জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ

প্রকাশ : ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১২:৩৭

১.
সত্তরের দশকের শুরুতে বাংলাদেশে বিমূর্ত চিত্রকলার যে দুর্বোধ্য পর্বের সূচনা, তার সঙ্গে গাঁটছড়া না বেঁধে যিনি চিত্রকলায় নির্মাণ করেন স্বকীয়শৈলী যার ভিত্তিতে রয়েছে শরীরী প্রকাশভঙ্গি, তিনি শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ। তাঁর এই চরিত্রশৈলী বাংলাদেশের পরবর্তী প্রজন্মকে আকৃষ্ট করে প্রচণ্ডভাবে। যার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে আমাদের পরবর্তীকালের চিত্রকলায়। শাহাবুদ্দিন আহমেদ বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আবির্ভূত বিখ্যাত বাঙালি চিত্রশিল্পী। শাহাবুদ্দিন, যিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, চিত্রকলায় তার পরিচয় সংগ্রামী মানুষের প্রতিকৃতিতে দুর্দমনীয় শক্তি ও অপ্রতিরোধ্য গতির ইঙ্গিতময় অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলার জন্য। ১৯৫০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। জীবন্ত কিংবদন্তি এই শিল্পীর জন্মদিন আজ। বাঙালির গর্ব শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমদের জন্মদিনে জানাই ফুলেল শুভকামনা ও শ্রদ্ধা। 

২.
চিত্রশিল্পী হিসেবে যে কজন বাঙালি কৃতী সন্তান বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ তাঁদের অন্যতম। বিশ্বব্যাপী যার পরিচয় আন্তজার্তিক খ্যাতি সম্পন্ন একজন বাঙালি চিত্রশিল্পী হিসেবে।১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কলেজ অব ফাইন আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস থেকে বিএফএ ডিগ্রি সম্পন্ন করার পর ১৯৭৪ সালে বৃত্তি নিয়ে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান ফ্রান্সে। সৃজন-প্রতিভার গুণে সেখানেই তিনি একটি বলিষ্ঠ অবস্থান করে নেন। অব্যাহত চর্চায় ও শিল্প উৎকর্ষে তিনি শিল্পানুরাগীদের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হন। তাঁর ছবিতে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ ও শৌর্য বিশেষ মর্যাদায় প্রতিফলিত হয়েছে। দেশ-বিদেশে তিনি প্রচুর প্রদর্শনীতে অংশ নেন এবং উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। ২০০০ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত এই কীর্তিমান বাঙালি শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমদকে ফরাসি সরকার তাদের সংস্কৃতিতে, চিত্রকর্মে অসামান্য অবদান ও অঙ্গীকারের জন্য সেদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব Knight in the order of Arts and literature সম্মানে ভূষিত করেছে।

৩.
ইতিহাসের পানে তাকিয়ে আমরা জানতে পারি, মানুষ প্রকৃতিগতভাবে সৃজনশীল। প্রত্নতত্ত্ববিদগণের আবিষ্কারে প্রাচীন যুগের মানুষের অঙ্কিত গুহাচিত্র এবং পশুর হাড় ও শিং থেকে নির্মিত মানুষ ও জীবজন্তুর মূর্তিসহ বিবিধ শিল্পনিদর্শনের দেখা মেলে। ধারণা করা হয়, শিল্পকলার উদ্ভব হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার বছর আগে। ‘হোমো স্যাপিয়েন্স’ মানুষ তার চারপাশে যা দেখেছে তা-ই তার শিল্পমাধ্যমে ধরে রাখার চেষ্টা করে গেছে। একজন শিল্পী, কবি বা সৃজনশীল যে-কোনো মানুষ নিজের ভেতর যুগপৎ ধারণ করে সাধারণ ও অসাধারণ দুটি সত্তা। সাধারণ সত্তাটি পৃথিবীর তাবৎ মানুষের মতো জীবনচক্রের অমোঘ নিয়মে পরিচালিত হয়। অন্যদিকে অসামান্য সত্তা আমৃত্যু মগ্ন থাকে আত্মানুসন্ধানে। দুটি সত্তার পার্থিব ও অপার্থিব প্রত্যাশার হিসাব-নিকাশ এবং অন্তর্দ্বন্দ্বও কম নয়। বস্ত্তত আত্মানুসন্ধানের যাতনায় মানুষ শিল্পী হয়ে ওঠে। যাতনা থেকেই উদ্ভূত হয় প্রকৃত শিল্প।

৪.
শাহাবুদ্দিন আহমেদ, আন্তর্জাতিক অঙ্গনের উজ্জ্বল বাঙালি চিত্রশিল্পী। তার ক্যানভাস যেন নিরন্তর এক গতিময়তার প্রতীক। গতিময়তার চিত্রকর শাহাবুদ্দিন নবীন শিল্পীদের কোন কোন বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত নিয়ে বলতে গিয়ে বলছেন অসাধারণ কথাটি, ‘নবীন শিল্পীদের গুরুত্ব দেওয়া উচিত গভীরভাবে শিক্ষায়। শিক্ষা মানে এই নয় যে ইউনিভার্সিটিতে পড়া। প্রকৃত শিল্পীর তিনটি গুণ থাকতেই হবে। তা হলো- সততা, একাগ্রতা এবং সাধনা। এর বাইরে শিল্পী হওয়া সম্ভব নয়।’ আর তাই বিশ্ব শিল্পকলায় একদিন নেতৃত্ব দেবে বাংলাদেশ, বাংলার তরুণ শিল্পীরাই একদিন জয় করবে বিশ্বকে। এই স্বপ্নই বুকে গভীরভাবে লালন করেন বাংলার এই বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর। আবার প্রখর রাজনীতিসচেতন এই শিল্পী আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের ভূমিকা বিষয়েও বলছেন অসাধারণ কথা, ‘আমি বলতে চাই, আপনাদের দ্বন্দ্বের কারণে দেশ যাতে পিছিয়ে না যায়। এগিয়ে যাওয়ার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। অথচ এমন সব ঘটনা ঘটছে, তার জন্য আমি গভীরভাবে আঘাত পাচ্ছি। এই আঘাতের চিহ্ন আমার ছবির ভেতর ঝলসে উঠছে। আপনারা হয়তো লক্ষ করেছেন। একা পথ চলা যায় না। দীর্ঘ পথে যারা দৌঁড়ায় বা সাইকেল চালায় দেখবেন রাস্তার দুপাশ থেকে তাদের পানি বা বরফ দিয়ে সহযোগিতা করা হয়। এসব আমাদের নেই, দৌড়াতে গিয়ে এসব আমি পাচ্ছি না। ফলে গন্তব্যে পৌঁছানো কঠিন হয়ে যায়।’

৫.
বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি শিল্পী বুকে ধারণ করে আছেন। শাহাবুদ্দিন বীর পূজারি। বীরের মধ্যে যে অপরিমেয় শক্তি রয়েছে তা কী করে প্রমাণ করা যায় তার পরীক্ষায় তিনি লিপ্ত হয়েছেন। তিনি বারবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আঁকছেন। এবং তিনি আরও অনেক দেশপ্রেমিকের মতো নির্দ্বিধায় স্বীকার করেন শেখ মুজিবুর রহমান জাতির জনক। জনসভায় দাঁড়ানো উত্তোলিত বাহুর মহানায়ককে তিনি বহুবার চিত্রিত করেছেন। গুলিবিদ্ধ মহানায়ক, বেদনামথিত ও যন্ত্রণায় কাতর বঙ্গবন্ধুও তার ছবির বিষয় হয়েছেন। বিচিত্র অভিব্যক্তিতে ইতিহাসের মহানায়ককে এঁকে তিনি তার সন্দর্ভ রচনা করে চলেছেন। পিতার স্মৃতি, ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত অধ্যায়কে শিল্পী ক্যানভাসে তুলে আনেন রক্তাক্ত নিথর বঙ্গবন্ধুর দেহের উপস্থাপনের মাধ্যমে। ধবধবে সাদা ক্যানভাসের অধিকাংশ স্পেস শূন্য কিন্তু গতানুগতিক নয়। বাঙালির পিতৃত্বের শূন্যতার সাথে রক্তাক্ত একটি অধ্যায়কে শাহাবুদ্দিন আমাদের বার বার মনে করিয়ে দেন। শেকড়ের মমতামাখা লাল-সবুজ শিল্পীর প্রধান রঙ। দেহাবয়ব কখনও রক্তস্নাত, কখনও সবুজে আবৃত যোদ্ধার অবয়ব দর্শক মনে বাঙালিয়ানাকে নাড়া দেয়। প্যারিসে অবস্থানকালীন সময়ে তাঁর আঁকা ছবিতে মুক্তিযুদ্ধ, যোদ্ধা মানুষ, ধাবমান মানুষের গতির উপস্থিতি অব্যাহতভাবে উপস্থিত হতে থাকে। প্যারিসের মতো শিল্পের তীর্থস্থানে নিজের উপস্থিতি জানান দেন নিজের শিল্পনৈপুণ্যের মাধ্যমে। ব্রাশের দ্রুত চলাচল, বিষয়ের মাঝে গতির স্ফুরণ, রেখা আর রঙের গতিময় উদ্ভাসন গত ছয় দশকে শিল্পচর্চায় নিমগ্ন শিল্পী শাহাবুদ্দিনের শক্তির আরাধনাকে আমরা খুঁজে পাই। যুদ্ধদিনের দগদগে স্মৃতি, চেতনায় বাঙালিয়ানা, জয় বাংলা, বাংলার জয়, সবুজ হূদয় লাল সূর্য শাহাবুদ্দিনেরই বাংলাদেশ, আমাদেরই বাংলাদেশ।

৬.
শাহাবুদ্দিন একজন মুক্তিযোদ্ধা। এক সাক্ষাৎকারে সংশয়হীনকণ্ঠে বলেন ‘মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ আমার শিল্পকর্মের প্রেরণা’। আর তাই অন্য অনেকের মত শাহাবুদ্দিন সীমান্ত পাড়ি দেয়া কলমযোদ্ধা, শব্দযোদ্ধা বা তুলিযোদ্ধা নন। শাহাবুদ্দিন অস্ত্র হাতে শত্রুর সাথে লড়েছেন যুদ্ধের ময়দানে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে। প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে নেতৃত্ব দেন সম্মুখ সমরে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যার হৃদয়ে তার তুলিতেই তো মূর্ত হবে আমার প্রতিবাদ, আমার দ্রোহ। শাহাবুদ্দিন ক্যানভাসে ছবি আঁকেন, ক্যানভাসে কবিতা লেখেন, ক্যানভাসে যুদ্ধ করেন, মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে চান। তিনি মনে করেন, মানুষের মুক্তিযুদ্ধ আজো চলমান। তাই রং ও তুলির দ্বৈত অস্ত্র ব্যবহারের মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত তার চিত্রকলায় উঠে আসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। আর তাই ‘শুধু রং নয়-এখনো আমার ছবি থেকে বারুদের গন্ধ পাওয়া যায়’ বলেছেন শাহাবুদ্দিন। স্মৃতিতে ভাসে তার সেদিনের কথা। দিনটি ছিলো ৭ই মার্চ, ১৯৭১ সাল। তৎকালীন ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মুক্তিকামী লাখো জনতার সম্মুখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান শোনালের বাঙালি জাতীয় জীবনের সেই অনন্য কবিতা; ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা’। মুহূর্তেই উপস্থিত লক্ষ জনতা বঙ্গবন্ধুর কন্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গর্জে উঠলেন, বাংলার আকাশ বাতাস তখন একটি স্লোগানেই প্রকম্প্রিত, “জয বাংলা”। স্বাধীনতার এই আহবান শুধু উপস্থিত জনতাকে নয়, বরং এই আহ্বানের কবিতা জাগ্রত করেছিল ৭ কোটি বাঙালীর মুক্তির আকাঙ্খাকে। বঙ্গবন্ধুর এই কবিতা যাদের ঘরছাড়া করে স্বাধীনতার যুদ্ধে টেনে এনেছিলো শাহাবুদ্দিন আহমেদ তাদেরই একজন। আর এ কারণেই তিনি মনে করেন, ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের সঙ্গে বাংলাদেশের অস্তিত্ব জড়িত রয়েছে।আর সেজন্যই তিনি এটাকে বারবার খুব ইন্টারেস্টিং ওয়েতে আনছেন। এ বিষয়ে বলেছেন, ‘রাজনৈতিক কারণে অনেকে হয়তো অনেক কিছুই খোলামেলাভাবে বলতে পারেন না। এখন তো সেই সিচুয়েশন নেই। যুদ্ধ চলাকালীন, যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে এমন কেউ নেই যে জয় বাংলা বলেনি।’

৭.
বাংলাদেশের চিত্রকলায় কর্মঠ মানুষের রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি জয়নুলের প্রকাশবাদী আর সুলতানের ধ্রুপদী আঙ্গিকের অঙ্কনধর্মী চিত্রে। শাহাবুদ্দিনের মানুষেরা আরও কর্মঠ আরও গতিময়। গ্রিসের ভাস্কর্য আর রেনেসাঁর শিল্পীদের কাজে মানুষ তার প্রমাণ-মাপ ছেড়ে দীর্ঘতর হয় গতিময়তার জন্য। মানবদেহ তখন আঁকতে হয় অনেক মোচড় দিয়ে। জার্মান প্রকাশবাদী শিল্পীদের কাজে সঙ্কটাপন্ন মানুষের অ্যানাটমি চৌচির হয়ে গেছে। এসব অভিজ্ঞতার সারৎসার আমরা দেখি শাহাবুদ্দিনের কাজে। ফলে আমার স্বদেশের, আমার কাদামাটির শাহাবুদ্দিন তাঁর সৃজনের বলিষ্ঠতায় হয়ে উঠেছেন বৈশ্বিক। আমাদের আপন ঐতিহ্য আর অবস্থান অনুসন্ধান করতে গিয়ে শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের একেকটা ঐতিহ্য আছে। যেমন ধরুন ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার কথা। তাদের ফুটবল আছে, তাদের ম্যারাডোনা আছে। যেভাবে আমাদের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্গবন্ধু, জয়নুল, ড. ইউনূস বলেন, আর শাহাবুদ্দিন অথবা শামসুর রাহমান বলেন, একটা লেভেল আছে। আমাদের হয়তো ফুটবলার নেই, কিন্তু এগুলো আছে। সাহিত্যে ও আর্টে আমাদের এই ঐতিহ্য আছে। না হলে আমি এতদূর যেতে পারতাম না। হঠাৎ করে এসব হয় না কখনো। আমাদের ঐতিহ্যের ভেতর সেই মেধা বা ট্যালেন্ট আছে। সেদিন শাবানা আজমী ওই কথাটাই বললেন – এদেশে ট্যালেন্টেড পিপুল আছে। এটা গরিব বা ধনীর ব্যাপার নয়। এটা এখানে আছে। বিশ্বাঙ্গনে একটা অবস্থানে যেতে হলে অর্থনীতি, রাজনীতি, তারপর সামরিক ক্ষমতার উন্নতির একটা ব্যাপার লাগে। ওইসব ক্ষেত্রে আমরা বেশি এগোতে পারছি না, কিন্তু আমাদের মেধা-সংস্কৃতির ভেতর সেই উচ্চতা আছে। আমরা পটেনশিয়াল। একটা বেলুনকে যেমন ফুঁ দিয়ে বড় করা যায়, আমরা সেই রকম ফুঁ দিয়ে আমাদের অনেক মেধাকে বড় বানাতে পারছি না। মেধা বিকাশের পথে আমাদের রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। শক্ত বেলুনকে আমরা ফোলাতে না পেরে ফেলে দিচ্ছি। শিল্প বিকাশের জন্য যে শক্তি বা প্রণোদনা প্রয়োজন তা এখান থেকে দরকার। এই মাটি থেকে দরকার। তাই এখানে যে বিশৃঙ্খলা হয়, বাইরেও সেই বিশৃঙ্খলা দেখা যায়। আমি দৌড়াচ্ছি। কিন্তু পানি তো পাচ্ছি না। আমি থাকতে পারি প্যারিস, কিন্তু আমার তো নিজ মাটির আশীর্বাদ ও প্রেরণা দরকার। তারপরও আমাদের একটা অবস্থান আছে। শুধু পাক-ভারতের কথা বলছি না – আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আমাদের একটা ভালো অবস্থান আছে। তবে ইউরোপের তুলনায় আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। এখানে বাড়িয়ে বলে লাভ নেই। কারণ ইউরোপের ব্যাপারটা হলো কি, ওরা তো একজন নয়, দুজন নয় – প্রতিটা দেশে-জাতিতে ওদের বড়মাপের শিল্পী আছে। যেমন স্পেন, ইতালি, ফ্রান্স, পর্তুগাল বা হল্যান্ড, গ্রিস, ইংরেজ সবারই রয়েছে বড়মাপের শিল্পী। দে আর টেরিফিক। তাহলে সব মিলিয়ে তো ইউরোপ। ভেবে দেখুন। ওরা পর্তুগাল থেকে এক ঘণ্টায় পেইন্টিং নিয়ে আসে প্যারিসে। আমাদের মাঝে তো সেই নৈকট্য নেই। আমাদের পাশেই ভারত, নেপাল – আরো অন্যান্য দেশ রয়েছে যাদের ইতিহাস বা ঐতিহ্যগত মিল বা বন্ধন থাকলেও সাম্প্রদায়িক বিভাজনের কারণে আমাদের মধ্যে কনসার্টেড কোনো ভাবনা নেই। তারপর রাজনৈতিক সংকট তো রয়েছেই। ফলে মহাদেশীয় বা উপমহাদেশীয় সংকটও শিল্প-সাহিত্যের ওপর প্রভাব ফেলে বৈকি।’

৮.
বেগবান তেজস্বী মানুষ শাহাবুদ্দিনের শিল্পসৃষ্টির প্রেরণার উৎস বেগ ও তেজকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন মানুষের দেহে। মানুষের আগ্নেয় উত্থান ঘটান তিনি। তবে মানুষের দেহই তার গতি পর্যবেক্ষণের একমাত্র বিষয় নয়, অন্য প্রাণী অভিব্যক্তি একেও তিনি গতির অনুশীলন করেছেন। অপরাজেয় বেগে চালিত ঘোড়াদের দৌড়, ব্যাঘ্রমুখের ভয়ঙ্কর প্রকাশ এঁকেও রক্তের রাগের ক্ষুরধার পরিস্থিতি দর্শককে অবলোকন করাতে চেয়েছেন শিল্পী। যুদ্ধে অবতীর্ণ মানুষ, প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ মানুষ, প্রতিবাদে প্রতিরোধে বুক চিতানো ঊধ্র্ববাহু মানুষ; শাহাবুদ্দিনের ক্যানভাসে চিত্রিত হয়েছে মানুষের বিচিত্র উত্থান। আক্রমণের প্রাক্-মুহূর্তের হুঙ্কার এবং বিজয়ের উল্লাস, দুই একক যোদ্ধার বিস্ফারিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে কিংবা সমবেত যোদ্ধাদের বিজড়িত দেহ এঁকে তিনি শনাক্ত করতে চান। কেবলই ধাবমানতা, রক্তিম দেহের তাপ, তপ্ত দীর্ঘশ্বাস, সব মিলিয়ে গতির নতুন পুরাণ রচিত হয়েছে তার কাজে। শাহাবুদ্দিনের চৈতন্যে কখনো কোনো স্থবির জাতক জন্ম নেয় না। তার স্পেসে সমুত্থিত মানুষরা মহাকাব্যের বিপুল পরিধির কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই স্পেসে মূলত জয় ঘোষিত হয়েছে, রচিত হয়েছে ট্র্যাজিক উল্লাস। আহত-বিক্ষত মানুষের করুণ গোঙানিও রয়েছে। তবে মৃত্যু-পথযাত্রী বীরের মুখে বিপন্ন পরাস্ত হওয়ায় হতাশার ব্যঞ্জনা নেই। যাতনা আছে; ক্ষুব্ধতা আছে তার চেয়ে বেশি। কিন্তু নিথর লাশ এঁকে মৃত্যু উল্লিখিত হয়নি। কেননা শিল্পী আশাবাদী চেতনা লালন করেন এবং তিনি একদা যে প্রতিজ্ঞা নিয়ে স্বদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন সেই অঙ্গীকারের অঙ্গার এখনো ধিকিধিকি জ্বলছে তার অন্তরে। তিনি এখনো কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছতে পারেননি। তাই তার যুদ্ধ সচল রয়েছে। ছবি আঁকাটা শাহাবুদ্দিনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে সজীব সবলভাবে বেঁচে থাকার বিষয়। তবে শুধু যুদ্ধ বা যোদ্ধা নয়, যেখানেই তিনি মানুষি শক্তির জাগরণ দেখেন, ছন্দময় প্রকাশ পর্যবেক্ষণ করেন, শক্তির পরাকাষ্ঠা প্রত্যক্ষ করেন তাকেই শৈল্পিক ভাষ্য দিতে চান। তবে বেদনায় বিদীর্ণ অবয়বেও প্রকাশের খরবেগ দেখতে পেয়েছেন তিনি। এই উপমহাদেশের তত্ত্বগত শাস্ত্রের বিচারে শিল্পী মূলত রুদ্র ও বীর রসের সংক্রমণ ঘটিয়েছেন তার কাজে। সৃজনশীল মানুষের এই উদ্দামতা আমরা অনুভব করেছি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায়। ‘আমি উল্লাস; আমি অগ্নি; আমি জ্বালা’; এসব উচ্চারণে বিদ্রোহী কবি যেভাবে আগ্নেয় উদ্গিরনের মতো নিজের ভেতরের ‘আমি’কে প্রকাশ করেছেন শিল্পী শাহাবুদ্দিনের ছবিও তার শিল্পী চৈতন্যের সংখ্য অগ্নি ময় ‘আমি’র প্রকাশ।

৯.
শাহাবুদ্দিনের ছবির মানুষ আর মানুষ থাকে না, তা হয়ে যায় শুভ্র আকাশে ধূমকেতু। জাগরণ আর উত্থানের মহাকাব্য রচনা করেছেন শিল্পী। উৎসবের হর্ষোৎফুল্ল মানুষ, সংগ্রামে যুদ্ধংদেহী মানুষের সমবেত যাত্রাথ দুই-ই আশাবাদী শিল্পীকে প্রাণিত করে রাখে। তবে একক মানুষের বিচিত্র প্রকাশই শাহাবুদ্দিনের শিল্পে বিশেষ অভিনিবেশ দেখার সময়। মানুষ তির্যকভাবে তীরের মতো বেগবান, অগ্নিপিণ্ডের মতো শূন্য থেকে ছুটে আসছে কিংবা শূন্যে হারিয়ে যাচ্ছে। পুঞ্জীভূত শক্তিকে পুঞ্জীভূত বর্ণ দিয়েই শনাক্ত করতে চান শিল্পী। বর্ণই শক্তি, এখন বর্ণই ঈশ্বর হয়ে উঠেছে তার কাজে। একদিকে শক্তি পুঞ্জীভূত হয়ে অগ্নিপিণ্ডের রূপ নিচ্ছে, অন্যদিকে শক্তির চাড়ে প্রসারিত হচ্ছে সংগ্রামশীল মানুষের অঙ্গ-প্রতঙ্গ। কোনোভাবেই পরিচিত চেনা অবয়ব আর প্রামাণিকতায় থাকছে না। প্রমাণ-আয়তনকে ভেঙে প্রলম্বিত ও প্রসারিত যে ইমেজ বা ইমেজরাশির জন্ম দেন শাহাবুদ্দিন তা-ই সৃজন-চেতনা, মানসিক অবস্থা, মনের সেই মুহূর্তের পরিস্থিতি। এই অন্তর্ভেদী বিশ্লেষণের পর আমরা বুঝতে পারি শাহাবুদ্দিনের ছবিতে দেহজ অনুষঙ্গ এক উপলক্ষ মাত্র, তিনি গতিকে মনোবেগকে, সৃজনচেতনাকেই চিত্রার্পিত করে চলেছেন। পেইন্টারলি ইফেক্ট বা বর্ণ-প্রতিক্রিয়া অথবা বর্ণ-পরিমার্জনার এক বিরল শৈল্পিক স্বাক্ষরও এই গতির শিল্পী। নতুন গতিতত্ত্ব যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে শাহাবুদ্দিনের ছবিতে।

১০.
শাহাবুদ্দিন গান্ধীকে এঁকেছেন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে চিত্রিত করেছেন। শান্তিকামী গান্ধীর চোখ শিল্পী এমনভাবে এঁকেছেন যে, তা দেখলেই বোঝা যায় চমশার ফ্রেম ভেদ করে তা কীভাবে তির্যকভাবে দৃষ্টিপাত করেছে। নজরুলের চোখের শক্তিও শিল্পী পরিমাপ করেছেন। ব্যক্তির শক্তিকে ছবির মধ্য দিয়ে পুনরাবিষ্কার করার এই যে প্রয়াস তা এ দেশের শিল্পচর্চার ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। আমরা অনেক প্রতিকৃতি রচিত হতে দেখেছি, কিন্তু এরকম প্রকাশজর্জর মানব-অবয়ব দেখিনি। অবয়বের সাধভরণ চেনা রূপ বিচূর্ণ করে তাকে শক্তি ও তেজের উৎসে পরিণত করার মধ্যে শাহাবুদ্দিনের বিশেষ শৈল্পিক পারমিতা রয়েছে। শিল্পে শিল্পীর সৃজন প্রক্রিয়া মুদ্রিত হয়। শিল্পী আসলে নিজেকেই আঁকেন অন্যকে নয়। এসব স্বতঃসিদ্ধ উপলব্ধির এক উদার জমিন শাহাবুদ্দিনের ক্যানভাস। শাহাবুদ্দিন নিরীক্ষাধর্মী ফিগারিটিভ আর্টিস্ট। তবে যতটুকু মানবদেহ তার কাজে প্রকাশিত তার চেয়ে বেশি সেই দেহবর্ণে অবলুপ্ত। শাহাবুদ্দিন যতখানি অবয়বনির্ভর, তার চেয়ে বেশি নিরাবয়ব; বিমূর্ত-বর্ণে প্রকাশিত। তার মানুষি দেহে ত্বক নেই; আছে পেশি ও রক্তের নাচন। নিজেকে প্রকাশের চালটা কতটা স্বয়ংক্রিয়তায় ন্যস্ত রাখা যায় এটাই এ শিল্পীর এক প্রধান মনোভঙ্গি।

১১.
‘ছবি আঁকায় আপনার পরিবার আপনাকে কতখানি সহযোগিতা করে’ এমন প্রশ্নের জবাবে অকপটে তিনি বলেন, ‘আমি খুব ভাগ্যবান। আমার স্ত্রী আনা ইসলাম ও বাচ্চারা আমাকে দারুণভাবে সহযোগিতা করে। আমার স্ত্রীর চিত্রকলা এবং বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তার ভীষণ দুর্বলতা। আমার প্রদর্শনীর আয়োজন সবকিছুই সেই করে। স্বামীর কাজের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা। সন্তানরাও আমার চিত্রকলাকে সম্মান করে। আমার দুই মেয়ে মাঝেমধ্যে আমার শিল্পকর্মের ক্রিটিসিজম করে। বড় মেয়ে চিত্র পড়ছে প্যারিসের সর্বন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান ল বিষয়ে। চর্যা পড়ছে সায়েন্সপুর কলেজে। ওই কলেজ পৃথবীতে একটিই আছে। ওখান থেকে সব রাজনীতিবিদ তৈরি হয়। চর্যাই প্রথম বাঙালি স্টুডেন্ট। যেখানে ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট সারকোজি, মিতরোসহ অনেকেই পড়েছেন।’সেইসাথে বলছেন নিজের পরিবারের রাজনৈতিক সচেতনতার কথাও। আপন কাজে গভীরভাবে আত্মমগ্ন কিন্তু প্রবল সমাজ ও রাজনীতি সচেতন এই শিল্পী তাই বলেন, ‘কবি, সাহিত্যিক বা শিল্পীরা যখন যুদ্ধে যায়, সেটা সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু আলাদা মাত্রার হয়ে থাকে। এটা সাধারণত হয় না। এটা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয়, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ থেকে আজ পর্যন্ত এরকম নজির খুব কম পাওয়া যায়। আমার ব্যাপারটাও একটু ব্যতিক্রম। আমরা সর্বমোট আট ভাই। আমার অন্য ভাইয়েরা ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর সমবয়সী। তাঁরা কলকাতায় একসঙ্গে থেকেছেন, একসঙ্গে রাজনীতি করেছেন। আমাদের পরিবারের একমাত্র আমিই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। আমার ধ্যানজ্ঞান ছিল ছবি। আমি যখন ঘরে বসে ছবি আঁকি, তখন বাবা তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে রাজনীতি বা দেশ নিয়ে কথা বলতেন। আমি সেসব আলাপ-আলোচনা শুনতাম, উপলব্ধি করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু যখন আর্ট কলেজে যেতাম, সেটা একটা ভিন্ন জগৎ। সেখানে ৯৯ শতাংশই ছিল মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন। আমি ঘরে গিয়ে শুনি একরকম, আর্ট কলেজে গিয়ে শুনি অন্যরকম। ভেতরে যা-ই ভাবি, আমার কাজ আমি করে যেতাম।’

১২.
চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ ১৯৫০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করলেও তার আদি নিবাস নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার আলগী গ্রামে। পিতা তায়েবউদ্দীন প্রধান ছিলেন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, মাতা সাইফুন্নেসা আহমেদ ছিলেন গৃহীনি। তায়েবউদ্দীন এবং সাইফুন্নেসার সংসারে শাহাবুদ্দিন ছিলেন জ্যেষ্ঠ সন্তান। স্ত্রী আনা ইসলাম, কথা সাহিত্য ও শিল্প সমালোচক। শাহাবুদ্দিন-আনার সংসার জীবনে আছে দুই মেয়ে চিত্র ও চর্যা। তারাও শিল্প চর্চায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। মায়ের অনুপ্রেরণায় শিল্পী হয়ে ওঠার প্রাথমিক পর্যায়ে, কখন এবং কীভাবে আঁকাআঁকির সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেন, কীভাবে আর্ট কলেজে ভর্তি হলেন এ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, ‘এই যে আমার হাসি, হাসলে গালে টোল পড়ছে, এটা জন্মগত নয়। লেখাপড়া বাদ দিয়ে ছবি আঁকতাম বলে বাবা আমাকে মেরেছিলেন। সেটা ছোটবেলার কথা। নিজের অজান্তেই বিভিন্ন বইয়ে যেসব ছবি থাকত সেসব কপি করতাম। এর মধ্যে ছিল নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ, সুভাষ বসুর ছবি। সে-সময় এত ছবি ছিলও না। আমার ভাইয়েরা ওপরের ক্লাসে পড়ত, আমি তাদের বইগুলো দেখতাম। সেখান থেকে ছবি নকল করতাম। সেভাবেই আমার শুরু। আমার অন্য ভাইয়েরা যারা পড়াশোনা করত, তারা আমার ছবি আঁকার ব্যাপারটা নিয়ে বাবার কাছে অভিযোগ করত। লেখাপড়া বাদ দিয়ে ছবি আঁকার কারণে বাবা আমাকে মারেন। আমার মুখের ডান পাশটা ফুলে যায়। এরপর বাবা অবশ্য আর কোনোদিন মারেননি। এই হলো আমার যাত্রা। মূলত যখন ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে উঠি তখন আমার বয়স বারো কি তেরো। একটা কথা আমার মনে আছে। সুভাষ বসুর একটা ছবি ছিল। সেটা মাথার তেলে ঘষা কাগজে কপি করেছিলাম। তারপর রবীন্দ্রনাথ, নজরুল – এভাবে আঁকতে থাকি।…. মার খেতে খেতে, বাধা পেতে পেতে পরে এমন একটা পর্যায়ে আসি, তখন পরিবার থেকেই আমাকে প্রাথমিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হলো। আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার আগেই ওখানেই ছোটদের আঁকাআঁকির একটা স্কুল ছিল, শামসুন্নাহার শিশুকলা ভবন। ১৯৬৫ বা ১৯৬৬-এ ওখানে তখন ছুটির দিনে অর্থাৎ শুক্রবার ও রোববার শিশুদের ছবি আঁকার ক্লাস নেওয়া হতো। আমার মনে আছে, এক শুক্রবারে মা আমাকে রিকশায় করে নিয়ে গেলেন ওখানে। তখন তো আমি ছোট। আর্ট কলেজ চিনি না। যাহোক, মা রিকশা থেকে নামার সময় আমি তাঁর আঁচল ধরে চিৎকার করতে লাগলাম, আমি যাব না। কেননা পরিবেশটাই আমার কাছে মনে হচ্ছিল বিদেশি বা অচেনা। তার কারণ হলো ওখানে যেসব বাচ্চা আসত তারা প্রায় সবাই ছিল অবাঙালি। যেমন ইস্পাহানীদের মতো এলিট শ্রেণির ছেলেমেয়েরা। তাদের ভাষাও বাংলা ছিল না – উর্দু ও ইংরেজি। ওদের ভাব বা চালচলন দেখে আমার নিজেকে খুব গরিব মনে হচ্ছিল। মধ্যবিত্তের যা হয়। তখন আমি মাকে বললাম, না না, আমি এখানে ভর্তি হব না। মা আমাকে অতদূর থেকে রিকশায় করে নিয়ে এসেছেন – তিনি আমার আপত্তির তোয়াক্কা না করে আমাকে ভেতরের দিকে নিয়ে গেলেন। ভেতরে গিয়ে দেখি, মোহসীন ভাই ও শফিকুল আলম – অর্থাৎ স্কুল চালান যিনি। আর দেখলাম হান্নানকে। তো হান্নানের লুঙ্গি পরা দেখে শান্তি পেলাম। হান্নান আমাকে আন্তরিকভাবে কাছে ডাকলেন। তখন কিন্তু স্কুলের ভেতরে কেউ ছিল না। সবাই গাছের নিচে এখানে-ওখানে বসে আঁকাআঁকি করছিল। ওরা ইংরেজি আর উর্দুতে কথা বলছিল, যার কারণে ওদেরকে আমি বিদেশি মনে করছিলাম। যাহোক, ভেতরে গিয়ে তো বাঙালি পেয়ে গেলাম। তারপর মোহসীন, মান্নান ওঁরা তো গরিব, তাই সবাইকে আপন মনে হতে লাগল। মায়ের মুখ থেকে আঁকার কথা শুনে ওনারা আমাকে আঁকার রং-কাগজ দিলেন এবং বললেন, দেখি তো কেমন আঁকো। আমার আঁকা দেখে তাঁরা তো ভীষণ খুশি। তুমি তো দারুণ আঁকো। ওরা তো তেমন আঁকতেই পারে না। প্রশংসা শুনে আমার এতদিনের স্বপ্নের পালে যেন হাওয়া লাগল। আমি খুব উৎসাহ বোধ করেছিলাম।’

১৩.
শিল্পী শাহাবুদ্দিন ১৯৬৮ সালে এস.এস.সি পাশ করেন ফরিদ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আটর্স বিভাগ থেকে অর্জন করেন বিএফএ ডিগ্রী। ঐ সময়ে তিনি ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। চারুকলায় ফ্রান্স সরকারের দেয়া বৃত্তিলাভ করে ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ইকোল দে বোজার্ট চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। শিল্পী শাহাবুদ্দিন অদ্যাবধি প্যারিসে কর্মরত আছেন।

১৪.
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধে প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে নেতৃত্ব দেন তিনি। সহযোদ্ধা হিসেবে তাঁর সাথে ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা এবং পপ সম্রাট আজম খান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড গতি, শক্তি, সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণের সাহসের সঞ্চার ঘটিয়েছিল। তাই শিল্পী তার চিত্রকর্মে গতিকে প্রাধান্য দেন বেশি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি রয়েছে শিল্পীর অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালবাসা, যা তাঁর অনন্য কিছু চিত্রকর্মে উঠে এসেছে।
শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ তাঁর চিত্রকলায় সংগ্রামী মানুষের প্রতিকৃতিতে দুর্দমনীয় শক্তি ও অপ্রতিরোধ্য গতির ইংগিতময় অভিব্যাক্তির জন্য সুপরিচিত। তিনি মনে করেন, মানুষের মুক্তিযুদ্ধ অদ্যাবধি চলমান, এবং রং ও তুলির দ্বৈত অস্ত্র সহযোগে তিনি এ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে চলেছেন। সত্তরের দশকের প্রারম্ভে বাংলাদেশে বিমূর্ত চিত্রকলার যে দুবোর্ধ্য পর্বের সূচনা হয়েছিল, তার সঙ্গে গাঁটছড়া না বেঁধে তিনি নির্মাণ করেন স্বকীয় শৈলী, যার ভিত্তিতে রযেছে শারীরিক প্রকাশভঙ্গী। তাঁর এই চিত্রশৈলী বাংলাদেশের পরবর্তী প্রজন্মকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
 
১৫.
বড় ক্যানভাসের পর্দায় গতিশীল ও পেশীবহুল অতিমানবীয় পুরুষের ছবি আঁকতে ভীষণ পছন্দ করেন শাহাবুদ্দিন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে উপজীব্য করে রং-তুলির সাহায্যে যথাযথ উপস্থাপনা, প্রতিস্থাপন ইত্যাদি বিষয়গুলো সার্থক ও সফলভাবেই সম্পন্ন করেছেন তিনি। এছাড়াও, শাহাবুদ্দিনের তুলিতে নারী চিত্রকর্মগুলোয় তাদের চিরায়ত কোমলতা, দ্যুতির স্পন্দন, স্নিগ্ধতা দেখা যায়। মিহি কাপড়ের মাধ্যমে নারীকে আবৃত করে শারীরিক সৌন্দর্য্যরে দ্যুতি তুলে ধরেন তিনি যাতে রমণীর অলৌকিক ও অসীম শক্তি বিচ্ছুরিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা- এই দুই অনুষঙ্গই তাঁর চিত্রকর্মের প্রধান উপাদান। এর সঙ্গে ইউরোপীয় চিত্রকলার ঐতিহ্যের মিশ্রন তাঁর চিত্রকর্মকে করে তুলেছে ভিন্নধর্মী। শিল্পের মিথস্ক্রিয়ার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের গতিশীলতা, সাহস ও শক্তিমত্তা মিলিয়ে অতিমানবীয় অনুরণন তাঁর ক্যানভাস জুড়ে। 

১৬.
মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ের সময় জঙ্গলের ভিতরে শিল্পীর শিল্পকর্ম নিয়ে একটি ভিন্নধর্মী প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। জঙ্গলে কিংবা আগরতলায় কাগজ না পাওয়ায় ক্যালেন্ডারের পিছনের সাদা পাতায় কাজল, কয়লা, সবজির আঠা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পোর্টেট আঁকেন শিল্পী। ত্রিপুরা সরকারের সহযোগিতায় হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার অংশগ্রহণে একটি বড় ধরণের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় জঙ্গলের মধ্যেই। হারমোনিয়ামের বাজনা, সাথে ছিল পপ সম্রাট আজম খানের গান। সবার জন্যে খিচুড়িরও ব্যবস্থা করেছিলো ভারত সরকার। গান-বাজনা আর খাওয়া-দাওয়া শেষে যখন টর্চলাইটের আলো গিয়ে পড়লো বঙ্গবন্ধুর ছবির উপর ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে পুরো জঙ্গল কেঁপে উঠলো। সবাই দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলো।

১৭.
এছাড়া দেশ-বিদেশের নানা গ্যালারীতে একক ও যৌথভাবে শিল্পীর চিত্রকর্মের বহু প্রদর্শনী হয়। তন্মধ্যে একক প্রদর্শনী হিসেবে- ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্তদেরকে অর্থ সাহায্যের জন্য ঢাকায় চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে চিত্র প্রদর্শনী; হল্যান্ড, পোল্যান্ড, সেনেগাল, বেলজিয়াম এবং ভারত-সহ সুইজারল্যান্ডের লুসানে অবস্থিত অলিম্পিক মিউজিয়াম এবং ফ্রান্সের বোর্গ-এন ব্রেজ মিউজিয়ামেও বৈশ্বিকভাবে প্রদর্শন অন্যতম। যৌথ প্রদর্শনী হিসেবে- সেঁজুতির প্রথম চিত্রকলা প্রদর্শনী ও ভাষা আন্দোলন উপলক্ষ্যে চিত্র প্রদর্শনী, ঢাকা, বাংলাদেশ; প্যারিসে অধ্যয়নরত শিল্পীদের আন্তর্জাতিক চিত্র প্রদর্শনী, প্যারিস, ফ্রান্স; প্যারিসে ইউনেস্কো আয়োজিত আন্তর্জাতিক চিত্র প্রদর্শনী, প্যারিস, ফ্রান্স; বাংলাদেশের সমকালীন শিল্পকলা প্রদর্শনী, চীন; গ্যালারী কনট্রাস্টে চিত্র প্রদর্শনী ব্রাসেলস, বেলজিয়াম; "দি হারমোনী শো", মুম্বাই, ভারত; ইতালি ও কিউবাতে চিত্র প্রদর্শনী; "সিগার দ্য লা হাভানা আ হরিজন ২০০০" চিত্র প্রদর্শনী, প্যারিস, ফ্রান্স। শাহাবুদ্দিন আহমেদের বিভিন্ন চিত্রকর্ম বাংলাদেশ-সহ বুলগেরিয়া, তাইওয়ান, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্সের বিভিন্ন প্রখ্যাত গ্যালারী, বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষিত আছে।

১৮.
নানা পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। চারু ও কারুকলায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশ-বিদেশে অনেক পুরস্কার পান শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ। (১) রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক ১৯৬৮ শ্রেষ্ঠ শিশু শিল্পী(২) প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক ১৯৭৩(৩) বাংলা একাডেমীর স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ১৯৭৪(৪) ১ম পুরস্কার ১৯৭৫ প্যারিসে অধ্যয়নরত শিল্পীদের আন্তর্জাতিক চিত্র প্রদর্শনী(৫) ১ম পুরস্কার ১৯৭৯ প্যারিসে আয়োজিত ৩১টি দেশের শিল্পীদের আন্তর্জাতিক চিত্র প্রদর্শনী(৬) ১ম পুরস্কার ১৯৮০ ইউনেস্কো আয়োজিত আন্তর্জাতিক চিত্র প্রদর্শনী(৭) শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ১৯৮২ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর নবীন শিল্পী চারুকলা প্রদর্শনী(৮) স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ২০০০ চারুকলা ক্ষেত্রে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ।

১৯.
শাহাবুদ্দিন আহমদ সব সময় উজ্জ্বল রঙের পোশাক পরেন। লাল, কমলা, নীল ও সবুজের মতো উজ্জ্বল রং তাঁর মনকে আনন্দময় করে তোলে। সাধারণত একরঙা শার্ট বেশি পরেন তিনি। মাঝেমধ্যে চেকের ফ্যাশনেবল প্যান্ট পরেন। তবে চাপা কাটের প্যান্ট তাঁর বেশি প্রিয়। শার্ট-প্যান্ট ও বেল্ট তিনটি উজ্জ্বল রঙের হলেও কনট্রাস্ট করে পরেন। ছবি আঁকা কিংবা সাধারণ সময়ে ভি-গলার টি-শার্ট পরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কোনো ব্র্যান্ডের প্রতি বিশেষ ঝোঁক নেই। ফরমাল অনুষ্ঠানে শার্ট ও প্যান্টই পরেন। প্যারিসে শীতের সময় সোয়েটার ও ওভারকোট পরেন। এই দীর্ঘ জীবনে মাত্র দুবার ব্লেজার পরেছেন তিনি, তবে কখনোই টাই পরেন নি। বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে পাঞ্জাবি পরেন। ভালোবাসেন রাঁধতে, বাগান করতে খুব পছন্দ করেন। নিয়মিত না হলেও সময় পেলে সিনেমা দেখেন।

২০.
‘দেশের কোন জিনিসটি আপনার খারাপ লাগে’ এমন প্রশ্নের জবাবে শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ জানাচ্ছেন অকপটে, ‘যখন বলা হয় ‘স্বাধীনতার পক্ষে’, ‘স্বাধীনতার বিপক্ষে’ এই শব্দ দুটো আমাকে ভীষণ কষ্ট দেয়। এইটা আবার বলতে হবে এ কেমন কথা! আমি রাজনীতিবিদদের দোষ দিই না একটুও।রাজনীতিবিদদের ওপর এত বিদ্বেষের পরও রাজনীতিবিদ হচ্ছে বাংলাদেশে। তুমি যদি ধানক্ষেতে আলু লাগাও তাহলে আবার ধান লাগাইতে খবর আছে। দেখ, আমাদের বড় অর্জনগুলো কিন্তু রাজনীতিবিদদের হাতেই হয়েছে। এখনো তারাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে দেশের জন্য।’

২১.
মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে গভীর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে জড়িয়ে থাকা শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ প্রবল আশাবাদে প্রশ্ন করেন, বলেন, ‘কিন্তু আসল পয়েন্ট বা স্পিরিট যেটা – যার জন্য বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে সেটাকে কীভাবে এড়িয়ে যাবেন? বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মই তো হলো মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। অন্যান্য জাতির সঙ্গে মিলেমিশে বাঙালি জাতির হয়তো একটা অস্তিত্ব বা ঐতিহ্য ছিল, কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে জন্মের পর তার পরিচয় তো ভিন্ন। এই স্বাধীন-সার্বভৌম সত্তার গল্পের নামই তো মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধকে বাদ দিলে আমাদের আর কী থাকতে পারে? আমাদের তো পতন হবেই। তাই বিষয়বস্ত্ত হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকেই বেছে নিয়েছিলাম। এ কারণেই আমি এত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। এতবড় ওজনদার বিষয় বহন করতে শক্তি ও সময় প্রয়োজন। হুট করেই শেষ করার ব্যাপার নয়। আজ এই যে আমি আপনি এখানে এ প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলছি – তার কারণও এই স্বাধীনতা, স্বাধীন রাষ্ট্র। স্বাধীনতাযুদ্ধ একটা জাতির জন্য একবারই হয়। বারবার হয় না। শিল্পী হিসেবে আমি হয়তো ভাগ্যবান যে আমি ধীরে ধীরে হলেও স্বাধীনতার প্রসঙ্গকে আমার ছবির বিষয় করতে পেরেছি। অন্যান্য জাতির মানুষের কাছে আমি আমার দেশের একটা বিশাল গৌরবময় অধ্যায়ের গল্প ছবিতে ব্যক্ত করতে পেরেছি। এর জন্য আমাকে শিল্পকলার এক উচ্চ স্তরের ভাষাকে রপ্ত করতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ আমার জন্য অহংকার তো বটেই – আমার জীবনও বটে। এটার জন্যই বেঁচে আছি আমি। স্বাধীনতা সবাইকে বাঁচিয়ে রেখেছে।’

(তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, শিল্প ও শিল্পী, কালি ও কলম, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক মানবজমিন, দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক কালের কণ্ঠ, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, দৈনিক যুগান্তর, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত