সেলিম আল দীন: বাংলা নাটকের ভিন্ন ধারার কারিগর

প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০১৬, ১১:০৬

দীপংকর গৌতম

সেলিম আল দীন। বাংলা নাটককে যিনি প্রচলিত ধারা থেকে বের করে এনে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংমিশ্রণে নবরূপে ও ভিন্নমাত্রায় প্রাণবন্ত করেছিলেন। তার অভিসন্দর্ভ ‘মধ্যযুগের বাঙলানাট্য’ পাঠ করলে নাটক সম্বন্ধে চিরাচরিত নিয়ম ভেঙে যায়। পাঁচালীরীতিতে লেখা তার নাটক বাংলায় নতুন না হলেও উপস্থাপন রীতি প্রসেনিয়াম নাটকে প্রথম বৈকি। তার কোন নাটকের মঞ্চ কেমন হবে তা আগে কখনোই বোঝা যেত না। এই প্রথা ভাঙ্গতে তাকে বহু বাধা অতিক্রম করে আসতে হয়েছে। নীরিক্ষাধর্মী কাজের ক্ষেত্রে আলোচনা কিংবা সমালোচনা থাকে, তার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। প্রজ্ঞা, চিন্তার প্রগ্রসরতা তাকে সেই পথ পেড়িয়ে আসতে সাহায্য করেছে। তাছাড়া নাটক ছাড়া ভিন্ন কোন চিন্তা না থাকার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে।

তার রচিত ‘বনপাংশুল’-এর প্রথম প্রদর্শনী দেখার অভিজ্ঞতা আমাকে আজও আন্দোলিত করে। মঞ্চে এবং দর্শক বসার একাংশ মিলে সব পাত্রপাত্রী বসে আছে। এর মানে হলো, রুমটাকেই মঞ্চ করে ফেলা হয়েছে। প্রথা ভাঙার এ সাহস ও যোগ্যতা সেলিম আল দীন অর্জন করেছিলেন। মান্দি সম্প্রদায় তার ‘বনপাংশুল’ নাটকের উপজীব্য। নাটকের অনেক বক্তব্য এখনও আমার কানে অনুরণনিত হয়। আমিও তখন পত্রিকার জন্য মান্দি সম্প্রদায়ের জীবনযাপনের উপর কাজ করতে সখীপুর-বাসাইল-মধুপুর ঘুড়ে বেড়াই। নাটক দেখার পর নাটকের কিছু বিষয় নিয়ে আমি লিখেছিলাম। স্যার ‘আজকের কাগজ’ অফিসে গিয়ে আমাকে খুঁজে বের করেছিলেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন। সেদিন থেকেই আমি তার ভক্ত। তার সঙ্গে কথা বললে বোঝা যেত ভেতরে আগুনের তেজ।

‘চাকা’ তারই আরেকটি সৃষ্টি। সেখানে তিনি বলেছেন, মানুষের কোন আলাদা পরিচয় ও ঠিকানা নেই। এই পরিচয় ও ঠিকানা না থাকলে তার জাতও থাকে না। ‘চাকা’র শেষ দৃশ্যে আমরা দেখি- যখন মৃত মানুষটার ঠিকানা পাওয়া গেল না তখন তাকে মাটি ফেটে তৈরি হওয়া গর্তে ফেলে দেয়া হয়। সেলিম আল দীনের প্রাতস্বিকতা এখানেই। একইভাবে ‘নিমজ্জন’ নাটকে যখন বলা হয়- ‘তোমার সম্মুখে অনন্ত মুক্তির অনিমেষ ছায়াপথ। তোমার দুই হাতেই তো ধরা ওই দূর নীলাভ্রের ছত্রদণ্ড। দুই কানে কালাকালের বিস্তারিত সমুদ্রের উদ্বেলিত আহ্বান। পাঠ করো, পাঠ করো অন্ধকারের নিঃশব্দ নিশিলেখা। সেইখানে বোধিদ্রুম। পাঠ করো নতুন কালের গ্রন্থ। চলো মানুষ। চলো নতুন ভাবনাভূমিতে নব্যকালের নিশ্চিত গ্রহভূমিতে। আলোহীন উল্কাপিণ্ডের গায়ে সঙ্গীতের সুর লিখে দাও রাষ্ট্রহীন দেশহীন কালহীনতার আনন্দিত সর্বমানবের মিলিত উৎসবের ভাষায়। ধূমকেতুর জলন্ত পুচ্ছে ঢেলে দাও সুগন্ধের নির্যাস। চাঁদ চাষ করো। কার্পাস তুলার চাষ। সেই কার্পাসের পোশাক হোক সকল মানুষের সৌরযাত্রার বসন। চলে মানুষ চলো।’ তখন মানুষ ছাড়া আর কে দাঁড়ায় সামনে?

‘নিমজ্জন’ নাটকের শেষের দৃশ্যে ঢাকা থিয়েটারের তরুণ নাট্যকর্মীরা মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে বিস্তারিত দিগন্তের দিকে চেয়ে সমবেত কণ্ঠে যখন উপরোক্ত সংলাপগুলো উচ্চারণ করেন, তখন দর্শকদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে গণহত্যাহীন এক স্বপ্নীল ভুবন, সৌরলোকের শান্ত-সুনিবিড় কোনো এক গ্রহ। মনে হয়, এসব কথা যেনো কোনো নাটকের সংলাপ নয়, চিরায়ত মহাকাব্যের অপূর্ব পঙ্‌ক্তি। যে পঙ্‌ক্তি মানুষের ভেতর এক ভিন্নতর বোধ ও ভাবনার জন্ম দেয়, জন্ম দেয় এক অপার্থিব পবিত্রতার।

আচার্য সেলিম আল দীন তার ‘নিমজ্জন’ নাট্যের হৃদয়নিঃসৃত এই পঙ্‌ক্তির মাধ্যমে এক আশ্চর্য অভিনব কাব্যিক অভিজ্ঞতায় পৃথিবীর গণহত্যার ইতিবৃত্ত রচনা করেছেন। প্রাচীণ থেকে মধ্যযুগ ও আধুনিক কালে বিশ্বে ঘটে যাওয়া গণহত্যার লোমহর্ষক বয়ান তার ‘নিমজ্জন’ নাটক। এ নাটকের মধ্য দিয়ে সেলিম আল দীন মানুষকে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।

তার দ্বৈতাদ্বৈতবাদের প্রকৃত ব্যাখ্যায় যদি যাই তাহলে দেখি বিষয়টি তিনি ব্যাখ্যা করেন এভাবে : ‘গ্রিক রিচুয়াল থেকে যদি গ্রিক ট্র্যাজেডির জন্ম হতে পারে এবং তা নিয়ে উত্তরকালে শিল্পতত্ত্ব রচিত হয়, তবে প্রাচ্যেও ধর্মতত্ত্ব থেকে কেন শিল্পতত্ত্ব অনুসৃত হবে না বা হতে বাধা কোথায়? তুরস্ক, ইরাক, ইরানের সুফি তত্ত্বের ধারায় বাংলায় চৈতন্যদেব ‘অচিন্ত্য দ্বৈতাদ্বৈতবাদ’ নামে যে বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বের প্রচলন করেন, আমি তাকেই আধুনিক কালের করে তুলেছি।...বস্তুতপক্ষে দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্বের আবিষ্কারের পরে বা ওই শিল্পতত্ত্বের প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস জন্মানোর ফলে আমি চলতি অর্থে নাটক লিখি না। আমার লেখাগুলো ঐতিহ্যবাহী বাংলা পাঁচালি ও কথকতার ধারায় সমকালীন প্রয়াস।’

সেলিম আল দীন দ্বৈতাদ্বৈতবাদে বিশ্বাসী হলেও পরে তিনি নিজস্ব এক নাট্যরীতির উদ্ভাবন করেন যার নাম ‘ফোররিয়ালিজম’। এই দর্শনের মধ্য দর্শনের এক স্বার্থক নান্দনিক রূপ এ-নাটক। পাশ্চাত্য সভ্যতা, সাম্রাজ্যবাদের হাতের গুটিতে যেমন উঠে আসছে আণবিক অন্ধকার। সভ্যতার মধ্য দিয়ে মানুষের এই বিনাশী আয়োজনের অশুভ যান্ত্রিক বুদ্ধিতে সৃষ্ট দুটি বিশ্বযুদ্ধের অভাবিত সর্বনাশের ইঙ্গিত রয়েছে এ নাটকে। তথাকথিত সভ্যতা কীভাবে গণহত্যার মাধ্যমে বিশ্বকে অনিশ্চিত ধ্বংসের পথে নিয়ে চলেছে, তার একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে এ নাটক। এ নাটকের মধ্য দিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়, যাদের যত গণহত্যা করার শক্তি বেশি তারা সবচেয়ে বেশি সভ্য। এই অসভ্যতাকে সভ্য বলে যারা বিশ্বে ডামাডোল পেটাচ্ছে আর হত্যা-খুন করে বেড়াচ্ছে, অন্যকে করতে প্ররোচিত করছে তাদের প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠেছে সেলিম আল দীনের নাটকে। ‘নিমজ্জন’-এ বিবৃত হয়েছে বিশ্বে গণহত্যার চিত্র। বাংলা ভাষায় এ সম্পর্কিত এই মাত্রার রচনা দ্বিতীয়টি আছে বলে আমাদের জানা নেই। অর্থাৎ এটি একটি অদ্বিতীয় নাটক। এ নাট্যরীতিতে দ্বৈতাদ্বৈতবাদের সমর্থক সেলিম আল দীন একটি নতুন শিল্পপরিভাষা কিংবা শিল্পতত্ত্ব যুক্ত করেছিলেন, যা ফোররিয়ালিজম বা ‘সম্মুখবাস্তববাদ’ নামে পরিচিত। তার উপখ্যানধর্মী নাটক ‘স্বর্ণবোয়াল’। এ নাটকের প্রধান চরিত্র খলিশা মাঝি হলেও নাটকটিতে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সী’ উপন্যাসের ছায়া বিম্বিত হয়। তখন সান্তিয়াগোকে মনে হয় খলিশা মাঝি। আর এর মধ্য দিয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যে সম্মিলন লক্ষ্য করা যায় তা সেলিম আল দীনের নাটকের চিরায়ত ফর্ম ভাঙ্গার ঢং হলেও বিষয়টি অন্যান্য নাটকের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা।

খলিশা মাঝি এ অঞ্চলের সবচেয়ে কৃতী মৎস্যশিকারী। তার আজন্মের স্বপ্ন স্বর্ণবোয়াল শিকার করবে। কিন্তু সে তা পারে না। তার পিতারও একই খোয়াব ছিল। সেই খোয়াবে ভাসতে ভাসতে ডিঙ্গিসহ ডুবে মারা যায় তার পিতা। খলিশা মাঝির ছেলে তিরমন। বংশপরম্পরায় তার ভেতরও স্বর্ণবোয়াল শিকারের নেশা। কেউ বলে স্বর্ণবোয়াল বলে কিছু নাই, কেউ বলে আছে। এই আছে ও নাই এর দ্বন্দ্ব চলে সমগ্র নাটকে। এক রাতে স্বর্ণবোয়াল ধরা দেয় তিরমনের হাতে। রাতভর মাছটিকে ডাঙায় তোলার প্রাণপণ চেষ্টা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর সম্ভব হয় না। বিজয়ের পরিবর্তে লড়াইটাই তখন মুখ্য হয়ে ওঠে। শিকার ও শিকারির সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রকৃত অর্থে কারও বিজয় না হলেও পরাজয় ঘটে না।

গদ্য-পদ্যের বিভাজন স্বীকার করতেন না সেলিম আল দীন। নিজের রচনাকে দাবি করতেন ‘ননজেনরিক’ বলে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘আমি সব সময় চেয়েছি আমার লেখা নাটকগুলো নাটকের বন্ধন ভেঙে অন্যসব শিল্পতীর্থগামী হোক। কারণ শিল্পে আমি দ্বৈতাদ্বৈতবাদী।’

প্রজ্ঞা, মেধা, মনন ও দক্ষতায় যে ক’জন নিরলস সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আমাদের সহজিয়া লোকজ বাংলার উর্বর সংস্কৃতিকে বহুমাত্রায় বহুদূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন নাট্যকার সেলিম আল দীন ছিলেন তাদের ভেতর অন্যতম। বাংলার হাজার বছরের পুরনো লোকজ উপাদান ব্যবহার করে এই ব-দ্বীপের পোড় খাওয়া, চির সংগ্রামী, সরল, স্বাধীনচেতা, আত্মনির্ভর, নির্ভিক, সাহসী মানুষদের জীবনকাব্যের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি অত্যন্ত সাবলীলভাবে সেলিম আল দীন তার প্রতিটি নাটকের প্রতিটি দৃশ্যে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। চরিত্রের এই যুক্তিসংগত গ্রহণযোগ্যতার কারণেই নাটক তখন শুধুই নিছক মঞ্চের ভাষা হয়ে থাকেনি, তার নাটকের প্রতিটি সংলাপ জীবন সংগ্রামের প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে যুক্ত।

এরিস্টটল নাটক সম্পর্কে বলেছিলেন, মানুষের জীবনের সাথে প্রকৃতি জড়িয়ে রয়েছে। আর সে কারণেই মানুষ প্রকৃতসৃষ্ট এক উন্নত মননপুষ্ট প্রাণী। তার জীবনের অপার চাহিদা হলো সমাজ বদল করা। মরা-চেপড়া সমাজ তার কখনোই পছন্দ নয়। সমাজ বদলের জন্য মননশীলেরাও বেছে নেয় যেসব সাংস্কৃতিক মাধ্যম, নাটক তার মধ্যে অন্যতম। জীবনের অপার চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা-ভালোবাসার অণু-পরমাণুর বাস্তব-অবাস্তব প্রতিফলন হলো নাটক। আর সে কারণেই জীবনের দিনলিপির আয়নায় এই নাটকের প্রতিটি চরিত্র আমাদের সামনে ধরা দেয় বহুরূপী হয়ে। আমরা যারা সমাজবদ্ধ জীব এবং আমাদের তৈরি এই সমাজকে আঁকড়ে ধরেই যখন আমাদের বাঁচা-মরার হিসেব-নিকেশ তখন আমরা জড়িয়ে পড়ি প্রতিদিনের জীবনের সাথে এক অস্তিত্বের লড়াইয়ে।এ বড়াই কি শ্রেণী সংগ্রাম? যদি শ্রেণী সংগ্রাম নাও হয়, তবুও সংস্কৃতির বিকাশমান মাধ্যমের কারণে নাটক সবার অজান্তেই শ্রেণী সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে উঠবে- এর কোন বিকল্প নেই। কারণ শ্রেণীকে বদলাতে হলে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বিকল্প নেই। বিকল্পহীন লড়াই আর সে কারণেই সেলিম আল দীন ধীরে ধীরে জায়গা করে নেন বাংলার প্রতিটি আঁকা-বাঁকা প্রান্তরে, নোনা জল হয়ে হাঁটে-মাঠে-ঘাটে, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের মানুষের হৃদয়ের গহীনে।

নাট্যাঙ্গণে যারা জীবন ঘষে আগুন জ্বালায় সেলিম আল দীন তাদের মধ্যে সম্পূর্ণ আলাদা। নাট্যজগতে তিনি যে আলোর মশালের প্রজ্জ্বলন ঘটিয়ে ছিলেন তা জ্বলবে যুগের পর যুগ। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে এখন পৌঁছে যাচ্ছে নাটক। এসব স্বপ্ন দেখেই তিনি দীপ্র আলোকদ্যুতি জ্বেলেছিলেন। আজ এই নাট্যাচার্যের জন্মদিনে আমাদের গভীর প্রণতি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত