আওয়ামী লীগের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত

প্রকাশ : ২৬ এপ্রিল ২০২০, ১৯:১৩

নিষাদ আনোয়ার

ভারত বিভক্তির পর ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সময় ঢাকা পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তানের অংশ ছিল। পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের একটি অংশ নিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সামসুল হক প্রমুখ এই রাজনৈতিক দলটি প্রতিষ্ঠা করেন।

রাজনৈতিক দলটি খুব দ্রুত পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে দলটি একটি সক্রিয় শক্তি হিসেবে নেতৃত্ব দিতে থাকে। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দলের নাম হয় আওয়ামী লীগ।

বাংলাদেশ এবং অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে আছে আওয়ামী লীগের ইতিহাস। একটি যুগ-সন্ধিক্ষণে জন্ম নেওয়া এ রাজনৈতিক দলটি পরবর্তীকালে বহু উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে ক্রমস 

বাংলাদেশ নামক জাতি রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। দলটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য পরবর্তীতে সভাপতি এবং ক্রমশ জাতির পিতায় পরিণত হন। আওয়ামী লীগের এই অভিযাত্রা মসৃণ নয়। অনেক আন্দোলন, সংগ্রাম, অসংখ্য কর্মীর আত্মত্যাগ, জুলুম-নির্যাতন- এসব পেরিয়ে আজকের এই অবস্থান। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নতুন আশা, উদ্দীপনা নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে যাত্রা শুরু হয়। যখন একটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার জন্য সংগ্রাম করছিলেন, ঠিক সেসময় দেশী-বিদেশী চক্রান্তের মাধ্যমে বাঙালীর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপরিবারে নিহত হন। তারপর আবারও অমানিশা, সামরিক শাসন। এর মধ্যে ১৯৮১ সালে প্রবাসে অবস্থানকালে জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা 

দলটির সভাপতির দায়িত্ব লাভ করেন। শুরু হলো নতুন যাত্রা। আবারও সামরিক শাসন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এবং ক্রমশ বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ। আওয়ামী লীগ তার পথ 

পরিক্রমায় চারবার ক্ষমতায়, চারবার বিরোধীদলে অবস্থান, জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করে। তাদের রয়েছে এদেশের ইতিহাস এবং অগ্রযাত্রায় অনিবার্য অবস্থান।

 

আওয়ামী লীগের অতীত

 

আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম:

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাসেমের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয় যার সভাপতি ছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক।

আওয়ামী লীগের জন্মসূত্রের সঙ্গে ঢাকা ১৫০ নম্বর মোগলটুলিস্থ পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবিরের উদ্যোগ অনস্বীকার্য। ২৩ জুনের সম্মেলনের আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন শওকত আলী। তার উদ্যোগে ১৫০ নং মোগলটুলিস্থ শওকেত আলীর বাসভবন এবং কর্মী শিবির অফিসকে ঘিরে বেশ কয়েক মাসের প্রস্তুতিমূলক তৎপরতার পর ২৩ জুনের কর্মী সম্মেলনে দলের ঘোষণা দেওয়া হয়।

এছাড়াও কামরুদ্দীন আহমদ, মো. তোয়াহা, অলী আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান খান, আব্দুল আউয়াল, মুহম্মদ আলমাস, শামসুজ্জোহা এবং শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠা লগ্নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।

এরপর ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে একটি বৈঠকের আয়োজন করা হয়। এসময় মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি, ইয়ার মুহম্মদ খানকে সম্পাদক করে ২৪ জুন বিকেলে নবগঠিত দলটি যাত্রা শুরু করে।

আওয়ামী মুসলিম লীগের কার্যক্রম

১৯৫২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পরের বছর ঢাকার ‘মুকুল’ প্রেক্ষাগৃহে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে তাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ১৩ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন শেখ মুজিব। 

উল্লেখ্য যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ছিল তৎকালীন পাকিস্তানে প্রথম বিরোধী দল।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দলটি প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের ওপর বিশেষ গুরুত্বসহ ৪২ দফা কর্মসূচী গ্রহণ করে। শুরুর দিকে দলটির ম্যানিফেস্টোর মধ্যে ছিল রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি, 

এক ব্যাক্তির এক ভোট, গণতন্ত্র সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন এবং তৎকালীন পাকিস্তানের দু’অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ এবং দাবী।

 

যুক্তফ্রন্ট গঠন

বাঙালীর মাতৃভাষার অবমাননায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের মুখোশ উম্মোচিত হয়। প্রথম সাধারণ নির্বাচনের সুযোগ আসলে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য অন্যান্য দলকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর দলটি কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। জনগণের প্রত্যাশা এবং দাবী অনুযায়ী ২১ দফার ভিত্তিতে এই জোট গঠিত হয়।

১৯৫৪ সালের মার্চের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি আসন লাভ করে। এর মধ্যে ১৪৩টি পেয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সম্পূর্ণরূপে পরাভূত হয়। তারা শুধু ৯টি আসন লাভ করে। ২৪ বছরের পাকিস্তান শাসনামলে আওয়ামী মুসলিম লীগ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে দু’বছর প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল। এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার ছিল।

আওয়ামী লীগ গঠন

জনগণের ম্যান্ডেট নেওয়া একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে আমলাতন্ত্র এবং ব্যবসায়ী আর্শীবাদ পুষ্ট পশ্চিম পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে। বাংলাদেশের মানুষের 

কাছে দ্বিজাতীত্ত্বত্বের অসারতা দৃশ্যমান হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়ীক বাংলার মানুষের চেতনাকে সম্মান জানিয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দলের তৃতীয় সম্মেলনে দলের নাম থেকে 

‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়; নতুন নাম রাখা হয়: ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’।

প্রাদেশিক সরকার গঠন

রাজনৈতিক টানাপোড়নের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে যাওয়ার পর, ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নরের আহ্বানে সারা দিয়ে প্রাদেশিক সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।

এই সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হন আতাউর রহমান খান এবং শিল্প, বাণিজ্য ও শ্রমবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান শেখ মুজিবুর রহমান। মাত্র ২ বছরের শাসনকালে বহু সফলতা অর্জন করে এই সরকার। সাফল্যের সাথে খাদ্য সংকট সামাল দেওয়া ছাড়াও অর্জনের তালিকায় ছিল রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তিদান, ভূমিহীন কৃষকদের ‘টেস্ট রিলিফ প্রদান’ প্রদান, ভাষা আন্দোলনের শহীদদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান, ২১ ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটি ঘোষণা, পহেলা বৈশাখকে বাংলা নববর্ষের দিন হিসেবে উদযাপনের সিদ্ধান্ত, চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন স্থাপন, ময়মনসিংহে ভেটেরেনারি কলেজ, ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা, সাভারে ডেইরি ফার্ম স্থাপন। আর এসকল অর্জনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।

দলের ভাঙন

মূলত পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে ১৯৫৭ সালে দলে ভাঙন দেখা দেয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মাওলানা হামিদ খান ভাসানী। মাওলানা ভাসানী ছিলেন জোট-নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে, অন্য দিকে সোহরাওয়ার্দী ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জোট গঠনের পক্ষপাতী।ঐ বছর ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি ‘কাগমারি সম্মেলন’ এ দলে বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই বিরোধের জের ধরে ১৯৫৭ সালের ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন মাওলানা ভাসানী এবং কয়েকদিনের মধ্যে দলের ওয়ার্কিং কমিটির ৩৭ জন সদস্যের ৯ জনই ভাসানীর পদাঙ্ক অনুশরণ করেন।

সে বছরেরই জুলাই মাসে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নামে এক নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন মাওলানা ভাসানী। এমন সংকটময় অবস্থায় এগিয়ে আসেন শেখ মুজিব। মূলতঃ তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়ই প্রায় নিশ্চিত বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পায় আওয়ামী লীগ।

সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু

পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে রাষ্ট্র বিরোধী কাজের অপরাধ দেখিয়ে সোহরাওয়ার্দীকে জানুয়ারি ৩০, ১৯৬২ গ্রেপ্তার করা হয় এবং করাচি সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীণ করা হয়। আগষ্ট ১৯, ১৯৬২ সালে তিনি মুক্তি পান।

স্বাস্থ্যগত কারণে ১৯৬৩ সালে দেশের বাইরে যান এবং লেবাননের রাজধানী বৈরুতে অবস্থানকালে হোটেল কক্ষে ডিসেম্বর, ১৯৬৩ তে তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যু এখনো রহস্যাবৃত।

দল পুনর্গঠন

১৯৬৪ সালে দেশটির কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৬৬ সালের কাউন্সিলে দলের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তাজউদ্দীন আহমদ। এর পরে ১৯৬৮ ও ১৯৭০ সালের কাউন্সিলে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অপরিবর্তিত থাকেন। এই কমিটির মাধ্যমেই পরিচালিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ।

ছয় দফা আন্দোলন

১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৯৬৬ সালে ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৬ দফা দাবি পেশ করেন।

ছয় দফা দাবীর মূল লক্ষ্য ছিল, পাকিস্তান একটি Fedealev যুক্তরাষ্ট্র এবং ছয় দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে এই Federation বা যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। ছয় দফা কর্মসূচীর ভিত্তি ছিল ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। পরবর্তী কালে এই ৬ দফা দাবীকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার করা হয়। ছয় দফা 

আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে রূপান্তরিত হয় যা কিনা আওয়ামী লীগ এবং জনগণকে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে পরিচালিত করে। সেজন্য দফা ৬টি আলোচনা করা প্রাসঙ্গিকঃ

১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবিসমূহ


প্রথম
শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি: ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সরকারের বৈশিষ্ট্য হবে Federal বা যুক্তরাষ্ট্রীয় ও সংসদীয় পদ্ধতির; তাতে যুক্তরাষ্ট্রের 

অঙ্গরাজ্যগুলো থেকে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচন হবে প্রত্যক্ষ এবং সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে। প্রদেশগুলোকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিবে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক 

সভার প্রতিনিধি নির্বাচন জনসংখ্যার ভিত্তিতে হবে।

দ্বিতীয়
কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা: কেন্দ্রীয় বা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের দ্বায়িত্ব থাকবে কেবল প্রতিরক্ষ ও বৈদেশিক বিষয়ে অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গরাজ্যগুলোর পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে।

তৃতীয়
মুদ্রা ও অর্থ বিষয়ক ক্ষমতা: পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দু’টি পৃথক মুদ্রা-ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যা পারস্পরিকভাবে কিংবা অবাদে উভয় অঞ্চলে বিনিময়যোগ্য।

চতুর্থ
রাজস্ব কর ও শুল্ক বিষয়ক ক্ষমতা: সকল প্রকার রাজস্ব ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকবে অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে। কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা, প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয়ের ব্যয় 

নির্বাহের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রয়োজনীয় রাজস্বের যোগান আঞ্চলিক হতবিল হতে সরবরাহ করা হবে।

পঞ্চম
বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা: পঞ্চম দফায় বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ে নিম্নরূপ সাংবিধানিক বিধানের সুপারিশ করা হয়: (ক) ফেডারেশনভুক্ত প্রত্যেকটি অঙ্গরাজ্যের বহির্বাণিজ্যের 

পৃথক পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে। (খ) বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাজ্যগুলোর এখতিয়ারে থাকবে এবং অঙ্গরাজ্যের প্রয়োজনে অঙ্গরাজ্য কর্তৃক ব্যবহৃত হবে। 

(গ) কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মতনির্দিষ্ট হারে অঙ্গরাজ্যগুলো মিটাবে। (ঘ) অঙ্গরাজ্যের মধ্যে দেশজ ব্রদ্য চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা কর 

জাতীয় কোনো বাধা থাকবে না। (ঙ) সংবিধানে অঙ্গরাজ্যগুলোকে বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্য প্রতিনিধি দল প্রেরণের এবং স্ব স্ব স্বার্থে বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।

ষষ্ঠ
আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা: (ক) আঞ্চলিক সংহতি ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সংবিধানে অঙ্গরাজ্যগুলোকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা-সামরিক বাহিনী বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হবে। (খ) কেন্দ্রীয় সরকারের সকল শাখায় বা চাকরি ক্ষেত্রে প্রতিটি ইউনিট থেকে জনসংখ্যার ভিত্তিতে জনবল নিয়োগ করতে হবে। (গ) নৌ-বাহিনীর সদর দপ্তর করাচি থেকে চট্টগ্রামে স্থানান্তর করতে হবে।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং ‘৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান: বাঙালিদের ক্রমবর্ধমান জনসমর্থনকে দাবিয়ে রাখতে নতুন এক ফন্দি আঁটেন সেনাশাসক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে এক মিথ্যা মামলা দায়ের কারা হয় যেখানে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান সহ ৩৫ জন বাঙালি সরকারি কর্মচারী এবং সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভারতের সাথে ষঢ়যন্ত্র করে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়।

পরবর্তীকালে অবশ্য জানা যায়, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ভারত কি ভাবে সাহায্য করতে পারে সে বিষয়ে আলোচনার জন্য বঙ্গবন্ধু আগরতলায় গিয়েছিলেন এবং একটি যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল। যার ফলশ্রুতিত দু’বছর পরে প্রকৃত লড়াই শুরু হলে ভারত দ্রুত এগিয়ে আসে। কিন্তু তখন ভারতের সাথে ষঢ়যন্ত্রের বিষয়টি বঙ্গবন্ধু তথা বাঙালির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্য মামলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জনগণ ফুঁসে ওঠে। বিশেষ করে ছাত্র সমাজ। তারা মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ছয় দফা এবং এগার দফার ভিত্তিতে এই আন্দোলন স্বাধীকার আন্দোলনে রূপ নেয়। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের জনগণের পরিণত হয় এবং এর নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একজন অবিসংবদিত নেতায় রূপান্তরিত হন।

১৯৭০ এর নির্বাচন: ব্যপক গণআন্দোলনের ফলে সামরিক স্বৈরতান্ত্রিক আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন। বঙ্গবন্ধু এবং অন্যান্য কারাবন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়। গণদাবীর মুখে ক্ষমতাগ্রহণকারী নতুন সামরিক শাসন ইয়াহিয়া খান সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। ৭ই ডিসেম্বর ১৯৭০ থেকে ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭০ পর্যন্ত দেশব্যাপী ‘এক লোক, এক ভোট’ ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়।

১৯৭০ সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো এবং ফলাফল: নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ৩১০ আসনের মধ্যে ১৭৬ আসনে জয় লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের ম্যান্ডেট লাভ করে।

ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ: পাকিস্তান সামরিক বাহিনী পরিচালিত সরকার জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে কোনো সমাধান না দেওয়ায়, ৭ই মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু রহমান রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সমগ্র বাঙ্গালি জাতিকে এক দিক নির্দেশনী ভাষণে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হতে আহ্বান জানন। এই ভাষণে তিনি বলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম”। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ পৃথিবীতে জাতীর মুক্তির জন্য দেওয়া বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের ভাষণগুলির মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত।

৭ মার্চে এই ভাষণে বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ কোন দলীয় নেতার নির্দেশ ছিল না, ছিল একজন জাতীয় নেতার নির্দেশ। এই নির্দেশ দেশের সর্বস্তরের ছাত্র, জনতা ও বুদ্ধিজীবীদের সাথে বাঙালি সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী সকলকেই সচেতন করে তোলে। ২ মার্চ ৭১ থেকে পূর্ব বাংলার সমস্ত প্রশাসনিক কার্যক্রম চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে।

৭ মার্চ, ইতিহাস গড়ার দিন
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনিতির ইতীহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হচ্ছে ৭ই মার্চ। এদিন আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বাত্বক প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং স্বাধীনতার ডাক দেন। সর্বকালের অন্যতম এই শ্রেষ্ঠ ভাষণে একদিকে যেমন বাঙালির বঞ্চনার এবং তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরেন, অন্যদিকে সর্বাত্বক সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য জাতিকে আহ্বান জানন। আবার অসহযোগ আন্দোলনেরও ডাক দেন। ভাষণে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সব জেলায় সংগ্রাম কমিটি গড়ে তোলার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। দেশের মানুষকে স্বাধীনতা এবং মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানিয়ে ভাষণ শেষ করেন।

পরদিন আওয়ামী লীগের তরফ থেকে অসহোযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় এবং ভাষণে দেওয়া নির্দেশ মোতাবেক জেলায় জেলায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। ক’দিন (২৬ মার্চ) পর শুরু হওয়া স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের হাতে চলে আসে।

২৬ মার্চ, স্বাধীনতার ঘোষণা

২৫ মার্চ রাতে পাক বাহিনী বাংলাদেশের নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের উপর ট্যাঙ্ক নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। সৈন্য সমাবেশ, জনাতার প্রতিরোধ এবং ছোটখাট প্রতিরোধ শুরু হয় সন্ধ্যা থেকেই। 

আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাস ভবনে দেখা করেন। তিনি তাদের আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে সর্বাত্বক আন্দোন চালিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। তিনি নিজে তার জনগণকে রক্ষা করার জন্য মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। অবশ্য পাক বাহিনী তাকে হত্যা না করে বন্দী করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। ২৬ মার্চ এর প্রথম প্রহরে জাতির পিতা ইপিআরের ওয়ারলেস যোগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। আমৃত্যু লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি জাতিকে আহ্বান করেন। শুরু সর্বাত্মক স্বাধীনতা যুদ্ধ।

১৭ এপ্রিল প্রবাসে অস্থায়ী সরকার গঠন: পাক বাহিনী ঢাকা ও চট্টগ্রামে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর জেলা এবং মহাকুমা পর্যায়ে আক্রমণ শুরু করে। হাজার হাজার মানুষ ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে ভারত বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সহায়তায় ‘৭০ এর নির্বাচিন জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে প্রবাসী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরে আম্রকাননে শত শত দেশি বেদেশী সাংবাদিকের উপস্থিতিতে প্রবাসী সরকার শপথ গ্রহণ করে।

স্বাধীনতা যুদ্ধ

খুব অগোছালোভাবে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়। আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রিত প্রবাসী সরকারের দলের সাধারণ সম্পাদক এবং প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দীন আহমেদ এবং এর সহযোগীরা খুব দ্রুতই সংগঠিত হন। সমগ্র দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। নিয়মিত সেনা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ এবং সেই সাথে সদ্য প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত (FF) মুক্তিযোদ্ধা। ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক ও জনতার সমন্বয়ে এক একটি সেক্টরে সৈন্যদল গঠন করা হয়। ভারত সীমান্তে অসংখ্য ক্যাম্প স্থাপন করে আগত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভূক্ত করা হয় এবং ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়।

প্রায় ১ কোটি শরণার্থী বাঁচিয়ে রাখা, বিদেশ নিতি পরিচালনা এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনার মাধ্যমে জনগণের মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য দলটি কাজ করে। গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে নাস্তানাবুদ পাক বাহিনীকে একেবারে কোণঠাঁসা করে ফেলে মুক্তিবাহিনী। অবশেষে ভারতের স্থল, বিমান এবং নৌবাহিনীর সমর্থনে মুক্তিযোদ্ধারা সর্বাত্বক হামলা শুরু করে। 

পাক বাহিনী অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সম্মিলিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। সৃষ্ট্রি হয় বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের।

স্বাধীন রাষ্ট্রে আওয়ামী লীগ ও ‘৭২ এর সংবিধান

১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর এই সংগঠনটির নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিলে সভাপতি হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান। ‘৭২ এ স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন দলটির একটি বড় সাফল্য। সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালের ১১ই এপ্রিল ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে ৩৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়।

একই বছরের ১৭ই এপ্রিল থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত এই কমিটি বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করে। জনগণের মতামত সংগ্রহের জন্য মতামত আহ্বান করা হয়। সংগৃহীত মতামত থেকে ৯৮টি সুপারিশ গ্রহণ করা হয়। ১২ অক্টোবর, ১৯৭২ তারিখে তৎকালিন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন সংবিধান বিল গণপরিষদে উত্থাপন করেন। এরপর ৪ নভেম্বর ১৯৭২ সালে বিলটি পাস হয় এবং আইনে পরিণত হয়।

সংবিধান লেখার পর এর বাংলা ভাষারূপ পর্যালোচনার জন্য ড. আনিসুজ্জামানকে আহবায়ক, সৈয়দ আলী আহসান এবং মাযহারুল ইসলামকে ভাষা বিশেষজ্ঞ হিসেবে একটি কমিটি গঠন করে পর্যালোচনার ভার দেওয়া হয়। গণপরিষদ ভবন, যা বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবন, সেখানে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির বৈঠকে সহযোগিতা করেন ব্রিটিশ আইনসভার খসড়া আইন-প্রণেতা আই গাথরি। শিল্পী হাসেম খান হাতে লেখা প্রথম সংবিধান অলংকরণের দায়িত্ব ছিলেন।

এটি একটি অন্যান্য সংবিধান এবং এর প্রস্তাবনায় লেখা হয়, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা যেখানে সব নাগরিকের জন্য রাজনৈতীক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য নিশ্চিত হবে।’

রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনিতী হিসেবে বলা হয়, ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।’ পাশাপাশি ‘প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী’ সামাজিক সম্পদ বিতরণের এই নিতি গ্রহণ করা হয়।

বাকশাল ব্যবস্থার প্রবর্তন

আওয়ামী লীগের রাজনিতী, দালীয় আদর্শ- এর ক্ষেত্রে একটি মৌলিক পরিবর্তন হচ্ছে বাকশাল ব্যবস্থার প্রবর্তন। আওয়ামী লীগ সংসদীয় ব্যবস্থার একদলীয় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করে।

১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীবলে বহুদলীয় সংসদীয় সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় এবং দেশের সমগ্র রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) নামক একক রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধু বাকশালের চেয়ারম্যান এবং দেশের প্রেসিডেন্টের ভার গ্রহণ করেন। বাকশাল ব্যবস্থায় দলের চেয়ারম্যানই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।

চেয়ারম্যানের পরেই ক্ষমতা সম্পন্ন হচ্ছে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটি। চেয়ারম্যান সাধারণ সম্পাদক সহ ১৫ জনকেই মনোনীত করবেন। বাকশাল ব্যবস্থা দলের সদস্য প্রাপ্তির ব্যাপারটিও দলের চেয়ারম্যানের ইচ্ছাধীন। কারণ কার্যনির্বাহী কমিটির হাতেই সদস্যপদ প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। (ষষ্ঠ ধারা ৫ (গ) উপধারা)। এই ব্যবস্থায় সরকারী ও আধাসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীবৃন্দ এবং পুলিশ মিলিটারি সদস্যরাও দলের সদস্য হতে পারবেন। কিন্তু কে সদস্য হতে পারবেন আর পারবেন না তা সম্পূর্ণ রূপে চেয়ারম্যানের ইচ্ছাধীন (দশম ধারার ১০ উপধারা)।

বাকশাল ব্যবস্থার অধীনে কোনো শ্রেণী ও পেশাভিত্তিক সংগঠন এবং গণসংগঠন করার অধিকার নেই। ট্রেড ইউনিয়ন মাত্রই তাকে বাকশালের অঙ্গদল শ্রমিক লীগের অন্তর্ভূক্ত হতে হবে। 

এই অবস্থায় জাতীয় শ্রমিক লীগ, জাতীয় কৃষক লীগ, জাতীয় মহিলা লীগ, জাতীয় যুবলীগ এবং জাতীয় ছাত্রলীগ বাদে কোন শ্রমিক, কৃষক, যুব ও ছাত্র সংগঠন থাকতে পারবে না। 

আর উপরোক্ত সংগঠনগুলি হচ্ছে বাকশালেরই অংঙ্গ সংগঠন (অষ্টাদশ ধারা)।

৬ জুন, ১৯৭৫ বাকশাল ব্যবস্থায় দেশে চারটি দৈনিক ছাড়া আর সকল সংবাদপত্রে ডিক্লারেশন বাতিল করা হয়। ঐ চারটির তিনটি ছিল দৈনিক ইত্তেফাক, বাংলাদেশ টাইমস এবং দৈনিক বাংলা।

বাকশালের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা

সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করা হয়। গ্রামঞ্চলে চাষাবাদের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক সমবায় ব্যবস্থা চালু হয়। সমবায়ে সকলেই তাদের নাম অন্তর্ভূক্ত করবে। চাষাবাদের ক্ষেত্রে উপস্থিত মালিক এবং অনুপস্থিত মালিক ৪৫% আর ভূমিহীন কৃষক ৫৫%, এই হারে উৎপাদিত ফসল ভাগ হবে। জমির আইল উঠিয়ে বড় বড় ফার্ম আকারে সমবায়গুলি যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করবে। এসব যন্ত্রপাতি এবং উপকরণ সরকার সরবরাহ করবে। এবং সে জন্য ৫% ফসল সরকার নেবে। সমবায় অন্তর্ভূক্ত সদস্যগণের শিক্ষা, চিকিৎসা এবং বস্ত্র-এসবের দায়িত্ব নেবে সরকার।

বাকশাল একটি বিপ্লবাত্বক কর্মসূচি তাতে সন্দেহ নেই। জাতীকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি প্লাফর্মে এনে দেশ গড়ার কাজে নিয়োজিত করার জন্যই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আপাত: দৃষ্টিতে একদলীয় ব্যবস্থা বিধায় স্বৈরতন্ত্র মনে হলেও বঙ্গবন্ধু একে বলেন “শোষিতের গণতন্ত্র”- শোষিত মানুষ এখানে দলের সদস্য হিসেবে যে কোন নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। ফলে শাসন ব্যবস্থায় তার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়।

বাকশালের বয়স যখন দেড় বছর তখন জাতির পিতাকে হত্যা করা হয় আর এর মধ্য দিয়ে বাকশালের বিলুপ্তি ঘটে। রাষ্ট্রপতি এবং বাকশাল চেয়ারম্যান বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনিতীতে ব্যাপক অমানিশা দেখা দেয়। বঙ্গবন্ধুর পর তাঁর সহচর চার জাতীয় নেতাসহ মেজর জিয়া শত শত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে কারাবন্দী করে। এমনকি উগ্র বামপন্থী সর্বহারাদের আওয়ামী লীগের পেছনে লেলিয়ে দেওয়া হয়। এরপরই ১৯৭৬ সালে ঘরোয়া রাজনিতী চালু হলে আওয়ামী লীগকে আবার পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হন মহিউদ্দিন আহমেদ এবং সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। ১৯৭৭ সালে পুনরায় আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন আহ্বায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালের কাউন্সিলে সভাপতি হন আব্দুল মালেক উকিল এবং সাধারণ সম্পাদক হন আব্দুর রাজ্জাক। দল পূণর্গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হলেও অভ্যন্তরীণ বিবাদ এবং নেতৃত্বের প্রতি আস্থাহীনতার ফলে দলীয় কোন্দল দেখা দেয়। এরই প্রেক্ষাপটে ১৯৮১ সালের কাউন্সিলের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে প্রবাসে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর জেষ্ঠ্য কন্যা শেখ হাসিনাকে তার অবর্তমানে সর্বসম্মতিক্রমে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।

১৯৮৭ সালের কাউন্সিলে পুনরায় শেখ হাসিনা সভাপতি ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক হন।

১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালের সম্মেলনে শেখ হাসিনা এবং মো. জিল্লুর রহমান দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০০ সালের বিশেষ কাউন্সিলে একই কমিটি বহাল থাকে। 

২০০২ সালের ২৬ ডিসেম্বর জাতীয় কাউন্সিলে শেখ হাসিনা এবং আব্দুল জলিল দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট নির্বাচিত হয়। ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারি দ্বিতীয় মেয়াদে আবারও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। নির্বাচনে মহাজোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ দেশের একক বৃহত্তম রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসনে বিজয়ী হওয়ার পর সর্বশেষ ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়।

শেখ হাসিনা সভাপতি পদে বহাল থাকেন এবং নতুন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তৎকালীন এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। আর এই কাউন্সিলের মাধ্যমে তারুণ্যনির্ভর কেন্দ্রীয় কমিটি গড়ে তোলেন শেখ হাসিনা।

পরবর্তী কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর। এই কাউন্সিলেও সভাপতি শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নির্বাচিত হন।

২০১৬ সালের ২২ ও ২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত দুইদিন ব্যাপী কাউন্সিলে শেখ হাসিনা পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

২০১৯ সালের ২০ ও ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত কাউন্সিলেও সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অপরিবর্তিত থাকে।

আওয়ামী লীগের বর্তমান

দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সমৃদ্ধ অতীত এত স্বল্প পরিসরে তুলে ধরা খুবই কঠিন। তবুও তার যতটা সম্ভব আলোচনা করা হলো। অতীতের উপরই প্রতিষ্ঠিত বর্তমান। আর এ দুটির উপর নির্ধারিত হয় ভবিষ্যতের পথ পরিক্রমা। কদিন আগে প্রধানমন্ত্রী এবং দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন যে, “আওয়ামী লীগের সব নেতাকেই পয়সা দিয়ে কেনা যায়, শুধু শেখ হাসিনা ছাড়া।” বঙ্গবন্ধু কন্যার এই উক্তির মধ্য দিয়েই দল হিসেবে বর্তমান আওয়ামী লীগের দৈন্য ফুটে উঠেছে।

দলে কোন শৃঙ্খলা নেই, নেই আভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চা, পুরনো, জীর্ণ, ঘুনেধরা। নীতি ও আদর্শ- এসবের বালাই নেই। দলীয় নেতাকর্মীদের পড়ালেখার কোন প্রশ্নই ওঠে না। দলীয় কর্মসূচি, এসবের জন্য কোন মোটিভেশন নেই। জেলা উপজেলা কিংবা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সাথে অপরাপর রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে কোন তফাৎ নেই। তারা একই ভাবে কথা বলে, একই কাজে আনন্দ পায় ও একই ভাবে চিন্তা করে। অনেকেই টাকা থাকলে রাজনীতি করা যায় এই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত। বিভিন্ন সরকারী অফিসের নিয়োগ-বদলি বানিজ্য, টি আর কাবিখা, কাবিটা এসব অবাদে লুণ্ঠন, সরকারী সম্পত্তি ভোগদখল প্রকাশ্যেই চলছে। এবং মজার ব্যাপার হল এসব কাজে সত্যিকারের ত্যাগী কর্মীরা নেই। মূলত নব্য আওয়ামী লীগার এবং বিভিন্ন দল থেকে অনুপ্রবেশকারীরাই এসব কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এসব লোকদের প্রতিরোধ করার মতো প্রক্রিয়া নেই। দল গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসমান।

দীর্ঘদিন ধরে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত নির্বাচিত কমিটি নেই। অধিকাংশ এলাকাতেই ২০০৭-২০০৮ সালে কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। উপজেলাগুলোতেও একই অবস্থা। নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ নেই। কেন্দ্রীয় কমিটিতে কিছু তরুণকে সহকারী সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু তাদের অনেকই নাম গোত্রহীন। এদের নিয়োগ নিয়েও তোঘলকি কাণ্ড ঘটেছে বলা যায়। কিন্তু জেলা উপজেলা পর্যায়ে সেই এক দেড় যুগ পুরাতন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুর্নীতিগ্রস্থ লোকদের নেতৃত্বে চলছে সবকিছু। মহানগর ও জেলাগুলোর কমিটির সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়- চার মহানগর কমিটি (ঢাকা মহানগর কমিটি ব্যতিত)

বিভাগ অনুযায়ী দেখলে-

রাজশাহী বিভাগে ২০০৭ সালে যে সকল জেলার কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে সেগুলো হলো, রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, জয়পুরহাট, বগুড়া। এছাড়া ২০০৮ সালে যেসকল কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে সেগুলো হলো নওগা ও সিরাজগঞ্জ। রংপুর বিভাগে গাইবান্ধা, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলার কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে ২০০৭-০৮ সালে।

চট্টগ্রাম বিভাগে কক্সবাজার, নোয়াখালি ও চাঁদপুর জেলার কমিটিগুলো ২০০৪-০৫ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ। এছাড়া ২০০৫ সালে মেয়াদ শেষ হয়েছে লক্ষীপুর জেলার।

বরিশাল বিভাগে ঝালকাঠির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০০৯, পটুয়াখালি জেলার ১৯৯৯, বরগুনা জেলার ২০০৮, ভোলা ২০০৭ এবং পিরোজপুর জেলা কমিটি ২০০৫ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে।

মহানগরের নাম                                   সর্বশেষ কমিটি                                               মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ

রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগ                   ১৯৯৭                                                              ২০০০
রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগ                       ২০১০                                                              ২০১৩
বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগ                      ২০১২                                                             ২০০৮
খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগ                        ২০০৪                                                               ২০০৭

ঢাকা বিভাগের ময়মনসিংহ জেলার ২০০৭ সালে, জামালপুরের ২০০৬ সালে, কিশোরগঞ্জ ২০০০ সালে, নেত্রকোনা ২০০৭ সালে, নারায়গঞ্জে ২০০৪ সালে, শেরপুরে ২০০৬ সালে, গাজীপুরে ২০০৬ সালে, নরসিংদীতে ২০০৭ সালে, টাঙ্গাইলে ২০০৭ সালে, রাজবাড়িতে ২০০৭ সালে, গোপালগঞ্জে ২০০৭ সালে, ফরিদপুরে ২০০৮ সালে এবং শরিয়তপুরে ২০০৫ সালে জেলা কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে।

খুলনা বিভাগের খুলনা, নড়াইল, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা জেলার ২০০৭ সালে এবং মাগুরা, যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদাহ, বাগেরহাট ও মেহেরপুর জেলার ২০০৮ সালে মেয়াদ শেষ হয়।

সিলেট বিভাগে সিলেট জেলার ২০১৪ সালে মেয়াদ শেষ হবে। এছাড়া মৌলভীবাজার জেলার ২০০৯ সালে এবং সুনামগঞ্জ জেলার ২০০০ সালে জেলা কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে।

উপজেলা কমিটি 

উপজেলা কমিটির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। শতকরা ৯০ ভাগ উপজেলা কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০০৭-০৮ সালে।

[বিঃদ্রঃ কমিটি গুলোর তথ্য সর্বশেষ সেপ্টেম্বর ২০১৪ পর্যন্ত]


অতএব, দেখা যায়, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বিশৃঙ্খল এবং অগোছালো। বলা যায় সরকার হিসেবে আওয়ামী লীগ খুবই সফল তবে দল হিসেবে একেবারেই ব্যর্থ। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা প্রায় তিন যুগ ধরে একাই লড়ছেন।

আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ

আওয়ামী লীগের ৬৪ বছরের পথ পরিক্রমায় অনেক গৌরবজ্জ্বল অধ্যায় রচিত হয়। আবার ঠিক তেমনি তার দূর্বলতা এবং ব্যার্থতায় সমগ্র জাতি ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

দলের বর্তমান সভাপতি এবং মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা ৩৩ বছর ধরে আন্দোলন, সংগ্রাম, জেল-জুলুম, জীবনের উপর আক্রমণ, শত শত সহকর্মীর মৃত্যু, অজস্র রক্তপাত- এসব পেরিয়ে তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করেছেন। তাঁর সাহস, দূরদর্শিতা, ধীশক্তি, প্রজ্ঞা এবং ধার্মিকতা তাকে একক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে। সরকার পরিচালনায় তাঁর মেধা ও মনন দেশের জন্য আপরিসীম কল্যান বয়ে আনছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু দলের জন্য তা শুভ হয় নি। দলের অভ্যন্তরে ব্যক্তি পুজা, গোষ্ঠি স্বার্থ এবং আমলাতান্ত্রিক স্বৈরাচারী ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে।

তিনি দিকভ্রষ্ট একটি জাতীকে প্রথমবারের মতো একটি দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য নির্দেশ করেছেন, ভিশন ২০২১। কিন্তু তার এই ভিশন ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার মতো কর্মী বাহিনী তার নেই! 

নির্বাচন পূর্ববর্তী সহিংস রাজনীতি মোকাবেলায় তাকে সরকারী বাহিনীগুলোর সাহায্য নিতে হয়েছে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ছিলো সম্পূর্ন অনুপস্থিত।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতার মরদেহ যখন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির সিঁড়িতে বাংলাদেশের মানচিত্রের মতো পড়ে ছিলো, ঠিক তখন আওয়ামী লীগের শতাধিক এমপি বঙ্গভবনে মোশতাকের সঙ্গে চা পান করছিল। ২০০৭ সালের ১/১১’র সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে মাইনাস করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। আর এতে জড়িত ছিলেন দলেরই ক’জন সিনিয়র নেতা।

এসব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে দলকে এবং দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের এখনই উচিত দলকে তৃণমূল পর্যায় থেকে ঢেলে সাজানো।

ভবিষ্যতের সুদৃঢ় ভীত রচনার জন্য যে সকল পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন-

১। দলের তহবিল পরিচালনায় স্বচ্ছতা আনয়ন এবং বাৎসরিক অডিটের ব্যবস্থা করা।

২। বঙ্গবন্ধুর সময়ের ন্যায় পার্টির সদস্য চাঁদা নির্ধারণ এবং তা আদায়ের মাধ্যমে দলীয় তহবিল গঠন।

৩। দুর্নীতির অভিযোগে দুষ্ট ব্যক্তিদের বিভিন্ন পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া। প্রয়োজনে দল থেকে বহিস্কার করা।

৪। দলে আভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চা করা। সকল স্তরে কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন করা।

৫। কাউন্সিল বা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা প্রতিষ্ঠা করা এবং কালো টাকার ব্যবহার বন্ধ করা।

৬। দলে তরুণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে ত্যাগ তিতিক্ষার পাশাপাশি বংশ মর্যাদা, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অর্থনৈতিক  অবস্থা বিবেচনা করা।

৭। দলের রাজনৈতিক মোটিভেশন ব্যবস্থা চালু করা এবং লেখাপড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুস্থ রাজনীতির চর্চা করা।

৮। দলের ত্যাগী এবং সুস্থ কর্মীদের তালিকা প্রণয়ন করা দলের তরফ থেকে বিভিন্নরূপে সাহায্য সহযোগীতা করা।

৯। দলের সহযোগী সংগঠনসমূহকে বিন্যস্ত করা এবং তাদের কর্মপন্থা ঠিক করে দেওয়া।

১০। দলের নীতি আদর্শ, ম্যানিফেস্টো- এসব দীলয় কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক প্রচার এবং মোটিভেশনের ব্যবস্থা করা।

অধিকিন্তু দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা কিংবা দলীয় সভানেত্রী ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে ওঠার কাজে সাহায্য করা এবং দেশে একটি সহনশীল মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা।

যদি বলি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আওয়ামী লীগের মূলমন্ত্র তবে বর্তমান আওয়ামী লীগ সেই আদর্শ থেকে যোজন যোজন দূরে। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষাণী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এ দলটির ইতিহাস বাংলা এবং বাঙালির ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে এই দলটির হাল ধরেছিলেন বর্তমান সভানেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি শক্ত হাতেই হাল ধরেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হয়, তারপর?

আসুন আমরা ভালোর জন্য প্রার্থনা করি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত