সামরিক পোষাক থেকে প্রেসিডেন্টের রাজমুকুট

প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০১৯, ১২:৫১

বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি (১৯৮৩-১৯৯০) হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলার দিনহাটায় জন্মগ্রহণ করেন। সেখানেই তিনি মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তার ভগ্নিপতি সিরাজুল হক ছিলেন রংপুরের ইন্সপেক্টর অব স্কুলস। সে সুবাধে রংপুরে তিনি প্রায়ই আসা যাওয়া করতেন। উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নের জন্য ১৯৪৬ সালে এরশাদ রংপুরের কারমাইকেল কলেজে ভর্তি  হন। থাকতেন  জিএল হোস্টেলে। তবে তার-বার মা সহ অন্যরা তখন কুচবিহারেই থাকতেন।

এদিকে ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির সময় কোচ বিহার করদ মিত্ররাজ্যের স্বীকৃতি পায়। কোচবিহারের শাসক ছিলেন মাহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ বাহাদুর। ১৯৪৯ সালে মহারাজা ও ভারত সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে কোচবিহারের শাসন ব্যবস্থা একজন চিফ কমিশনারের হাতে ন্যস্ত করা হয়। চিফ কমিশনার নিযুক্ত হন ভিআই নান্নাজাপ্পা। ১৯৫০ সালে পশ্চিমঙ্গের একটি জেলায় পরিণত হয় কোচবিহার।

কুচবিহারের ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদানের বিষয়ে স্থানীয় জোতদারদের সমন্বয়ে গঠিত কোচবিহার স্টেট কাউন্সিলের সভায় প্রচণ্ড মতবিরোধ তৈরি হয়। ওই সময়ে স্টেট কাউন্সিলের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত ‘হিতসাধনা সভা’ কোচবিহারের প্রতিটি থানায় সভা-সমিতির মাধ্যমে ভারতবিরোধী প্রচারণা চালানো হয়। এ সময় নৈরাজ্য তৈরীর অভিযোগে এরশাদের বাবা মকবুল হোসেনসহ বেশ কয়েকজনকে সাময়িক সময়ের জন্য কোচবিহার থেকে বহিষ্কার করা হয়।

এরপর মকবুল হোসেন তার স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে রংপুর চলে আসেন। অপর বহিষ্কৃতরা পরবর্তীতে কোচবিহারে ফিরলেও মকবুল হোসেন থেকে যান রংপুরেই। ১৯৫০ সালে ভূমি ক্রয়সূত্রে তাদের ঠিকানা হয় রংপুরের  নিউ সেনপাড়ায় (স্কাইভিউ)।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৪৮ সালে কারমাইকেল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ১৯৫০ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। তিনি ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অফিসার পদে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৬০-৬২ সালে তিনি চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে অ্যাডজুট্যান্ট ছিলেন।

এরশাদ ১৯৬৬ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটায় অবস্থিত স্টাফ কলেজে স্টাফ কোর্স সম্পন্ন করেন। তিনি ১৯৬৮ সালে শিয়ালকোটে ৫৪তম ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি লাভের পর ১৯৬৯-৭০ সালে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে এবং ১৯৭১-৭২ সালে সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করেন।

পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৭৩ সালের ১২ ডিসেম্বর কর্নেল পদে এবং ১৯৭৫ সালের জুন মাসে ব্রিগেডিয়ার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। একই বছর তিনি ভারতের ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে প্রতিরক্ষা  কোর্সে অংশগ্রহণ করেন। ওই বছরই আগস্ট মাসে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে তাঁকে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান নিয়োগ করা হয়। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এরশাদকে সেনাবাহিনী প্রধান পদে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং ১৯৭৯ সালে তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।

১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ডের পর থেকেই সংবাদপত্রে বিবৃতি ও কভারেজের মাধ্যমে রাজনীতিতে এরশাদের আগ্রহ প্রকাশ পেতে থাকে। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে অস্ত্রের মুখে উৎখাত করে জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন। তিনি দেশের সংবিধানকে রহিত করেন, জাতীয় সংসদ বাতিল করেন এবং সাত্তারের মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করেন। তিনি নিজেকে দেশের সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করেন, যে সাংবিধানিক পদটি একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানেরই প্রাপ্য ছিল। তিনি ঘোষণা করেন যে ভবিষ্যতে সামরিক আইনের অধীনে জারিকৃত বিধিবিধান ও আদেশই হবে দেশের সর্বোচ্চ আইন এবং এর সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ সকল আইন অকার্যকর হবে।

এরপর এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৭ মার্চ বিচারপতি আবুল ফজল মোহাম্মদ আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত করেন। কিন্তু বিচারপতি চৌধুরীর কোনো প্রকার কর্তৃত্ব ছিল না, কারণ ঘোষিত সামরিক আইনে সুনির্দিষ্টভাবে বলা ছিল যে সিএমএলএ’র উপদেশ বা অনুমোদন ব্যতীত প্রেসিডেন্ট কোনো ক্ষমতা প্রয়োগ বা কোনো ভূমিকা পালন করতে পারবেন না। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (সিএমএলএ) হিসেবে দেশ শাসন করেন। এরপর তিনি রাষ্ট্রপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণ করে ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন বর্জনের মধ্যে ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে আয়োজিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরশাদ তার জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে পাঁচ বছর মেয়াদকালের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এর আগে কারচুপির মধ্যে অনুষ্ঠিত মে-১৯৮৬ সালের সংসদীয় নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হয়ে এরশাদ ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর তৃতীয় জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশন আহবান করে সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী আইন পাশ করেন। এর মাধ্যমে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ক্ষমতা দখলসহ সামরিক আইন ও বিধিবিধান দ্বারা সম্পাদিত সকল কাজ ও পদক্ষেপকে বৈধতা দেওয়া হয়। তবে বিরোধী দলের প্রবল আন্দোলনের মুখে ১৯৮৭ সালের ৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি এরশাদ তৃতীয় জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করতে বাধ্য হন। প্রধান বিরোধী দলগুলো ১৯৮৮ সালের তেসরা মার্চে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনও বর্জন করে। এরশাদের অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রবল গণঅভ্যুত্থানের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ক্ষমতা হারানোর পর এরশাদ গ্রেফতার হন এবং ছয় বছর কারারুদ্ধ থাকার পর ১৯৯৭ সালে তিনি জামিনে মুক্তি পান।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত