-প্রশাখাগুলো রূপান্তরিত হয় লাশের নদীতে। বলা হয়, এটাই ছিল দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাস। সেদিন ভোলা ছাড়াও উপকূলীয় হাতিয়া, রামগতি, চর আবদুল্লাহ, সন্দ্বীপ, বরগুনা, পটুয়াখালী ও চট্টগ্রামে ছিল ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের স্বাক্ষর।

তৎকালীন পূর্বদেশ পত্রিকার ভোলা প্রতিনিধি ও বর্তমান দৈনিক বাংলার কণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক এম হাবিবুর রহমান প্রেরিত সচিত্র প্রতিবেদন ছিল ‘বাংলার মানুষ কাঁদো ॥ ভোলার গাছে গাছে ঝুলছে মানুষের লাশ’। আর এ সংবাদ বিশ্ব জানতে পেরেছিল চার দিন পর। সেই চিত্রটি আজও ঢাকা প্রেস ইনস্টিটিউট-এ কালের সাক্ষী হিসেবে বাঁধানো রয়েছে।

স্মরণকালের ভয়াবহ এই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে লক্ষ্মীপুরের উপকূলীয় এলাকার সবকিছু লণ্ড ভণ্ড হয়ে যায়। উত্তাল ঢেউয়ের প্রবল স্রোতে রামগতি উপজেলার শেখেরকিল্লা, গুচ্ছ গ্রাম, চর আবদুল্লাহ, চর জাহাঙ্গীর, কমলনগর উপজেলার সাহেবের হাট, মাতাব্বর হাট, চর জগবন্ধু, চর সামছুদ্দিন, চর কাঁকড়া ও সদর উপজেলার চর মনসা, বয়ারচর, চর রমনী মোহন এলাকার লাখ লাখ মানুষ, গবাদি পশু ও হাজার হাজার একর জমির ফসলসহ ঘরবাড়ি ভেসে যায়।

চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ। এসব লাশের গন্ধে মানুষ কাছে যেতে পারেনি। ৩-১০ ফুটের জলোচ্ছাসে কবর দেয়া যায়নি মৃত মানুষগুলোকে। সেই দিনের ভয়াবহ স্মৃতি মনে পড়লে আজও আঁতকে উঠে উপকূলের মানুষ। তিন যুগেরও বেশী আগের স্মৃতি এখনও জ্বল জ্বল হয়ে আছে স্বজন হারানোদের মাঝে। এখনও সে ভয়াল কাল রাতের কথা মনে পড়লে ভয়ে শিউরে ওঠেন তারা।

কমলনগর উপজেলার চর জাঙ্গালীয় গ্রামের মো. সিরাজ উদ্দিন জানান, ৭০ সালের সেই রাতে প্রচণ্ড ঝড় হয়। ছোট বড় অসংখ্য ঘরবাড়ি ও গাছপালা বিধস্ত হয়ে যায়। পানির স্রোতে ভেসে যায় গবাদী পশুসহ হাজার হাজার মানুষ। অনেকে প্রিয়জনের লাশটুকুও খুঁজে পায়নি। আজও সেই দিনটার কথা মনে পড়লে মানুষ শিউরে উঠে।

একই গ্রামের বৃদ্ধ আবুল কালাম সেই রাতের স্মৃতিচারণ করে জানান, তার বাড়ির আশেপাশের অনেক লোকসহ তার কয়েকজন নিকট আত্মীয় প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও পানির প্রবল স্রোতে ভেসে গেছে। যাদের মধ্যে অনেকের লাশও পাওয়া যায়নি। এ স্মৃতি মনে করে কেঁদে ফেলেন তিনি।

প্রখ্যাত সাংবাদিক মরহুম এম সানাউল্লাহ্ নূরী তখন দৈনিক বাংলায় (প্রাক্তন দৈনিক পাকিস্তান ) সিনিয়র সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করছিলেন।

তিনি লেখেন, (সত্তরের জলোচ্ছ্বাসের পর) ‘আমরা  রামগতি বাজারের নিকটবর্তী চর এলাকায় পৌঁছালাম। সেখানে স্তূপীকৃত লাশ এবং মৃত গবাদিপশুর যে হাল দেখলাম, তা ভাষায় অবর্ণনীয়। রামগতি বাজারের একজন শৌখিন ফটোগ্রাফার আমাকে ফুলের মতো ফুটফুটে চারটি শিশুর ছবি দিয়েছিলেন। সেটি আমি ছেপেছি দৈনিক বাংলায়।’

তিনি আরো লেখেন, ‘আমি আমার পত্রিকার বিশেষ সংবাদদাতার দায়িত্ব নিয়ে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে থেকে একটানা কয়েক দিন ঢাকায় দৈনিক বাংলার জন্য রিপোর্ট পাঠাচ্ছিলাম। এতে কাগজের প্রচার সংখ্যা ত্রিশ হাজার থেকে এক লাখে উঠেছিল। চট্টগ্রামে সে সময় এক টাকা দামের কাগজ পাঁচ-ছয় টাকা বিক্রি হচ্ছিল। আমরা চর বাদাম, চর সীতা এবং চর জব্বরে ধানখেতগুলোতে নাকেমুখে লোনা পানি লেপ্টানো হাজার হাজার লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখেছি। সাগরে ভাসতে দেখেছি অসংখ্য লাশ। রামগতি, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, ভোলা ও পটুয়াখালী পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে। একটি গাছের ৩০ ফুট উঁচু মাথায় অসহায় দুর্গত কুকুরকে দেখেছি হাহাকার করতে। কোথাও পানি উঠেছে ৪০ ফুট ওপরে। গোটা উপকূল অঞ্চলে প্রায় অর্ধকোটি লোক মৃত্যুবরণ করেছে। ১২৮৩ সালের গোর্কির চেয়ে বহুগুণে করুণ এবং ভয়াবহ ছিল ’৭০ সালের গোর্কি। এর ধ্বংসলীলা তো আমরা নিজের চোখেই দেখেছি। সারা দুনিয়ায় সংবাদপত্রের প্রধান সংবাদ হয়েছিল এই প্রলয় ভয়াল দুর্যোগের খবর।’

ভয়াল ১২ নভেম্বরকে জাতীয় দুর্যোগ দিবস ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন উপকূলবাসী।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত