জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

ড. কাজী মোতাহার হোসেন

প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০১৮, ১১:০০

১.
সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞান সাধক ড. কাজী মোতাহার হোসেন। যাদের নাম প্রাতঃস্মরণীয়, যাদের অবদান এদেশের শিক্ষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে চির অম্লান। তাদেরই অন্যতম জ্ঞানতাপস কাজী মোতাহার হোসেন। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি এ প্রজন্মের অনেকেই এদের নামও শোনেনি। ১৮৯৭ সালের ৩০ জুলাই (১৩০৪ বঙ্গাব্দের ১৪ শ্রাবণ) তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ এবং উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু অধ্যাপক ড. কাজী মোতাহার হোসেনের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, ১৯৮১ সালের ৯ অক্টোবর তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মতোন মুক্তবুদ্ধির, মানব কল্যাণের প্রজ্ঞাবান মানুষদের আজ বড়ো বেশি প্রয়োজন অনুভব করি সাম্প্রতিক মুক্তচিন্তার প্রায় নিষিদ্ধ সময়ে।তাঁকে স্মরণ করা, তাঁর রচনা ও অনুবাদ পাঠ নিজেকে সমৃদ্ধ করবার জন্যেই বেশি জরুরি আমাদের। সংস্কৃতিসচেতন একজন আদর্শ বাঙালি ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন৷ পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা না দেওয়াতে ১৯৪৭ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর প্রকাশিত 'রাষ্ট্রভাষা ও পূর্বপাকিস্তানের ভাষাসমস্যা' প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন "... ধূমায়িত অসন্তোষ বেশি দিন চাপা থাকতে পারে না৷ শীঘ্রই তাহলে পূর্ব-পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হবার আশঙ্কা আছে৷" ১৯৬১ সালে প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও তিনি রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী পালনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন৷ ১৯৬৭ সালে বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ করার সরকারি সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তিনি৷ পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সভাপতি হিসেবে তিনিই প্রথম বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে পহেলা বৈশাখকে সরকারী ছুটির দিন ঘোষণার দাবি জানিয়ে ১৯৫৪ সালের এপ্রিল মাসে সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রদান করেন৷ এই সংগঠনের উদ্যোগে এবং কাজী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে ঢাকায় প্রথমবারের মতো ম্যাক্সিম গোর্কির মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপিত হয়৷ কলকাতায় শরত্চন্দ্রের সঙ্গে দাবাখেলার এক ফাঁকে তিনি মন্তব্য করেছিলেন 'শরত্ সাহিত্যে মুসলিম সমাজচিত্র একেবারেই অনুপস্থিত যদিও মুসলমানরা এ দেশের বিরাট একটা অংশ জুড়ে হিন্দুদের পাশাপাশি অবস্থান করে আসছে৷' এরপর শরত্চন্দ্র লিখলেন তাঁর একমাত্র মুসলিম সমাজচিত্র, বিখ্যাত ছোটগল্প 'মহেশ'৷ সাহিত্যকে হিন্দুকরণ বা ইসলামীকরণের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে কাজী মোতাহার হোসেন বলেছিলেন, "...জলকে পানি বলে উল্লেখ করলে সাহিত্যের জাত যাবে না-জাত যাবে যদি জলচৌকিকে পানিচৌকি, পানিপথকে জলপথ, জলযোগকে পানিযোগ, জলপানিকে পানিপানি বা পাণিপ্রার্থীকে যদি জলপ্রার্থী করা হয়৷"

২.
ড. কাজী মোতাহার হোসেন তৎকালীন নদীয়া (বর্তমান কুষ্টিয়া) জেলার ভালুকা (বর্তমান কুমারখালী) থানার অন্তর্গত লক্ষ্মীপুর গ্রামে তাঁর মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। নিম্ন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ক্লাসে যোগ-বিয়োগ ও গুণনের পদ্ধতি শেখানোর পর নিজে নিজেই ভাগের নিয়ম আবিষ্কার করে শিক্ষককে অবাক করে দিয়েছিলো ফরিদপুরের কাজী পরিবারের যে দুরন্ত বালক, তিনিই কাজী মোতাহার হোসেন। পদ্মাপারের প্রকৃতির সাহচর্যে বেড়ে ওঠা এই দুরন্ত বালক যৌবনে এক সপ্তাহের অনুশীলন হিসেবে দেওয়া বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সাত-আটটা প্রশ্নের সমাধানও করে ফেলেছিলেন কয়েক ঘন্টার মধ্যেই। কাজী মোতাহার হোসেন নামের এই দুরন্ত বালক পরবর্তী জীবনে খ্যাতি লাভ করেন বাংলাদেশের প্রথম পরিসংখ্যানবিদ, বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, দাবাড়ু এবং বিশিষ্ট সাহিত্যিক হিসেবে। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁকে ডাকতেন 'মোতিহার' বলে, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্-এর ভাষায় তিনি 'আপনভোলা নিরহংকার মানুষ, বিদ্বান ও গুণী'। আর গুণমুগ্ধ ভক্তদের কাছে তিনি শ্রদ্ধেয় 'কাজী সাহেব'। বিজ্ঞান গবেষণার পাশাপাশি সাহিত্য-সংস্কৃতি-সঙ্গীত-খেলাধুলা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে অনন্য সাধারণ প্রতিভার সমন্বয়ে যুক্তিবাদী, ধর্মপ্রাণ ও স্পষ্টবাদী কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন একজন পরিপূর্ণ মানুষ। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ধর্মপ্রাণ; কিন্তু তাঁর মধ্যে ধর্মের কোনো ভান বা গোঁড়ামী ছিল না; তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সাম্প্রদায়িকতামুক্ত ও সর্বমানবিক। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যথাযর্থই মন্তব্য করেছেন : ‘কাজী মোতাহার হোসেন, আপনবোলা নিরহঙ্কার মানুষ, বিদ্বান ও গুণী। এই নিরলস বাণীসাধক জ্ঞানানুশীলনের ক্ষেত্রে আমাদের বিদ্বান সমাজে আদর্শ স্থানীয় ব্যক্তিত্ব। ধর্মের সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ে তিনি বলেন, ধর্মের মূল মাটিতে প্রোথিত হলে আর মস্তক, আকাশে বিস্তারিত হলে সব ধর্মের প্রকৃতিই সাদৃশ্যপূর্ণ। বাংলা ভাষা বিজ্ঞান সাধনার উপযোগী নয় তিনি ছিলেন এ ধারণার ঘোরতর বিরোধী। তাঁর পাঠদানের মাধ্যমও ছিল বাংলাই। জ্ঞানতাপস এই মহাপুরুষের সম্পর্কে স্বল্প পরিসরে কিছু বলতে পারা যায় প্রায় অসম্ভব।

৩.
কাজী মোতাহার হোসেনের পৈতৃক বাড়ি ফরিদপুর জেলার পাংশা উপজেলার বাগমারা গ্রামে। বাবা কাজী গওহর উদ্দীন আহমদ প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এবং বিদ্যোৎসাহী পরিবারের সন্তান। পূর্বপুরুষ ছিলেন মুঘলসম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারের কাজী।ছাত্রজীবনে কাজী মোতাহার হোসেন অসাধারণ মেধার স্বাক্ষর রাখেন। গ্রামের নিম্ন প্রাইমারী স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি পর্যন্ত তিনি বরাবর কৃতিত্বের সহিত উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তিলাভ করেন। ১৯১৫ সালে কুষ্টিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পরীক্ষা পাস করে ভর্তি হন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৯১৭ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। ১৯১৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ বিএ পরীক্ষায় বাংলা ও আসাম জোনে প্রথমস্থান অর্জন করে বৃত্তিলাভ করেন। ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে দ্বিতীয়শ্রেণীতে প্রথমস্থান নিয়ে এমএ পাশ করেন। উল্লেখ্য, সেবছর কেউ প্রথম শ্রেণী পাননি। 

৪.
১৯২১ সালে সাজেদা খাতুনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের সংসারে চার পুত্র ও সাত কন্যা: সনজীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন, মাহমুদা খাতুন, কাজী আনোয়ার হোসেন, কাজী মাহবুব হোসেন প্রমুখ।

৫.
ছাত্রাবস্থায়ই ১৯২১ সালে মোতাহার হোসেন নব প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ডেমোনেস্ট্রেটর হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯২৩ সালে তিনি এ বিভাগের সহকারী প্রভাষকের পদ লাভ করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি নিজস্ব উদ্যোগে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যাতত্ত্ব ও তথ্যগণিত বিষয়ে এম.এ কোর্স চালু করেন। তিনি এ নতুন বিভাগে যোগদান করেন এবং ১৯৫৪ সালে প্রফেসর পদে উন্নীত হন। ‘পরীক্ষণ প্রকল্প’ (Design of Experiments) শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫১ সালে পরিসংখ্যান শাস্ত্রে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। কাজী মোতাহার হোসেনের ‘পরীক্ষণ প্রকল্প’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভ পরিসংখ্যান গবেষণায় এক নতুন পদ্ধতির প্রবর্তন করে, যা ‘হোসেনের শৃঙ্খল নিয়ম’ (Husain’s Chain Rule) নামে পরিচিত। তিনি বিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক মোতাহার হোসেন ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করলেও ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যান বিভাগের ‘সুপারনিউমেরারি প্রফেসর’ হিসেবে বিভাগের সঙ্গে তাঁর কর্মকান্ড অব্যাহত রাখেন। ১৯৬৪ সালে পরিসংখ্যান গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হলে অধ্যাপক মোতাহার হোসেন এর প্রথম পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক হোসেন ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইমেরিটাস প্রফেসর’ পদে নিযুক্তি লাভ করেন। বস্তুত, তৎকালীন পূর্ববঙ্গে তিনিই প্রথম স্বীকৃত পরিসংখ্যানবিদ। কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন একাধারে একজন বাংলাদেশী পরিসংখ্যানবিদ, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালে ড. হোসেন ‘জাতীয় অধ্যাপক’ পদে সম্মানিত হন। 

৬.
কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী এবং সেই আলোকে দেশের শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সুদৃঢ় ভিত গড়ে তোলার জন্য তিনি লেখনী পরিচালনা করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ৬-দফাকে কেন্দ্র করে ষাটের দশকে পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের যে আন্দোলন সংঘটিত হয় তারও একজন বলিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন কাজী মোতাহার।

৭.
কাজী আবদুল ওদুদ, সৈয়দ আবুল হুসেন, আবুল ফজল প্রমুখের সহযোগিতায় ১৯২৬ সালে তিনি ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’প্রতিষ্ঠা করেন। কাজী মোতাহার হোসেন অল্প কিছুকাল উক্ত সংগঠনের মুখপত্র শিখা পত্রিকা সম্পাদনা করেন। যদিও পত্রিকাটি অল্পকালব্যাপী প্রকাশিত হয়েছে, তথাপি এটি মুসলিম সমাজে মুক্ত চিন্তার প্রসার ঘটাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম সারথি আবুল ফজল ‘বুদ্ধির মুক্তি’ নামের প্রবন্ধে ‘শিখা’ সম্পর্কে বলেছেন: ‘শিখার টাইটেল পৃষ্ঠায় একটি ক্ষুদ্র রেখাচিত্র ছিল . . . একটি খোলা কোরান শরীফ, . . . মানববুদ্ধির আলোর স্পর্শে কোরানের বাণী প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে, এ ছিল রেখাচিত্রটির মর্ম। কিন্তু এর একটা কদর্থ বের করতে বিরুদ্ধবাদীদের বেগ পেতে হয়নি। তাঁরা এর অর্থ রটালেন মুসলিম সাহিত্য সমাজের সমর্থকরা কোরানকে পুড়িয়ে ফেলে শুধু মানববুদ্ধিকেই দাঁড় করাতে চাচ্ছে। বলাই বাহুল্য, গোড়া থেকেই গোঁড়ারা মুসলিম সাহিত্য সমাজের বিরোধী ছিল। চিন্তার ক্ষেত্রে কায়েমি স্বার্থের বুনিয়াদ সবচেয়ে শক্ত। এরপর এরা রীতিমত বিরুদ্ধতা করতে লাগলেন আমাদের’।এই বিরুদ্ধতাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েই এগিয়ে গিয়েছিলেন সেদিনের মুক্তি আন্দোলনের সংগঠকরা। তাঁদের প্রেরণার উৎস ছিলেন (১) মোস্তফা কামাল (১৮৮৫-১৯৩৮), ২) রাজা রামমোহন (১৭৭৪-১৮৩৩), ৩) জিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১), ৪) রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১), ৫) প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬), ৬) নজরুল (১৮৯৯-১৯৭৬), ৭) হযরত মোহাম্মদ (৫৭০-৬৩২), ৮) শেখ সাদী (১১৭৫-১২৯২), ৯) গ্যেটে (১৭৪৯-১৮৩২), ১০) রোমা রোলাঁ (১৮৬৮-১৯৪৪)।

৮.
কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদ্রষ্টাদের মধ্যে একজন, তিনি বাংলা একাডেমির একজন প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বাংলা বানান ও লিপি সংস্কার কমিটিরও অন্যতম সদস্য ছিলেন। শক্তিশালী লেখনীর মাধ্যমে তিনি ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা যুগিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে কাজী নজরুল ইসলামের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। নজরুল তাঁর মোতাহার নামকে আদর করে 'মোতিহার' নামে ডাকতেন। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে ১৯৫৩ সালে শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত সাহিত্যমেলায় আমন্ত্রিত হয়ে ভাষণ প্রদান করেন কাজী মোতাহার হোসেন। অনুষ্ঠান শেষে রাত্রিবেলায় বাড়ির ছাদে কফি পার্টির আয়োজন হয়। জ্যোত্স্নালোকিত পূর্ণিমার সেই রাতে উপস্থিত সবাইকে চমকে দিয়ে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শোনান কাজী মোতাহার হোসেন। নীরস পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপকের কন্ঠে অপ্রত্যাশিত রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন সবাই। মূলত সঙ্গীতের প্রতি কাজী মোতাহার হোসেনের বিশেষ অনুরাগ ছিল কৈশোরকাল থেকেই। ১৯১৭-১৮ সালে তিনি বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ হেকিম মোহাম্মদ হোসেন সাহেবের কাছে দুই বছর রাগসংগীত তথা টপ্পা, ঠুমরি ও খেয়াল শেখেন এবং বছর তিনেক সেতারের তালিম গ্রহণ করেন। তরুণ বয়সে নানাবিধ পুরানো বাংলা গান, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল ও রজনীকান্তের গানের চর্চা করেন তিনি।

৯.
কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ ও পুস্তক রচনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রকাশনাসমূহ হচ্ছে: সঞ্চয়ন (১৯৩৭), নজরুল কাব্য পরিচিতি (১৯৫৫), সে পথ লক্ষ্য করে (১৯৫৮), সিম্পোজিয়াম (১৯৬৫), গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস (১৯৭০), আলোক বিজ্ঞান (১৯৭৪) এবং প্লেটোর সিম্পোজিয়াম (অনুবাদ-১৯৬৫) অন্যতম। তাঁর রচনাসমূহে সুস্থ মনন ও পরিচ্ছন্ন জীবনবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। 

১০.
বিজ্ঞান গবেষণা ও সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও কাজী মোতাহার হোসেন নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছেন। ছাত্রজীবনেই তিনি ফুটবল, টেনিস, ব্যাডমিন্টন, দাবা ও সাঁতারে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। পরবর্তী কালে তিনি নিজেকে উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি ১৯২৫ সালে 'অল ইন্ডিয়া চেস্ ব্রিলিয়্যান্সি' প্রতিযোগিতায় মোট ১০৩ নম্বরের মধ্যে ১০১ নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনি ১৯২১ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত একটানা চল্লিশ বছর অবিভক্ত বাংলা এবং পূর্ব পাকিস্তানে দাবা চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। তিনি 'অল ইন্ডিয়া অ্যান্ড সাউথ আফ্রিকা করেসপণ্ডেন্স চেস্ কম্পিটিশন'-এ চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। 'বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন'-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং আজীবন সভাপতি ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের দাবার জগতে পরম সম্মানিত 'দাবাগুরু' হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন তিনি। দাবার জগতে তাঁর অবদানের স্মারকস্বরূপ ১৯৮০ সালের ২৫ এপ্রিল ঢাকায় 'কাজী মোতাহার হোসেন ইন্টারন্যাশনাল রেটিং চেস্ টুর্নামেন্ট' শুরু করা হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় করাচিতে দাবা খেলবার জন্য নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়ে পুরো নয় মাস আটকা পড়েছিলেন সেখানে। তাঁর দাবাখেলার সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন কথাশিল্পী শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সতীশচন্দ্র আড্ডী, কিষাণলাল প্রমুখ। দাবাখেলা ছাড়াও তিনি ১৯৫১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত লন্ টেনিস প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হন।

১১.
কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন বাঙালি জনস্বত্বাধিকার দ্যুতির ধারক৷ তিনি বিশ্বাস করেছিলেন- স্বাধ্যায়ে যুগধর্ম, রুচির পরিবর্তন বা বিচিত্র সংমিশ্রণের সুষ্ঠু পরিচয় মেলে৷ তাতে সাহিত্যিক জীবন পরিপুষ্টি লাভ করে৷ ‘সাহিত্য প্রসঙ্গে দুয়েকটি কথা’ প্রবন্ধে তিনি আমাদের সামাজিক জন-আত্মার সুসংহতির বাণী উচ্চকিত করেছেন৷ তিনি উল্লেখ করেছেন: সমাজ মনের প্রকাশ থাকাতেই সাহিত্য হৃদয়গ্রাহী হয়৷ তাই সমাজ-মনটাকে বুঝে নেওয়া৷ সাহিত্য রচনার পক্ষে অত্যন্ত আবশ্যিক৷ আবার, ‘আর্টের সহিত ধর্মের সম্বন্ধ’ প্রবন্ধে ধীমান কাজী মোতাহার বাঙালির ধর্মবোধ ও শিল্পচিন্তার সূক্ষ্ম সম্বন্ধ নির্ণয় করেছেন৷ নির্মোহ ভঙ্গিমায় তিনি তার কল্যাণায়ত বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন৷ শুদ্ধ জীবন দিক-নির্দেশকেরই ভূমিকা গ্রহণ করে তিনি উল্লেখ করেছেন: ‘উৎকৃষ্ট আর্ট-সম্বন্ধে একটি বড়ো কথা এই যে, স্রষ্টার মনের ভাব যুগের শ্রেষ্ঠ ভাবধারার নির্দেশানুযায়ী হইবে, অন্যথায় ইহা আর্ট হইলেও অপকৃষ্ট ও অশ্রদ্ধেয় বলিয়া বিবেচিত হইবে৷ উদাহরণস্বরূপ বর্তমান সময়ের শ্রেষ্ঠ ভাবধারা হইতেছে-মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বসম্বন্ধের ক্রমিক বিকাশ৷ এরূপ স্থলে যুদ্ধ-বিগ্রহের বা অন্যদেশীয়ের ন্যায়সঙ্গত অধিকার গ্রাস করিবার, ধর্মান্ধতার বা স্বধর্মের বিরুদ্ধবাদীর প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত্ প্রার্থনা করার আদর্শে অনুপ্রাণিত আর্ট নিন্দার্হ৷’ চিন্তা ও কর্মের সুসমন্বয় এবং ভারসাম্যেই কাজী মোতাহারের বিশ্বাস ন্যস্ত হয়েছিলো৷ তার সাহিত্যকৃতিত্বে এমন প্রামাণ্য সুস্থির৷ ‘সাহিত্য ও সংস্কৃতি’ প্রবন্ধে তিনি প্রকাশ করেছেন: ‘সাহিত্যও বিকাশশীল, ধর্মও বিকাশশীল৷ এ কথা স্বীকার করে নিলে আর বিরোধ থাকতো না৷ কিন্তু ধর্মকে ফর্মুলায় ফেলে৷ তা-ই শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন অধিকাংশ ধর্মধ্বজী৷ এঁদের সঙ্গেই সাহিত্যিকের বিরোধ৷’ আবার, ‘সমসাময়িক শিল্প ও সাহিত্য’ প্রবন্ধে কাজী মোতাহার লিখেছেন : ‘আদর্শ প্রকট হলে সাহিত্য হয় না, আবার বাস্তবতার নগ্ন বর্ণনাও সাহিত্য নয়৷ বাস্তব ও আদর্শের যথাযোগ্য সংমিশ্রণই সুসাহিত্যের লক্ষ্মণ।’ সমাজ সচেতন তিনি আরও লিখেছেন: ‘রাজনীতি বর্তমান সমাজ জীবনের অনেকখানি স্থান দখল করে নিয়েছে আর ধর্মতো সবটুকুই গ্রাস করতে যেয়ে অনেকখানি হারাতে বসেছে৷ কাজে কাজেই আজকার সাহিত্যে রাজনীতি আর ধর্ম বেশ খানিকটা জায়গা নেবে এই স্বাভাবিক এবং সঙ্গত৷ এর জন্য চাই চিন্তার স্বাধীনতা৷ মত প্রকাশের স্বাধীনতা৷ নতুনকে আমল না দিলে উত্কর্ষ হবে কেমন করে?’

১২.
সম্মাননা: সভাপতি, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনের ষষ্ঠ অধিবেশন, কলকাতা মুসলিম ইন্সটিটিউট হল (১৯৩৮); সভাপতি, কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন, কাগমারী, টাঙ্গাইল; সিতারা-ই-ইমতিয়াজ সম্মাননা, পাকিস্তান (১৯৬১); বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৭); সভাপতি, পাকিস্তান সায়েন্স কনফারেন্স, ঢাকা (১৯৬৮); মূল সভাপতি, পাকিস্তান সায়েন্স কনফারেন্স, রাজশাহী (১৯৭১); সম্মানসূচক ডক্টর অব সায়েন্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭৪); বিদ্যাসাগর উপাধি, কুমিল্লা (১৯৭৫); জাতীয় অধ্যাপক, বাংলাদেশ (১৯৭৫); নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক, সওগাত সাহিত্য পরিষদ (১৯৭৭); সম্মানসূচক আজীবন সদস্যপদ, নজরুল একাডেমী, ঢাকা (১৯৭৭); সম্মানসূচক আজীবন সদস্যপদ, ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন (১৯৭৮); স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৭৯), বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা, বাংলাদেশ সরকার (১৯৭৯); সম্মানসূচক ফেলোশিপ, বাংলা একাডেমী (১৯৮০); মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮০); বিদ্যার্ণব উপাধি, যমুনা সাহিত্যগোষ্ঠী, সিরাজগঞ্জ (১৯৮০); নির্বাচিত বাংলাদেশী সদস্য, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইন্সটিটিউট, কলকাতা (১৯৮১); শেরে বাংলা জাতীয় পুরস্কার, শেরে বাংলা জাতীয় স্মৃতিসংসদ, ঢাকা (১৯৮১); সংবর্ধনা, ফরিদপুর জেলা সমিতি (১৯৮১); ভাসানী পুরস্কার (১৯৮১); ১৯৮৫ সালে তিনি শেরে বাংলা জাতীয় স্মৃতিসংসদ স্বর্ণপদক এবং ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের জাতীয় ক্রীড়া স্বর্ণপদক লাভ করেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স অ্যানেক্স ভবনটির নামকরণ করা হয় 'কাজী মোতাহার হোসেন ভবন'। 

১৩.
কাজী মোতাহার হোসেন আক্ষরিক অর্থেই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। বিজ্ঞান, সাহিত্য, সঙ্গীত, ধর্ম, খেলাধূলা সব কিছুতেই তার অবাধ বিচরণ ও দক্ষতা ছিল। তার দৃষ্টিভঙ্গী ছিল অতি স্বচ্ছ ও প্রগতিবাদী। তিনি ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণায় তিনি যে অবদান রেখে গেছেন, জাতি তা চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। তিনি শুধু বিজ্ঞান শিক্ষা বা পরিসংখ্যানের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, মানব কল্যাণ ও মানবতার মুক্তির জন্য কাজ করে গেছেন। তিনি সত্যিকার অর্থেই সমাজের দিক-নির্দেশক ছিলেন। বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা, নারী শিক্ষার উন্নয়ন, অসম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ও সাক্ষরতার উন্নয়নে কাজী মোতাহার হোসেনের অনন্য সাধারণ অবদান রয়েছে। তাঁর উদ্ভাবিত ‘হোসেন চেইন’ এখনও পরিসংখ্যান গবেষণার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হিসাবে বিবেচিত। কাজী মোতাহার হোসেনের জীবন ও কর্ম থেকে শিক্ষা নিয়ে সামাজিক সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধানের উপায় বের করতে তরুণ প্রজন্মের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। 

১৪.
সুদীর্ঘ বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে কাজী মোতাহার হোসেন নিজের মধ্যে একজন দেশপ্রাণ বাঙালি, উদারমনা মুসলমান এবং সত্ ও আদর্শবান ব্যক্তিত্বকে লালন করেছেন৷ মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি বলেছিলেন, "জন্মদিন যেমন আনন্দের দিন মৃত্যুদিনও তেমনই আনন্দের দিন৷ সুতরাং শোক করা উচিত নয়৷" ৮৪ বছর বয়সে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে ১৯৮১ সালের ৯ অক্টোবর শুক্রবার পবিত্র ঈদ-উল-আযহার সকালে মৃত্যুবরণ করেন বাংলাদেশের শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-ক্রীড়া ও বিজ্ঞানচর্চার সর্বজনশ্রদ্ধেয় মনীষী কাজী মোতাহার হোসেন। অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী তাঁকে সমাহিত করা হয় ঢাকার বনানী গোরস্থানে তাঁর স্ত্রীর কবরের পাশে। দেশ বরেণ্য সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, ক্রীড়াবিদ, বিজ্ঞান সাধক, জ্ঞানতাপস ও জাতীয় অধ্যাপক এই মহান শিক্ষাবিদের স্মৃতির প্রতি আবারো জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

(তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া, অনুশীলন, কাজী মোতাহার হোসেন : জন্মশতবর্ষ-আপনজনদের স্মৃতিকথা, উইকিপিডিয়া, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত