তিন সিকিউরিটিজ হাউসের ৩৩৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ

প্রকাশ : ২১ জুলাই ২০২৩, ১০:৪৫

শাহীনুর ইসলাম
ছবি: দৈনিক সাহস

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তালিকাভুক্ত শেয়ার লেনদেনকারী ৩টি ব্রোকারেজ হাউসের মালিক প্রায় ৩৩৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ৩৪ হাজার ৬৮৬টি বেনিফিশিয়ারি ওনার্সের (বিও) মধ্যে ১১ হাজার ৩৬৪ হিসাব থেকে টাকা লোপাট করার প্রমাণ পেয়েছে ডিএসই। বাকি বিও হিসাবগুলো তদন্তের অপেক্ষায় রয়েছে। 
 
ক্রেস্ট, তামহা ও বানকো সিকিউরিটিজের মালিক বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করেন। ইতোমধ্যে সিকিউরিটিজ হাউসের মালিকদের অনেকে দেশের বাইরে গা-ঢাকা দিয়েছেন। ডিএসই তাদের বিরুদ্ধে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে না পারায় এখনো প্রায় ৫ হাজার বিনিয়োগকারীর টাকা ফেরত আসেনি। যদিও আত্মসাতের ঘটনা ফাঁসের পর প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করেছে ডিএসই। ঘটনায় অভিযুক্তদের আটক করা হলেও এখন জামিনে রয়েছেন তারা। 

তিনটি ব্রোকারেজ হাউসের ১১ হাজার ৩৬৪ হিসাব থেকে গ্রাহকের নগদ জমা ২০৪ কোটি টাকা এবং শেয়ার বিক্রি করে ১২৯ কোটি টাকা নেন আসামিরা।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম দায়িত্ব নেয়ার মাত্র দুই মাসের মধ্যে প্রথম আত্মসাতের এ ঘটনা ঘটে। ক্রেস্ট সিকিউরিটিজের মালিক মো. শহিদুল্লাহ ও তার স্ত্রী নিপা সুলতানা নূপুর গ্রাহকদের প্রায় ৬৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে গা-ঢাকা দেন। এর মধ্যে গ্রাহকের নগদ জমা ছিল প্রায় ৪৪ কোটি টাকা এবং শেয়ার বিক্রি করে আত্মসাৎ করেন আরো ২১ কোটি টাকা।

এরপরে ক্রেস্ট সিকিউরিটিজের মালিক মো. শহিদুল্লাহ ২০২০ সালের মে মাসে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার বিনিয়োগকারীর ৬৫ কোটি টাকা নিয়ে সস্ত্রীক পালিয়ে যান।

অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) দায়িত্ব নেয়ার মাত্র দুই মাসের মধ্যে ঘটে এ ঘটনা। এর পর কিছু বিনিয়োগকারী এক কোটি ৩৬ লাখ টাকা ফেরতও পান। বাকিরা টাকা খোয়ানোর ব্যথা এখনো ভুলতে পারেননি। তিন ব্রোকারেজ হাউসের প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার বিনিয়োগকারীর লোপাট হওয়া ৩৩৩ কোটি টাকার মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৬ কোটি টাকা ফেরত এসেছে। 

টাকা ফেরত পেতে বিএসইসি ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) বিনিয়োগকারীরা বারবার ধরনা দিলেও হারানো টাকা আর তাদের পকেটে আসছে না। তারা আদৌ হারানো টাকা ফেরত পাবেন কিনা, সে বিষয়ে কেউ নিশ্চয়তা দিচ্ছে না।

কত টাকা আত্মসাৎ

ক্রেস্ট, তামহা ও বানকো সিকিউরিটিজে বিনিয়োগকারীদের মোট ৩৪ হাজার ৬৮৬টি বিও হিসাব ছিল। এর মধ্যে ১১ হাজার ৩৬৪ বিও হিসাব থেকে মোট ৩৩৩ কোটি টাকা লোপাটের প্রমাণ মিলেছে। এর মধ্যে গ্রাহকের নগদ জমা ছিল ২০৪ কোটি টাকা আর শেয়ার ছিল ১২৯ কোটি টাকার।

ক্রেস্ট সিকিউরিটিজের মালিক মো. শহিদুল্লাহ ও তার স্ত্রী নিপা সুলতানা নূপুর গ্রাহকদের ৬৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে গা-ঢাকা দেন। এর মধ্যে গ্রাহকের নগদ জমা ছিল ৪৪ কোটি টাকা এবং শেয়ার বিক্রি করে আত্মসাৎ করেন আরো ২১ কোটি টাকা।
বানকোর সিকিউরিটিজের প্রধান শফিউল আজম মুন্না ২০২১ সালের জুনে চার হাজার ১৩৪ বিনিয়োগকারীর নগদ ৬৬ কোটি টাকা এবং তাদের কেনা শেয়ার বিক্রি করে ৬২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। ক্রেস্টের ঘটনার ঠিক এক বছর পর এই ঘটনা ঘটান শফিউল আজিম মুন্না।

তামহা সিকিউরিটিজের ৭২৮ বিনিয়োগকারীর হিসাবের নগদ জমাসহ শেয়ার আত্মসাৎ হয়েছে ১৪০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির মূল মালিক ডা. হারুনুর রশীদের এখানে কিছু বেনামি অ্যাকাউন্টও রয়েছে। ওই অ্যাকাউন্টগুলো বাদ দিলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীর অন্তত ৭০ কোটি টাকা মেরে দেন ডা. হারুন। বানকো সিকিউরিটিজের ঘটনার তিন মাস পর তামহা সিকিউরিটিজে এ ঘটনা ঘটে।

ডিএসইর বক্তব্য

টাকা ফেরত প্রসঙ্গে ডিএসইর প্রধান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা (সিআরও) খায়রুল বাশার বলেন, স্টক এক্সচেঞ্জ কাউকে বেঁধে আনতে বা টাকা ফেরত দিতে বাধ্য করতে পারে না। আইনেই আমাদের হাত-পা বাঁধা। ডিএসইর দায়িত্ব ছিল, টাকা আত্মসাতের তথ্য পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউসের শেয়ার লেনদেন স্থগিত করে তদন্তে নামা। এ দায়িত্ব আমরা পালন করেছি।

এদিকে, বিএসইসির পক্ষে ডিএসইর ইনভেস্টর প্রটেকশন ফান্ড থেকে ২০ কোটি টাকা দিতে নির্দেশনা দেয়া হয়। ক্ষতিগ্রস্তদের এভাবে এই ফান্ড থেকে টাকা দেয়া যায় কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুর রহমান মজুমদার জানান, আইনি প্রক্রিয়া ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত দেয়ার চেষ্টা চলছে। এ ক্ষেত্রে ধীরগতির অভিযোগ স্বীকার করে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউসের মালিকরা ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা পরিশোধে রাজি হয়েছেন। এ নিয়ে কাজ করছে ডিএসই।

ক্রেস্ট, বানকো ও তামহা সিকিউরিটিজের কিছু গ্রাহকও প্রভাবশালী বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের জোরে টাকা উদ্ধারে চেষ্টা করছেন।

বিএসইসির মতামত 

বিএসইসির কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, বিনিয়োগকারীকে সুরক্ষা দেয়া স্টক এক্সচেঞ্জ এবং বিএসইসি উভয়ের দায়িত্ব। বিনিয়োগকারীর অর্থ আত্মসাৎ একটি অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়। ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে আর না হয়, সে বিষয়ে নজরদারি আগের চেয়ে বহু গুণ বাড়ানো হয়েছে।

কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে

অর্থ আত্মসাতের তথ্য পাওয়ার পর ২০২০ সালের ৬ জুলাই রাতে ক্রেস্ট সিকিউরিটিজের মালিক শহিদুল্লাহ, তার স্ত্রী নিপা সুলতানা নূপুর ও শ্যালক জাহিদুল ইসলামকে লক্ষীপুর থেকে আটক করা হয়। এর পরই বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) শহিদুল্লাহর অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করতে সব ব্যাংককে চিঠি দেয়।

ঘটনায় ব্রোকারেজ হাউসটির অপর পরিচালক মো. ওহিদুজ্জামানকে ওই বছরের ২৭ জুলাই রাজধানীর খিলক্ষেতের লেকসিটি থেকে আটক করে পুলিশ। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিচালক মো. রফিকুজ্জামান তদন্ত শেষে পৌনে তিন বছর পর গত ১৩ মার্চ ডা. হারুনসহ প্রতিষ্ঠানটির ১৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। আসামিরা এখন জামিনে রয়েছেন।

বানকো সিকিউরিটিজের ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান প্রবাসী আবদুল মুহিতকে লন্ডনে যাওয়ার সময় বিমানবন্দর থেকে ২০২১ সালের জুলাইয়ে আটক করে দুদক। এ ঘটনায় এ সংস্থার উপপরিচালক নুর আলম সিদ্দিকী বাদী হয়ে আবদুল মুহিতসহ বানকোর আরো চার পরিচালক শফিউল আজম, ওয়ালিউল হাসান চৌধুরী, নুরুল ঈশাত সাদাত ও মুনিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় মামলা করেন। তারাও এখন জামিনে।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, টাকা আত্মসাতের ঘটনার নেপথ্যের মূল হোতা মুহিতের ভাগ্নে ব্রোকারেজ হাউসটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আজম। এ ঘটনার পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) শফিউল আজম ও তাঁর স্ত্রী বুশরা চৌধুরীর ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে সব ব্যাংককে চিঠি দিয়েছিল। পরে তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়।

টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ক্রেস্ট ও বানকোর মালিকদের কয়েকজন গ্রেফতার হলেও সর্বশেষ তামহার ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির মালিক এখনো বহাল তবিয়তে আছেন। মূল মালিক ডা. হারুনুর রশীদ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার পারিবারিক সম্পদ বিক্রি করে টাকা ফেরত দেবেন।

ডিএসইর তথ্যানুযায়ী, এখন পর্যন্ত মাত্র পাঁচ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছেন তিনি। ডিএসইর মাধ্যমে প্রকৃত দাবির ১৫ শতাংশ করে টাকা পেয়েছেন ভুক্তভোগীরা। এর বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বিএসইসির চেয়ারম্যানের মধ্যস্থতায় প্রকৃত দাবির তুলনায় সামান্য ছাড় দিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ১৯ কোটি টাকা নিয়েছেন।

কোন পথে টাকা উদ্ধার

বিনিয়োগকারীদের অর্থ আত্মসাৎকারীদের প্রত্যেকের যে সম্পদ রয়েছে, তা বিক্রি করে টাকা ফেরত সম্ভব। তামহা সিকিউরিটিজ বিক্রি করে দিতে এরই মধ্যে ২৫ কোটি টাকার একটি চুক্তি আছে। গুলশানের জমিটি বিক্রির পর এখন লালমাটিয়া ও সাভারের জমি রয়েছে। গত মে মাসের শুরুতে বিএসইসির চেয়ারম্যানের মধ্যস্থতায় লালমাটিয়ার জমিটি ডিএসইর মাধ্যমে প্রস্তাব দেয়া হয়। তবে বিএসইসি এ কাজ ডিএসইকে করতে বলেছে। ডিএসই এখনো এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়নি।

বানকোর গ্রাহকদের টাকা আত্মসাৎকারী শফিউল আজমের সুব্রা ফ্যাশনস, অ্যামুলেট ফার্মাসিউটিক্যালস, বানকো পাওয়ার, বানকো এনার্জি সল্যুশনস, ক্ল্যাসিক ফুড ল্যাব, সামিট প্রপার্টিজ নামে বেশ কিছু কোম্পানি রয়েছে। এরই মধ্যে সুব্রা আইটি বিক্রি করেছেন। কোম্পানিটিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন।

এ ছাড়া ক্রেস্ট সিকিউরিটিজের মালিক শহিদুল্লাহর আত্মসাৎ করা টাকায় শ্যালক জাহিদুল ইসলাম জুয়েলের মাধ্যমে অন্যের জমি দখল করে লক্ষীপুরে বিশাল খামার গড়ার অভিযোগ আছে। এ ছাড়া ঢাকায় বেশ কিছু ফ্ল্যাট কিনেছেন বলেও জানা যায়। চাইলে এসব সম্পদ বিক্রি করে গ্রাহকদের টাকা উদ্ধার সম্ভব বলে মনে করেন ভুক্তভোগীরা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত