জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

মীনা কুমারী

প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০১৮, ১১:৩৩

১.
ভারতের কিংবদন্তি অভিনেত্রী মীনা কুমারী, বিষাদের মহানায়িকা মীনা কুমারী, ‘মীনা কুমারী দ্য পোয়েট’। মীনা কুমারীর জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩২ সালের ১ আগস্ট। বিষাদের মহানায়িকা মীনা কুমারীর জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, ‘দ্য ট্রাজিক কুইন’খ্যাত অভিনেত্রী মীনা কুমারী ১৯৭২ সালের ৩১ মার্চ মাত্র ৩৯ বছর বয়সে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। পৃথিবীতে রূপের সঙ্গে অনেকখানি দুঃখ জড়ানো থাকে। অতুলনীয় রূপ নিয়েও এক প্রেমহীন হাহাকারময় জীবন যাপন করে সে কথাটাই হয়তো প্রমাণ করে গিয়েছিলেন হিন্দি সিনেমার অন্যতম সেরা অভিনেত্রী ও কবি মীনা কুমারী। তাঁর জীবনে সুযোগ সন্ধানী পুরুষের অভাব ছিল না।কিন্তু তিনি যেমন প্রেম চেয়েছিলেন তেমন হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা তাকে কেউ উপহার দিতে পারেনি। তাই প্রেমতৃষ্ণা নিয়ে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে জীবনের কাছ থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল তাকে। নায়ক ধর্মেন্দ্র ও নায়িকা মীনা কুমারীর প্রেমকাহিনি বলিউডের বিষাদময় প্রেমগাঁথাগুলোর অন্যতম।

২.
রূপালী পর্দায় বিয়োগান্ত চরিত্রেই মীনা কুমারীর জনপ্রিয়তা ছিল প্রবাদতুল্য, তাই ‘ট্র্যাজিডি কুইন’উপাধি জোটে তাঁর কপালে। ভাগ্যদেবী হয়তো মলিন হেসেছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে নানা সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারেননি পরিস্থিতির জটিলতার জন্য। তবে স্বীয় মেধা এবং সুপ্ত প্রতিভা কাজে লাগালেন পরিবার প্রতিপালনে। তাঁর জীবনে ‘কথিত শুভানুধ্যায়ীরা’ পদে পদে প্রমাণিত হয় স্বার্থান্বেষী হিসেবে। আর তাই বহুল আলোচিত ‘পাকিজা’ ছবি মুক্তির মাত্র তিন সপ্তাহ পর হতাশার অন্ধকারে ডুবে মাত্র ৩৯ বছর বয়সেই পৃথিবীকে বিদায় জানালেন মীনা কুমারী। মৃত্যুর প্রায় চার দশক পরেও সত্যিকারের ভালোবাসার প্রতি তার আজন্ম আর্তি ধ্বনিত হয় অসংখ্য অন্তরে। তবে অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে— জন্মের মতই মৃত্যুর সময়ও হাসপাতালের টাকা পরিশোধ করার অর্থ ছিল না মীরার কাছে। এভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটে সত্যিকার অর্থেই এক ট্রাজিক কুইনের জীবন । সিনেমার তুমুল আলোচিত এবং অসম্ভব নাটকীয়, বলিউডের শুরুর দিকের অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেত্রী মীনা কুমারীর জীবন সম্পর্কে এক বাক্যে বলতে গেলে এমনটাই শোনাবে। দর্শকরা মীনাকে মনে রেখেছে ট্রাজিক সিনেমায় তার অসাধারণ অভিনয়ের জন্য, তবে মীনার জীবনের ট্রাজেডি হার মানাবে যে কোন সিনেমাকে। সাফল্যের চূড়ায় উত্থান আর সেখান থেকে বিষাদের নরকে পতন; সিনেমা আর বাস্তব জীবন মিলে মীনা সত্যিকার অর্থেই ছিলেন হিন্দী সিনেমার দ্য ট্রাজিক কুইন।

৩.
মীনা কুমারীর জন্ম এক মুসলিম পরিবারে। বাবা আলি বকশ ছিলেন শিয়া মুসলমান। মায়ের নাম ইকবাল বেগম। আলি বকশ থিয়েটারে হারমোনিয়াম বাজাতেন, গান শেখাতেন এবং উর্দু কবিতা লিখতেন। চলচ্চিত্রে জুনিয়র আর্টিস্ট ছিলেন তিনি। ইকবাল বেগম বিয়ের আগে থিয়েটার অভিনেত্রী এবং নৃত্যশিল্পী ছিলেন। মঞ্চে তার নাম ছিল কামিনী। কলকাতার বিখ্যাত ঠাকুরবাড়ির সঙ্গেও কোনো এক সূত্রে সম্পর্কিত ছিলেন তিনি। জন্মের সময় অবশ্য তার নাম ছিল মেহেজাবিন বানু। পরিবারের তৃতীয় কন্যা মীনার জন্মের সময় তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা এমনই শোচনীয় ছিল যে, এতই দরিদ্র ছিলেন যে, সাথে সাথে চিকিৎসকের বিল, হাসপাতালের ফি পরিশোধ করতে পারেননি। ফলে তার বাবা নবজাতককে একটি মুসলিম এতিমখানায় দিয়ে দেন। অবশ্য কয়েক ঘণ্টা পর তাকে আবার সেখান থেকে উদ্ধার করেন। এরপর অবশ্য বাসায় নেয়া হয় তাকে।

৪.
মাত্র সাত বছর বয়সে বেবি মীনা নাম দিয়ে চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করতে হয় তাকে।অভিনয় করার মোটেই ইচ্ছা ছিল না তার। শিশু মেহেজাবিন স্কুলে যেতে চেয়েছিল অন্য শিশুদের মতো, চিৎকার করে কাঁদতেন লেখাপড়া শেখার জন্য। কিন্তু মা তাকে একরকম জোর করে চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে বাধ্য করেন। পরিবারের মূল উপার্জনকারী তখন হয়ে ওঠে বেবি মীনা। বয়ঃসন্ধিতে মীনা কুমারী নামে নায়িকার ভূমিকায় দেখা যায় তাকে। রূপ এবং অভিনয় প্রতিভায় খুব তাড়াতাড়ি খ্যাতি পান তিনি। ‘বীর ঘটোৎকোচ’(১৯৪৯), ‘শ্রী গণেশ মহিমা’(১৯৫০) এবং ‘আলাদিন অ্যান্ড দ্য ওয়ান্ডারফুল ল্যাম্প’(১৯৫২) ছবির মতো পৌরাণিক ও রূপকথাভিত্তিক চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে তার জনপ্রিয়তার সূচনা হয়।১৯৫২ তে মুক্তি পায় ভারতভূষণ ও মীনা কুমারী অভিনীত ‘বৈজু বাওরা’। এটি হিন্দি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ধ্রুপদী সিনেমাগুলোর একটি। এ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ফিল্ম ফেয়ার আসরে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জেতেন মীনা।

৫.
১৯৫২ সালেই তার সঙ্গে খ্যাতনামা পরিচালক কামাল আমরোহির পরিচয় হয়। মীনা কুমারির বয়স তখন মাত্র ২০ বছর। কামাল আমরোহি ছিলেন তার চেয়ে ১৫ বছরের বড়। তিন সন্তানের জনক বিবাহিত কামাল আমরোহির প্রেমে পড়েন মীনা এবং সে বছরই বিয়ে হয় তাদের। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে কোনো সন্তান হোক তা চাননি কামাল এবং ভালোবাসার জন্য নয়, উঠতি নায়িকা মীনাকে তিনি বিয়ে করেছিলেন নিত্য নতুন সিনেমা বানাবেন বলে। অন্যদিকে মীনা কুমারীর পরিবারের লোকেরা এ বিয়েতে দারুণ অখুশি হয় রোজগেরে মেয়েটি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে। অবশ্য বিয়ের পরও পরিবারকে নিয়মিত টাকা দিতেন মীনা। স্বামীর কাছ থেকে যে ভালোবাসা চেয়েছিলেন তা পাননি বলে মীনা কুমারীর মনে ক্ষোভ জমা হতে থাকে। তবে এ সময় তার অভিনীত ছবিগুলো দারুণ ব্যবসায়িক সাফল্য পায়। তার অভিনয়ও প্রশংসিত হয়।‘পরিণীতা’(১৯৫৩) ছবিতে ললিতার ভূমিকায় তার অভিনয় ছিল অসাধারণ। এ জন্য ফিল্ম ফেয়ারে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান তিনি। ‘দায়রা’, ‘এক হি রাস্তা’, ‘সারদা’, ‘দিল আপনা অউর প্রীত পারায়া’, ‘আজাদ’, ‘কোহিনূর’ সহ অনেক হিট ছবি উপহার দেন তিনি। নির্মাতাদের পছন্দের তালিকায় পহেলা নম্বরেই ছিলেন মীনা কুমারী।

৬.
১৯৬২ সালে ‘সাহেব বিবি আউর গোলাম’ ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। বিমল মিত্রের ‘সাহেব বিবি গোলাম’ উপন্যাস অবলম্বনে গুরু দত্ত প্রযোজিত এ ছবিতে ছোট বৌঠানের ভূমিকায় তার অভিনয় এখনও হিন্দি ছবির ইতিহাসে ক্ল্যাসিক বলে ধরা হয়। এ ছবিতে স্বামীর মন জোগানোর জন্য মদ্যপানে আসক্ত জমিদারবাড়ির কূলবধূর চরিত্রে তিনি অনন্য অভিনয় করেন।আবার ফিল্মফেয়ারে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান। সে বছর ‘আরতি’ সিনেমাতেও অসাধারণ অভিনয় করেন তিনি।১৯৬২ সালে তিনটি ছবিতে অভিনয়ের জন্য ফিল্মফেয়ার আসরে তিনটি মনোনয়ন পেয়ে রেকর্ড গড়েন তিনি।মীনা কুমারী চার বার সেরা অভিনেত্রীর ফিল্মফেয়ার পুরস্কার এবং আটবার মনোনয়ন পান।

৭.
ক্যারিয়ারে সাফল্যের শিখরে পৌছালেও দাম্পত্য জীবনে কামাল আমরোহির সাথে তার দূরত্ব বাড়তে থাকে। ১৯৫৬ সালে কামাল আমরোহি মীনা কুমারীকে প্রধান চরিত্রে রেখে একটি সিনেমার পরিকল্পনা করেন। ‘পাকিজা’ নামের এ ছবিটি কামাল আমরোহির সেরা কাজ বলে মনে করা হয়। অশোক কুমারকে নায়ক করে ছবির কাজ শুরুও হয়ে যায়। কিন্তু ৬৪ সালে মীনা-আমরোহির দাম্পত্যে চিড় ধরে। তারা বিছিন্ন হয়ে যান। সে কারণে ‘পাকিজা’ অসমাপ্ত রয়ে যায়। এ সময় মীনা কুমারী হতাশা থেকে মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েন। সেই সঙ্গে তার জীবনে নিত্য নতুন তরুণের আনাগোনা শুরু হয়। তিনি তরুণ ছেলেদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে থাকেন একের পর এক। তরুণদের সঙ্গে স্বল্পস্থায়ী প্রেম তার একটি খেলায় পরিণত হয়।

৮.
জীবনের এই পর্বেই তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে ধর্মেন্দ্রর।ধর্মেন্দ্র তখন পাঞ্জাব থেকে সদ্য আগত এক তরুণ। সুগঠিত দেহের অধিকারী সুদর্শন ধর্মেন্দ্র বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলেন ১৯ বছর বয়সে পারিবারিক চাপে। তার স্ত্রী প্রকাশ কউর থাকতেন পাঞ্জাবে। চলচ্চিত্রভুবনে তার কোনো আত্মীয় পরিজন ছিল না। ফলে তাকে সুযোগ দেওয়ারও তেমন কেউ নেই। প্রথম ছবিটি ব্যর্থ হওয়ায় চলচ্চিত্রে তার কোনো আশা ভরসাই নেই তখন। এই সময় মীনা কুমারীর নজরে পড়েন তিনি। দুজনে একসঙ্গে অভিনয় করেন ‘পূর্ণিমা’ সিনেমায়। মীনা কুমারী এই অনভিজ্ঞ তরুণকে অভিনয় শেখানো শুরু করেন এবং প্রায় হাতে ধরেই তাকে বলিউডে প্রতিষ্ঠিত করেন।

৯.
তার জীবনে ধর্মেন্দ্র বয়ে আনেন ভালোবাসার সুবাতাস। আবেগপ্রবণ কবি মীনা কুমারী তীব্রভাবে ভালোবেসে ফেলেন তাকে। তাকে তিনি ‘ধরম’ বলে ডাকতেন। তাকে প্রতিদিন না দেখলে অস্থির হয়ে পড়তেন। অন্যদিকে ধর্মেন্দ্রও তার ‘মীনাজি’কে ভালোবাসতেন, হয়তো সে ভালোবাসায় স্বার্থের ভাগটাই বেশি ছিল। মীনা কুমারীর বাড়ি ‘জানকী কুটির’-এ তিনি ছিলেন প্রতি সন্ধ্যার অতিথি। তীব্র, আবেগময় এক সম্পর্কে মগ্ন ছিলেন তারা। হিন্দি সিনেপাড়ার বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, পিকনিক, প্রিমিয়ারে তার একসঙ্গে যেতেন। ‘ধরমের’ প্রতি প্রকাশ্যে আবেগ দেখাতে কুণ্ঠিত হতেন না ‘মীনাজি’।একসঙ্গে ‘পূর্ণিমা’,‘কাজল’, ‘ফুল আউর পাথ্থর’, ‘চন্দন কা পালনা’সহ কয়েকটি সফল সিনেমা করেন এই জুটি। মীনা কুমারীর অ্যালকোহল আসক্তি তার চেহারা ও স্বাস্থ্য নষ্ট করে দিচ্ছিল। ফলে তার ক্যারিয়ার কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অন্যদিকে ধর্মেন্দ্র ক্রমেই ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন অভিনয়ে। ফলে তিনি আর আগের মতো সময় দিতে পারছিলেন না তার প্রেমিকাকে। দুজনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে। অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ মীনা কুমারী এই দূরত্ব ঘোচাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। যদি ‘ধরমের’ মনে ঈর্ষার আগুন জ্বালানো যায় তাহলে হয়তো আগের সেই আবেগের তীব্রতা ফিরে আসবে, এই ভাবনায় রাহুল নামের একটি ছেলের সঙ্গ গ্রহণ করেন।

১০.
ধর্মেন্দ্র মুম্বাই ফিরে এসে বিস্তারিত ব্যাখ্যা শোনার প্রয়োজন মনে করেননি, ‘মীনাজি’র সঙ্গে ভালোবাসা কিংবা কৃতজ্ঞতাসূত্রেও কথা বলে সত্যতা যাচাইয়ের দরকার মনে করেননি। সেই দিনই মীনার সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করেন তিনি চিরতরে। মীনা কুমারী এ ঘটনায় বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনটুকুও হারিয়ে ফেলেন। মদে ডুবে যান তিনি। তার লিভার দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হন। এ সময় যে কবিতাগুলো মীনা লেখেন তা যেমন মর্মস্পর্শী তেমনি শিল্পগুণের দিক দিয়ে সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।

১১.
তার অসুস্থতার খবর পেয়ে দেখতে আসেন কামাল আমরোহি। না, সাবেক স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা জানাতে নয়, ‘পাকিজা’ শেষ করার প্রস্তাব নিয়ে।কারণ ইতোমধ্যেই নার্গিস এবং সুনীল দত্ত তাকে উৎসাহিত করেছিলেন ‘পাকিজা’র মতো অসাধারণ চিত্রনাট্যের ছবিটি সমাপ্ত করার জন্য। মীনা কুমারী কামাল আমরোহির কথায় রাজি হন। চরম অসুস্থ শরীর নিয়েও তিনি ‘পাকিজা’র কাজ করতে থাকেন।অশোক কুমারের পরিবর্তে সালিম চরিত্রে নায়ক হন রাজকুমার। অশোক কুমার ছবির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন। ছবিতে মা ও মেয়ের ভূমিকায় অনবদ্য দ্বৈত অভিনয় করেন মীনা কুমারী। শুরু হওয়ার পনেরো-ষোলো বছর পর শেষ হয় ‘পাকিজা’র কাজ। ছবিটি বলিউডের শতবর্ষের অন্যতম সেরা নির্মাণ হিসেবেই বিবেচিত হয় আজও। 

১২.
‘পাকিজা’ মুক্তি পায় ১৯৭২ সালে। মীনা কুমারী তখন মৃত্যুশয্যায়। হাসপাতালে নিঃসঙ্গ মীনাকে দেখতে আসেননি কামাল আমরোহি, ধর্মেন্দ্র কিংবা তার অসংখ্য গুণগ্রাহীদের কেউ। একমাত্র কবি, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও বন্ধু গুলজার তাকে কিছুটা সাহচর্য দেন। মীনা কুমারী সে সময় কপর্দকশুন্য। হাসপাতালের বিল মেটাবার সাধ্যও নেই তার। পরিবারের যে সদস্যরা তার রোজগারে প্রতিপালিত হয়েছে আজীবন, তারাও দূরে সরে রইল টাকা খরচের ভয়ে।

১৩.
১৯৭২ সালের ৩১শে মার্চ মৃত্যু হলো হিন্দি সিনেমার এই কিংবদন্তি শিল্পীর।তার মৃত্যুর পর যেন তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতেই ভক্তরা ছুটে গেল প্রেক্ষাগৃহে ‘পাকিজা’ দেখার জন্য। প্রকারান্তরে নিজের জীবন দিযে ‘পাকিজা’র বাণিজ্যিক সাফল্য নিশ্চিত করে গেলেন তিনি। ভাগ্যবিড়ম্বিত বিষাদের মহানায়িকার জীবনাবসানে শেষ হলো একটি অধ্যায়। পরবর্তী নায়িকাদের জীবনাদর্শে মাইল ফলক হয়ে গেলেন পর্দার ‘ট্র্যাজেডি কুইন’ মীনা কুমারী।

১৪.
১৯৬৪ সালে কমল আমরোহীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পর গভীর হতাশায় ডুবে যান মীনা কুমারী।এ সময় একজন সম্ভাবনাময় কবি হিসেবেও তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। যদিও স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাননি তিনি, কিন্তু নিজের উদ্যোগে শিখেছিলেন লেখাপড়া। কবিতা লিখতেন। তার কবিতা পাঠক মহলে সমাদৃত হতো। 'তালাক তো দে রহে হো নজর-এ-কেহর কে সাথ/ জওয়ানি ভি মেরা লৌটা দো মেহর কে সাথ' (বিদায় তো দিচ্ছ এক চোখ রাগ নিয়ে, কিন্তু খোরপোষের সঙ্গে আমার যৌবনও ফিরিয়ে দাও)? না নিছক কোনো শায়রি নয়? ১৯৬৪ সালে তার থেকে বয়সে পনেরো বছরের বড় স্বামী কামাল আমরোহির সঙ্গে ডিভোসের্র পর এই পংক্তিগুলো লিখেছিলেন মীনা কুমারী? আর বিয়ে করেননি মীনা? বলা হয়, বিবাহ-বিচ্ছেদের পর থেকে, এমন সব আহত, ক্ষত-বিক্ষত পংক্তি লেখার পর থেকে নিজেকে মদে ডুবিয়ে ফেলেন তিনি? মদ থেকেই সিরোসিস অফ লিভার? পরিণতিতে মৃত্যু? ভীষণ দারিদ্রের মধ্যে, শরীর মনে ছিন্ন-ভিন্ন অবস্থায় ১৯৭২ সালে মৃত্যু হয় মীনা কুমারীর?
 
১৫.
ভারতের হিন্দি সিনেমা জগতের একসময়ের বিখ্যাত অভিনেত্রী মীনা কুমারী অভিনয়ের পাশাপাশি কবিতা রচনাও করতেন। শেষ বয়সে সবথেকে বেশি কবিতা রচনা করেছেন মীনা কুমারী। মৃত্যুর পর তার রচিত উর্দু ভাষার কয়েকটি কবিতার একটি সংকলন প্রকাশ করেন গুলজার। ওই বই পড়েই মীনা কুমারীর সমস্ত কবিতাকে ইংরাজি ভাষায় অনুবাদ করার সিদ্ধান্ত নেন ভারতীয় শিক্ষাবিদ ও লেখক নুরুল হাসান। নুরুল হাসান একজন খ্যাতনামা অ্যাকাডেমিশিয়ান ও লেখক, যিনি ‘মীনা কুমারী দ্য পোয়েটঃ আ লাইফ বিয়ন্ড সিনেমা’ নাম দিয়ে বইটি প্রকাশ করেছেন। এই বইটিতে মীনার শেষ বয়সের রাগ, দুঃখ, অভিমান, নিজের ভালবাসা সমস্ত ধরনের ভাবনাকে ইংরাজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন নুরুল। ‘ মীনা কুমারীর জীবন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল তাঁর আশেপাশের মানুষদের জন্য। তাই তিনি শেষ বয়সে অসম্ভব দুঃখের মধ্যে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর জীবনের খারাপ লাগাগুলি ফুটে উঠেছে কবিতার মধ্যে দিয়ে’, অনুবাদক নুরুল হাসান সাংবাদিক বৈঠকে এমনটাই জানান। ১৯৭২ সালে অভিনেত্রী মীনা কুমারী মারা যাওয়ার পরেই গুলজার তাঁর রচিত কয়েকটি কবিতা নিয়ে একটি কালেকশন তৈরি করে প্রকাশিত করেন। সেই বই পড়েই নুরুল মীনা কুমারীর সমস্ত কবিতাকে ইংরাজি ভাষায় অনুবাদ করার সিদ্ধান্ত নেনে। নুরুল জানান যে এত ভালভাবে নিজের অনুভূতি এবং নিজের ব্যক্তিত্তকে কবিতার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন মীনাকুমারী তা দেখে উনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এরপরেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, মীনা কুমারীর অভিনয় সত্ত্বার পাশাপাশি তাঁর কবি সত্ত্বাকেও যাতে মানুষ জানতে পারে তাই কবিতা অনুবাদের কাজ করেন। ‘মীনা কুমারী দ্য পোয়েটঃ আ লাইফ বিয়ন্ড সিনেমা’ বইটি প্রকাশ করেছেন রোলি প্রকাশনা সংস্থা।

(তথ্যসূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক প্রথম আলো, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত