প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

আবুল হুসেন

প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০১৮, ১৩:০৯

১.
অবিভক্ত বাংলার প্রথিতযশা প্রাবন্ধিক, সমাজ সংস্কারক, চিন্তাবিদ ও দার্শনিক আবুল হুসেন। সাহসী মানুষ আবুল হুসেন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৩৮ সালের ১৫ অক্টোবর কোলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’-এর উজ্জ্বল শিখা, ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজের’ প্রাণপুরুষের প্রয়াণদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। বাঙালি মনীষা আবুল হুসেন ছিলেন বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের পুরোধা। এই বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন প্রতিভাত হয় বাংলার দ্বিতীয় জাগরণ বলে। সেই জাগরণের প্রধান কাণ্ডারী ছিলেন আবুল হুসেন। অসাধারণ পাণ্ডিত্য, স্বাধীন ও নির্ভীক চিন্তার অধিকারী আবুল হুসেন ছিলেন স্বল্পায়ু। মাত্র ৪২ বছর বেঁচে ছিলেন। যেন ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়ে অতিদ্রুত নিজের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করে হঠাৎ বিদায় নিলেন। উল্লেখ্য যে, আবুল হুসেন ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ৬ জানুয়ারি যশোর জেলার পানিসারা গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। মুক্তচিন্তা, মননশীলতা ও প্রগতিশীলতার সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের পরিচয় করিয়ে দেয়ার ব্যাকুল উদ্যোগ ছিল তার। মানবকল্যাণ, সমাজহিত, নীতিবোধ, স্বাবলম্বন ও সুন্দর মনের পরিচর্যা আবুল হুসেনের মানস-বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত ছিল।

২.
‘সত্য যে কঠিন / কঠিনেরে ভালোবাসিলাম / সে কখনো করে না বঞ্চনা’- রবীন্দ্রনাথের এই আপ্তবাক্যই ছিল ‘শিখা’র প্রাণপুরুষ আবুল হুসেনের জীবনদর্শন। অপ্রিয় সত্য কথনে এবং উদ্ধত সাহসিকতা প্রদর্শনে তাঁর সমকালে তিনি ছিলেন তুলনাহীন। আবুল হুসেনের এই সাহসী উচ্চারণ যে সর্বদা সুবিবেচনার পরিচায়ক ছিল তা হয়ত নয়। কিন্তু এ কথা মানতেই হবে তার সততা ও সাহসিকতা ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে’ গতিসঞ্চার করেছিল বিতর্কের সূত্রপাত ঘটিয়ে। স্বাধীন যুক্তিবাদী ও মুক্তচিন্তা চর্চা তখনো এদেশে সহজ ছিল না, এখনো নেই। এ কারণেই অধ্যাপক আহমদ শরীফ আবুল হুসেন সম্পর্কে বলেছিলেন, 'শিখা আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ ছিলেন আবুল হুসেন। তিনি সংস্কারক বিবেকবান পুরুষ তাই তাঁর স্বল্পকালীন জীবন নিবেদিত ছিল স্বদেশের, স্বসমাজের ও স্বজাতির কল্যাণ চিন্তায় ও হিত সাধনে। দেশ, মানুষ, ধর্ম, ন্যায় ও কল্যাণ সম্বন্ধে তার চিন্তা চেতনায় কিছু কিছু অনন্যতা ছিল।'

৩.
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে ঢাকায় ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে 'মুসলিম সাহিত্য সমাজ' গঠিত হয়। এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য ছিল সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানদের সমাজ সচেতন করে তোলা। নানারূপ অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার হতে মুক্ত করা। এই সংগঠনটির নাম মুসলিম সাহিত্য সমাজ হলেও এর কর্মকান্ড আবর্তিত হত হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকল বাঙালির জন্য। এই সংগঠনের মুখপত্র ছিল 'শিখা' সে সূত্রে এর সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন তাঁরা 'শিখা গোষ্ঠীর' লেখকরূপে পরিচিত হন। মুসলিম সাহিত্য সমাজের মূলমন্ত্র ছিল বুদ্ধির মুক্তি। আর এই শিখার সম্পাদক-প্রকাশক হিসাবে আবুল হুসেন ছিলেন 'বুদ্ধির মুক্তি' আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিদের অন্যতম। শিখা গোষ্ঠীর অন্যান্য লেখকদের মধ্যে কাজী আবদুল অদুদ, (১৮৮৭-১৯৪৮) কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১), কাজী আনোয়ারুল কাদির (১৮৮৭-১৯৪৮) মোতাহের হোসেন চৌধুরী (১৯০৩-৫৬) আবুল ফজল এবং আবদুল কাদির (১৮৮৭-১৯৪৮) এর নাম উল্লেখযোগ্য। মুসলিম সাহিত্য সমাজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আবুল হুসেন বলেন, 'বাঙালি মুসলমান সমাজের যুগ-যুগান্তরের আড়ষ্ট বুদ্ধিকে মুক্ত করে জ্ঞানের অদম্য পিপাসা জাগিয়ে তোলা।' আবুল ফজল কাজী আবদুল ওদুদকে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের ‘ভাবযোগী’ ও আবুল হুসেনকে ‘কর্মযোগী’ বলে অভিহিত করেছিলেন। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ও শিখার বিকাশে নিবেদিত প্রাণ ছিলেন তিনি। আবুল হুসেনের এই উদ্যোগ পূর্ণ সফলতা না দেখলেও তার কর্মোদ্যম ছিল সন্দেহাতীত। সেই সময় অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক ছিল বাঙালি মুসলমান সমাজের জন্য একটি বিশেষ সময়। একদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা তথা এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের জন্য শিক্ষা লাভের নতুন দিগন্ত উন্মোচন, অন্যদিকে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারে তাদের নিমজ্জন, যার মূর্ত রূপ ফুটে উঠেছে কাজী ইমদাদুল হকের ‘আবদুল্লাহ’ উপন্যাসে। ধর্মীয় কুসংস্কার ও সামাজিক কুপ্রথা যে বাঙালি মুসলমানকে পশ্চাৎপদ করে রেখেছে, এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন আবুল হুসেন।

৪.
বাঙালি মানবতাবাদী দার্শনিক হিসাবে আবুল হুসেন মানসে লালন করতেন অসামপ্রদায়িক মানবতাবাদের আদর্শ। যার প্রমাণ আবুল হুসেন এর নিজের লেখনিতেই পাওয়া যায়। মুসলিম সাহিত্য সমাজের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য প্রসঙ্গে লিখিত নিবন্ধে তিনি লিখেন, 'কেহ হয়ত মনে করবেন এ সমাজের নাম 'মুসলিম সাহিত্য সমাজ' হওয়ায় হিন্দু সাহিত্যিকগণের কোন সম্পর্ক এতে নেই। কিন্তু এই বার্ষিক রিপোর্ট হতে আপনারা বুঝবেন যে এ সমাজ কোন একটি নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ নয় কিংবা এ কোন এক বিশেষ সামপ্রদায়িক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য গঠিত হয়নি। সাহিত্য সৃষ্টি এর উদ্দেশ্য, আর সেই সাহিত্যে মুসলমানের প্রাণ ও জীবন ফুটিয়ে তোলাই ইহার অন্যতম উদ্দেশ্য।' আর তাই আবুল হুসেনের সম্পাদনায় 'শিখা' বাংলার তরুণদের মনে উদার মনোভাব সৃষ্টির জন্য নিরলস ভাবে কার্যকর ছিল। মুসলিম সাহিত্য সমাজের ব্যানারে শিখা গোষ্ঠীর কার্যক্রম উভয় বাংলার জ্ঞানী গুণীদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিল। যার প্রমান মিলে- ১৯২৭ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রথম বার্ষিক সাধারণ সম্মেলনে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, মোহিত লাল মজুমদার, ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ হিন্দু মনীষার অংশ গ্রহণ। যা আবুল হুসেনসহ সমগ্র শিখা গোষ্ঠীর অসামপ্রদায়িক উদারমনা মানবতাবাদেরই পরিচয় বহন করে।

৫.
জ্ঞান সাধনাই ছিল জ্ঞান তাপস আবুল হুসেনের জীবন দর্শন। তাই তো তিনি তাঁর প্রথম পেশা হিসাবে শিক্ষাকতাকেই বেছে নিয়েছিলেন। থাকতে চেয়েছেন শিক্ষকতায় মনে প্রাণে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেবার পাশাপাশি নিজের সাহিত্য সাধনা ও সমাজ সংস্কারমূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে এদেশের সাধারণ মানুষকে জ্ঞানের পথে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন। বাঙালির মধ্যে জ্ঞানস্পৃহা জাগরণে আবুল হুসেনের বাংলার বলশী (১৩৩২ বঙ্গাব্দ) এবং বাঙালি মুসলমানের শিক্ষা সমস্যা (১৩৩৫) অসমান্য অবদান রেখেছে। আবুল হুসেনের দর্শনের মূল কথা ছিল 'জ্ঞানেই মুক্তি' আর বুদ্ধির মুক্ত চর্চা ছাড়া জ্ঞানের ফল সার্বিকতা পায় না। তাই তিনি মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র 'শিখা' সম্পাদনার মধ্য দিয়ে "জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব"। এই শ্লোগানের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বুদ্ধির মুক্তির জন্য কাজ করেন।

৬.
আবুল হুসেন মূলত সমাজমনস্ক মননশীল প্রাবন্ধিক। তাঁর প্রকাশিত বই বা অগ্রন্থিত-অপ্রকাশিত রচনার সংখ্যা প্রচুর ছিল না বটে, তবে তাঁর মননচিন্তার পরিধি-পরিসরের বলয় ছিল যথেষ্ট বড়—সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি-রাষ্ট্র-ধর্ম-শিক্ষা-ইতিহাস পর্যন্ত প্রসারিত। তাঁর মননচর্চার বৈশিষ্ট্য এই যে, তা যুক্তি-তথ্যে সমৃদ্ধ—গোছানো সিদ্ধান্তে গুরুত্ববহ। বাংলা ও ইংরেজি—দুই ভাষাতেই তিনি লিখেছেন। জ্ঞানের অনুরাগী আবুল হুসেন এদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও আইনকে যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসে আজীবন কাজ করেছেন। মানব কল্যাণে আবুল হুসেনের ভাবনা ছিল উপযোগবাদী। আবুল হুসেন নিজে একজন কমিউনিষ্ট না হলেও তৎকালীন রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপস্নব দ্বারা ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত হন। ঔপনিবেশিক ও সামন্তবাদী সমাজের নিপীড়িত কৃষকের অবস্থা সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে তাঁর 'বাংলার বলশী' পুস্তকে।

৭.
আবুল হুসেনের দর্শনের মূল নির্যাস ছিল মুক্তচিন্তার অনুশীলন। স্বাধীন মত প্রকাশকে তিনি স্বদেশের স্বজাতির আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির পূর্বশর্ত বলে মনে করতেন। বাঙালি মুসলমানদের আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার অনীহার সমালোচনা করে আবুল হুসেন বলেন- আমাদের শিক্ষাঙ্গনেই আমরা জ্ঞানের সঙ্গে বহুদিন হতে বিরোধ করে আসছি। দর্শন, বিজ্ঞান ও আর্টকে আমাদের শিক্ষা কেন্দ্র হতে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছি, এই ভয়ে- পাছে আমাদের ধর্ম নষ্ট হয়। ধর্ম আমাদের এতই নাজুক। অন্ধভাবে ধর্ম ও সমাজবিধি পালন নয়; মুক্তবুদ্ধি ও যুক্তি দ্বারা ধর্ম ও প্রথাকে যাচাই করার পক্ষে তিনি জোড়ালো মতামত উপস্থাপন করেন। ইসলামের অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এবং স্বদেশ স্বজাতির উদ্দেশ্যে ইসলামের যুক্তিনিষ্ঠ স্বরূপ উপস্থাপন করে, 'আদেশের নিগ্রহ' নামের যে প্রবন্ধ আবুল হুসেন লিখেছেন; তৎকালীন রক্ষনশীল মুসলিম সমাজে তার ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এতে ঢাকার রক্ষনশীল মুসলিম সমাজ ক্ষিপ্ত হয়ে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তারা আবুল হুসেনকে ইসলামের শত্রুরূপে আখ্যায়িত করে। আহসান মঞ্জিলের এক সালিসিতে উপস্থিত হয়ে তাঁকে লিখিত ভাবে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে। ইসলাম সবযুগের সব স্থানের সব মানুষের সব প্রয়োজন মিটাতে ও সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে না বলে তিনি মনে করেন এবং বলেন, 'সে প্রয়োজন মিটাতে হবে আমাদের জ্ঞান বুদ্ধি খাটিয়ে'। তাঁর প্রবন্ধের এটাই ছিল সারমর্ম। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে আবুল হুসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে কোলকাতায় চলে যেতে বাধ্য হন। সেখানে তিনি আইন ব্যবসা শুরু করেন। আর আমাদের লজ্জা হলো এমন তরো দর্শন অনুরাগী বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিকে কিনা শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকুরী ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছে। এটি অবশ্যই বাঙালির দর্শনের অপরিমেয় ক্ষতি। 

৮.
চিন্তাবিদ হিসাবে আবুল হুসেন ছিলেন মানবতাবাদী, সংস্কারপন্থী ও মুক্তচিন্তার পৃষ্ঠপোষক। জ্ঞান চর্চায় তিনি যুক্তি বুদ্ধিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন সর্বাধিক। আর এই যুক্তি বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা প্রীতির কারণেই তৎকালে তিনি লিখতে পেরেছিলেন, "অন্যান্য ধর্মের ন্যায় ইসলামও কতগুলি আদেশ ও নিষেধের সমষ্টি মাত্র। ইসলাম মানুষের জন্য, মানুষ ইসলামের জন্য নয়। কালের পরিবর্তনে ধর্মশাস্ত্রের কথা মানুষ পুরোপুরি পালন করতে পারে না। যেহেতু, সংসারের উন্নতির জন্যই মূলত ধর্ম বিধানের সৃষ্টি, সেহেতু, যুগের সাথে সংসারের উন্নতির জন্য ধর্ম বিধানও পরিবর্তনীয়। নবীজীর অমোঘ বাণী-যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলো এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজন হলে চীন দেশে যাও, আমরা ভুলতে বসেছি।’ … "ব্রিটিশের সঙ্গে ইউরোপের জ্ঞানদীপ্ত মন যখন এ দেশে আসলো এবং আমাদের আড়ষ্ট মনকে আঘাত করল, তখন হিন্দু সমাজ সে আঘাতে জেগে উঠলো এবং জ্ঞানদীপ্ত মনকে বরণ করে নিল। আর আমরা মুসলমানরা সে আঘাতে জাগতে তো চাই-ই নি বরং চোখ রাঙিয়ে সে মনকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। ইয়োরোপের জ্ঞানকে আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আজ পর্যন্ত আমরা আমাদের সে নিদারুণ ভুলের সংশোধনের চেষ্টা করি নাই। বরং সে ভুলকে বর্তমানে আরো জোর করে আঁকড়ে ধরেছি।"

৯.
মানবদরদী আবুল হুসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী কালীন সময় হতেই 'শিক্ষা ও জ্ঞানের আলো' বিতরনের মাধ্যমে মানুষের মাঝে সচেতনতা আনায়নে কাজ শুরু করেন। কৃষি নির্ভর দেশ মাতৃকার কৃষক সমাজের দুঃখ দুর্দশার মুক্তির পথ নির্দেশনায় তিনি কৃষকের আর্তনাদ, কৃষকের দুর্দশা, কৃষি বিপ্লবের সূচনা নামক প্রবন্ধ রচনা করেন। ঢাকায় যে 'বুদ্ধির মুক্তি' আন্দোলনের সূত্রপাত হয়, যার মূলমন্ত্র ছিল- "জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব' তার নেতৃত্ব দেন অগ্রভাগে থেকেই। তিনি ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজ গঠনের সাথে জড়িত ছিলেন এবং এর মুখপত্র 'শিখা' সম্পাদনা ও প্রকাশ করে এর আন্দোলনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, ডঃ মুহাম্মদ শহীদুলস্নাহ্ ও আবুল ফজল তাঁকে এ কাজে সহযোগিতা করেন। 

১০.
প্রাবন্ধিক, চিন্তাবিদ, সমাজসংস্কারক আবুল হুসেন ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ৬ জানুয়ারি যশোর জেলার পানিসারা গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস যশোরের কাউরিয়া গ্রামে। পিতা হাজী মোহাম্মদ মুসা ছিলেন একজন বিশিষ্ট আলেম। ১৯১৪ সালে আবুল হুসেন যশোর জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। পরে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আইএ ও বিএ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ (১৯২০), বিএল (১৯২২) ও এমএল (১৯৩১) ডিগ্রি লাভ করেন। কলকাতার হেয়ার স্কুলে (১৯২০-২১) শিক্ষকতার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিভাগের লেকচারার (১৯২১) এবং মুসলিম হলের হাউস টিউটর নিযুক্ত হন। ১৯৩২ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি পেশায় যোগদান করেন। তিনি বাংলার বিধানসভা কর্তৃক গৃহীত ওয়াক্ফ আইনের মূল খসড়া প্রণয়ন করেন। 

১১.
আবুল হুসেন মুসলমান সমাজে আধুনিক শিক্ষা ও জ্ঞানের আলো বিস্তারের উদ্দেশ্যে লেখনী পরিচালনা করেন। মননশীল প্রবন্ধকার হিসেবে তিনি কৃষক-সমাজের দুঃখ-দুর্দশার মুক্তির পথ নির্দেশ করেন তাঁর বাংলার বলশী গ্রন্থের প্রবন্ধসমূহে। রুশবিপ্লবের প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ‘কৃষকের আর্তনাদ’, ‘কৃষকের দুর্দশা’ ও ‘কৃষি বিপ্লবের সূচনা’ নামক প্রবন্ধ রচনা করেন। বাঙালী মুসলমানদের শিক্ষাসমস্যা (১৯২৮), মুসলিম কালচার (১৯২৮), বাঙলার নদীসমস্যা, শতকরা পঁয়তাল্লিশের জের, সুদ-রিবা ও রেওয়াজ, নিষেধের বিড়ম্বনা, Helots of Bengal, Religion of Helots of Bengal, Development of Muslim Law in British India প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা। এগুলির মধ্যে প্রথম তিনটি বিখ্যাত গ্রন্থ। মুক্তবুদ্ধি ও উদার চিন্তার অধিকারী আবুল হুসেন ছিলেন এ দেশে অসাম্প্রদায়িক সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম পথিকৃৎ। মৃত্যুর পর বাংলা একাডেমী থেকে আবুল হুসেন রচনাবলী নামে তাঁর রচনাসমগ্র প্রকাশিত হয়। 

১২.
আবুল হুসেন অন্ধ শাস্ত্রানুগত্যকে বর্জন করার কথা বলেছিলেন যুক্তি ও মানবকল্যাণের তাগিদ থেকে। ধর্মের মৌল সত্যকে ছাপিয়ে ধর্মতন্ত্র ও অন্ধবিশ্বাস বড় হয়ে উঠলে মানুষের বিকশিত হওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তাই কেবল শাস্ত্রীয় বিধানের মধ্যে মুক্তির উপায় সন্ধান যে অরণ্যে রোদনের নামান্তর তা সচেতন ও বিবেকবান মানুষের অজানা থাকে না। আবুল হুসেনও উপলব্ধি করেছিলেন অন্ধমোহ ত্যাগ করে, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে শিক্ষিত না হয়ে বাঙালি মুসলমান কখনও অগ্রসর হতে পারবে না। তাই ‘আদেশের নিগ্রহ’ প্রবন্ধে তিনি বলেন, “কোরআন শরিফ পাঠ (তেলাওয়াত) করার হুকুম আজ যেরূপভাবে পালন করা হচ্ছে, তাতে মনে হয়, তেলাওয়াত বন্ধ করে দিলেই মন ও মস্তিষ্কের পক্ষে পরম মঙ্গলকর হবে। সকালে মসজিদের মধ্যে কেরাত করে দলে দলে এক বর্ণও না বুঝে শুধু সওয়াবের লোভে যারা তেলাওয়াত করে তাদের বুদ্ধি যে সিঁকেয় তোলা থাকে তা বলাই বাহুল্য। এই হুকুমের নিগ্রহ প্রকাশ পায় ওই সব তেলাওয়াতকারীর মূর্খতা ও অজ্ঞতার ভিতর দিয়ে।”

১৩.
বোঝাই যাচ্ছে স্পষ্ট, জোরালো ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি অন্ধ ধর্মাচরণকে আক্রমণ করেছেন। তাই এই প্রবন্ধের বক্তব্য ও তাকে নিয়ে ঢাকার শিক্ষিত মুসলমান সমাজে চরম বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে। স্থানীয় উর্দুভাষীদের কাছেও প্রবন্ধের বক্তব্য বিকৃত করে পৌঁছানো হয়। বিষয়টি ফয়সালার জন্য ১৯২৯ সালে ৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় আহসান মঞ্জিলস্থ ‘ইসলামিয়া আঞ্জুমান’-এর অফিসে এক বিচার সভা বসে। সেখানে চাপের মুখে আবুল হুসেন একটি স্বীকারোক্তি পত্রে লেখেন, “ঐ প্রবন্ধের ভাষা দ্বারা মুসলমান ভ্রাতৃবৃন্দের মনে যে বিশেষ আঘাত দিয়েছি সে জন্য আমি অপরাধী।” রোমান ধর্ম আদালতের সামনে গ্যালিলিওর স্বীকারোক্তির কথা মনে করিয়ে দেয় এ ঘটনা।

১৪.
নিজের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গিয়ে এ নতিস্বীকারকে আবুল হুসেন নিজের নৈতিক পরাজয় বলে মনে করেছেন। বিবেকের এই গ্লানিবোধের কারণে তিনি নিজেকে আর সম্পাদক পদে উপযুক্ত মনে করেননি। পরদিনই সাহিত্য সমাজের সম্পাদকের পদ ত্যাগ করেন। এ উপলক্ষে লেখা পদত্যাগপত্রে তিনি বলেন, ‘‘সম্প্রতি ‘আদেশের নিগ্রহ’ নিয়ে যে আন্দোলন হয়েছে তাতে আমি এটুকু বুঝতে পেরেছি যে, সমাজের প্রকৃত কল্যাণাকাক্সক্ষী দার্শনিকের কথায় কেউ কর্ণপাত করবে না, বরং তার কথার উল্টা অর্থ করে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করবে।’’

১৫.
আবুল হুসেনসহ শিখাগোষ্ঠীর অন্য লেখকদের শাস্ত্রবিরোধী বক্তব্যকে কেন্দ করে বাঙালি মুসলমান সমাজে যে তোলপাড় সৃষ্টি হয়, তার সঙ্গে শত বছর আগে হিন্দু কলেজে ডিরোজিও ও ‘ইয়ংবেঙ্গল’ নামে পরিচিত তার শিষ্যদের ভূমিকার ফলে কলকাতার হিন্দু সমাজে সৃষ্ট আলোড়নের মিল খুঁজে পেয়েছেন শিবনারায়ণ রায়। শুধু এ ক্ষেত্রেই নয়, আরও বিভিন্ন সময় আবুল হুসেন তার নৈতিক মনোবলের পরিচয় দিয়েছেন। তার আরেকটি আলোচিত প্রবন্ধ ‘শতকরা পঁয়তাল্লিশ’। সাপ্তাহিক মোহাম্মদীতে প্রকাশিত এ প্রবন্ধে আবুল হুসেন মুসলমানদের জন্য সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে শতকরা পঁয়তাল্লিশ ভাগ পদ সংরক্ষণের বিরোধিতা করে লেখেন, “এর ফলে আমাদের নবীন সম্প্রদায়ের আকাক্সক্ষা ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্রতর হবে, কর্মস্রোতে ভাটা পড়বে, মন সঙ্কীর্ণ হবে, মস্তিষ্ক শ্রমবিমুখ হবে।” সংরক্ষণ ব্যবস্থার সুফলভোগী শিক্ষিত মুসলমান মধ্যবিত্তের অধিকাংশের কাছে তার এই মত গ্রহণযোগ্য হয়নি। আবুল হুসেনের এই বক্তব্যের সমালোচনা করে সাপ্তাহিক মোহাম্মদীতে কবি গোলাম মোস্তফার একটি সমালোচনা প্রকাশিত হয়। তাতে তাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে লেখা হয়, তার বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটি এই সংরক্ষণ ব্যবস্থারই ফল। কথায় ও কর্মে সৎ থাকাই ছিল আবুল হুসেনের বৈশিষ্ট্য। ১৯২৮ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপদ চাকরি ছেড়ে দিয়ে আইন ব্যবসায়ের অনিশ্চিত পেশা গ্রহণ করেন। নিজের আদর্শ ও বিশ্বাসকে অটুট রাখার জন্য এ ধরনের ত্যাগ যে কোনো সমাজেই বিরল ঘটনা।

১৬.
নিজের বক্তব্যে বা লেখায় কখনওই তিনি চালাকির আশ্রয় নেননি। এই কৌশলহীনতা তথা অপ্রিয় ভাষণের জন্যই তার রচনা জনপ্রিয় হয়নি। সারা জীবন অপ্রিয় কঠোর সত্য কথা বলে তিনি ধর্মান্ধ, সম্মোহিত মুসলমানকে জাগাতে চেষ্টা করেছেন। তার এবং তার সহযোদ্ধাদের তৎকালীন চিন্তা ও রচনায় যেসব ক্ষুরধার বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে তা বাঙালি মুসলমান সমাজে ছিল অকল্পনীয় ও অভূতপূর্ব। সে অর্থে তারা বাংলায় দ্বিতীয় জাগরণের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু সেই জাগরণ পূর্ণতা পায়নি। ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের কাঠামো থেকে ১৯৭১ সালে বেরিয়ে আসা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সেই জাগরণের পূর্ণতাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের বিয়াল্লিশ বছরেও সেই জাগরণ পূর্ণতা পায়নি। আবুল হুসেনের চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা এখানেই। তিনি এবং তার সহযোদ্ধারা ধর্মীয় অনাচারের ভিত্তিটিকে শক্ত হাতে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এর পরের পর্বটি সম্পন্ন করার দায়িত্ব বর্তেছিল তার পরবর্তী প্রজন্মের। সেই উত্তরাধিকার ধারণে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। সমকালীন বাংলাদেশে ধর্মকে পুঁজি করে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টায় সক্রিয় অপশক্তিকে রুখে দাঁড়ানোর জন্য আবুল হুসেনের উত্তরাধিকার ধারণের কোনো বিকল্প নেই।

১৭.
আবুল হুসেন চিন্তার ও যুগের নবায়নে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি চেয়েছেন, যুগের প্রয়োজনে কালিক ও দৈশিক প্রেক্ষাপট বিচার করে বাঙালি মুসলমান যেন সামনের দিকে এগিয়ে যায়। তাই যুক্তি ও মানবকল্যাণের বোধ থেকেও তিনি ও তার সহচরবৃন্দ শুরু করেছিলেন বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন। কিন্তু এ কাজে শুধু আবুল হুসেন নয়, কাজী আবদুল ওদুদকেও প্রতিক্রিয়াশীলদের অন্যায় নিগ্রহ সহ্য করতে হয়েছে। তবু তারা পথভ্রষ্ট হননি। আবুল ফজল লিখেছেন, “মুসলিম সাহিত্য সমাজের ঢেউ যাদের মনে নাড়া দিয়েছিল আর যারা এই প্রতিষ্ঠানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাদের কারও মনে সাম্প্রদায়িক মনোভাব, গোঁড়ামী ও কোনরকম সঙ্কীর্ণতা কিছুমাত্র রেখাপাত করতে পারেনি। তখনও যেমন পারেনি, পরে সংক্রামক ব্যাধির মতো সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প যখন সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল তখনও তারা ছিলেন এবং এখনও আছেন সব সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে। স্বাধীন চিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা তারা এখনও অব্যাহত রেখেছেন।” (বুদ্ধির মুক্তি, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবন, পৃষ্ঠা নং ২৬০)

১৮.
আহমদ শরীফের মূল্যায়ন দিয়েই শেষ করছি, 'আবুল হুসেন চিন্তা চেতনায় ছিলেন মানবতাবাদী। তাই তিনি অসামপ্রদায়িক, উদার, শ্রেয়োবাদী ও হিতবাদী এবং দৈশিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে হিন্দু মুসলিম মিলনকামী ও গনহিতে মিলিত প্রয়াসকামী। নিরঙ্কশ প্রীতিই এ বন্ধনসূত্র ও মিলন সেতু।'

(তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত