আধুনিক বাংলা ছাপচিত্রের জনক সফিউদ্দিন আহমেদ

প্রকাশ : ২৩ জুন ২০১৬, ১৩:৩০

বাংলাদেশের শিল্পকলা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন সফিউদ্দীন আহমেদ একই সাথে বাংলাদেশের আধুনিক ছাপচিত্রের জনকও তিনি। তবে ছাপচিত্রের পাশাপাশি তিনি জলরং এবং তেল রং-এর কাজেও দক্ষতা দেখিয়েছেন। তিনি সাত দশকের বেশি সময় ধরে শিল্পচর্চায় দেশের চারুকলার জগৎকে সমৃদ্ধ করেছেন। আজকের এই দিনে ২৩ জুন তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে শিল্পী জয়নুল আবেদীনের সাথে ও অন্যান্য শিল্পীরা মিলে একসঙ্গে ঢাকা আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেন যা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা চারুকলা ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত।

সফিউদ্দিন ১৯২২ সালে কলিকাতায় জন্ম নেন। ১৯৩৬ সালে কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৪২ সালে এখান থেকে চারুকলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাজ্যের সেন্ট্রাল স্কুল অফ আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস্ থেকে এচিং ও এনগ্রেভিংয় বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকায় ধানমন্ডিতে চলে আসেন।

শিল্পী সফিউদ্দীন উড এনগ্রেভিং ও এচিং-এর জন্যে বিখ্যাত হলেও তিনি কিন্তু প্রথম কাজের সম্মান পেয়েছিলেন তেলচিত্রে। ছাপচিত্রের পাশাপাশি তেল রং-এও কাজ করে যাচ্ছিলেন। তেল রং-এ ইম্প্রেশনিস্টদের ছাপ পাওয়া যায়। ‘শালবন’, ‘দুমকা’, ‘সূর্যালোকে কুটির’, ‘দুমকা ১’, ‘দুমকা-২’, ‘জড় জীবন’, ‘দিলীপ দাশগুপ্তের প্রতিকৃতি’ এই কাজগুলো সবই ছেচল্লিশের দিকের করা। বাহান্নর ‘ধানঝাড়া’ বা ছাপ্পান্নর ‘সূর্যমূখী’ও এই ধারার। দুমকার অসংখ্য স্কেচে ওদের সরল সচ্ছন্দ জীবন, আকাশ ছোঁয়া প্রান্তর আর অপরূপ সাজের ছন্দোময় প্রকৃতি এত আলোড়িত করেছিল যে স্কেচগুলো তাঁর শিল্পী জীবনে সৃষ্টিশীলতায় নবজোয়ার এনে দিয়েছিল। যার

দেশে-বিদেশে বহু দলবদ্ধ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন ১৯৫৮ সালে থেকে। চল্লিশের দশকে কলকাতার আর্ট কলেজে পড়ার সময়ে তিনি দক্ষতা অর্জন করেন ছাপচিত্রে। তার কিছু অসাধারণ কাজের মাধ্যমে তিনি ভারতের কলারসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বাংলাদেশের শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, আবুল বারক আলভী, ফরিদা জামান, আবুল খায়ের, সুবীর চৌধুরী সফিউদ্দিন আহমেদের কাজের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।

দুই বাংলার রঙ তার কাছে ছিল ভিন্ন। তাই পশ্চিম বাংলার প্রকৃতির ধূসরতা এবং বাংলাদেশে নীলাভ সবুজের ছড়াছড়িকে মিশিয়ে নিয়েছেন। প্রাথমিক ভাবে তার কাজে পরিস্ফুটিত হয় লোকশিল্পের বৈশিষ্ট্য। কালো রঙের প্রতি দুর্বলতা ছিলো তাঁর তাই কালো রঙের অনুশীলনের জন্যে ত্রিশ-চল্লিশের দশকেই শিয়ালদা স্টেশনে গেছেন রাতের বেলার কালো রঙ দেখতে। যুক্তরাজ্যে তিনি কালোর বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার করেন এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে। নব্বইয়ের দশকে তিন বছরের মতো সময়ে তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে অকেন রেখাচিত্র আঁকেন যা "ব্ল্যাক সিরিজ" বা "কালো চিত্রমালা" নামে পরিচিত। তাঁর শিল্পকর্মে ১৯৫২ বাংলা ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ছবি উঠে এসেছে বিভিন্ন মাধ্যমে রচনার মাধ্যমে। তার কলিকাতায় আঁকা ছবিতে এসেছে মহানগরের বস্তিজীবন, বিহারের বিভিন্ন অঞ্চলের নিসর্গ, দুমকার প্রকৃতি ও সাঁওতাল-জীবন এবং ঢাকায় আঁকা ছবিতে বিষয়বস্তু হিসেবে এসেছে বন্যা, জাল, মাছ, নৌকা, ঝড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক উপাদানের পাশাপাশি নানা শ্রমজীবী মানুষ।

তিনি ১৯৪৫ সালে কলকাতা একাডেমী অব ফাইন আর্ট প্রদত্ত একাডেমী প্রেসিডেন্ট পদক লাভ করেন। এছাড়াও তিনি অর্জন করেন ভারতের পার্টনার শিল্পকলা পরিষদের দেওয়া ‘দ্বারভাঙ্গা মহারাজার স্বর্ণপদক’ (১৯৪৭ সাল), পাকিস্তান সরকারের দেওয়া ‘প্রেসিডেন্ট পদক’ ১৯৬৩ সালে, বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া ‘একুশে পদক’ (১৯৭৮ সাল) এবং ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’ (১৯৯৬ সাল)। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে ছাপচিত্র বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত।

২০০৮ সালে ২৩শে জুন প্রচারবিমুখ এই গুণী শিল্পীর প্রথম একক প্রদর্শনী 'রেখার অশেষ আলো' অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশে যা উদ্বোধন করেন সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। শিল্পীর ছাত্র শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, "তার চিত্রকর্ম সম্পর্কে আমার বলার কিছু নেই, ধৃষ্টতাও নেই। তার চিত্রকর্মের যে বিশালতা, বলিষ্ঠতা ও ব্যাপকতা এবং ড্রইংয়ে রংয়ের প্রলেপ, যেভাবে লাইন টেনেছেন তা শুধু অনুধাবন করার বিষয়।

তাঁর শিল্পকর্মে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। ১৯৪৫ সালে কলকাতা একাডেমি অব ফাইন আর্ট থেকে একাডেমি প্রেসিডেন্ট পদক, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক একুশে পদক ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারসহ আরও অনেক পুরস্কার অর্জন করেন।

১৯৪৫-এ ‘কবুতর’ (একুয়াটিন্ট মাধ্যমে) ছবির জন্যে পেয়েছিলেন একাডেমী প্রেসিডেন্টের স্বর্ণপদক। একাডেমী অফ ফাইন আর্টস থেকে ১৯৪৬ সালে একুয়াটিন্টের জন্যে আরো একটি পুরস্কার। ১৯৪৬ সালে বিহার শিল্পকলা পরিষদ আয়োজিত প্রদর্শনীতে তখনকার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। দ্বারভাঙ্গা মহারাজা এ পুরস্কারটি প্রবর্তন করেছিলেন। দুই বছরে এতগুলো পুরস্কার তাঁকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল। এই অর্জনের কারণে তাঁকে ১৯৪৬-৪৭ সালে অল ইন্ডিয়া আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস সোসাইটির কাউন্সিলর সদস্য করা হয় তাঁকে। দিল্লীতে সোসাইটির মূল কেন্দ্র ছিল। এটাও তাঁর জীবনের একটা বিরল অর্জন।

প্যারিসের মডার্ন আর্ট মিউজিয়ামে বিশ্বের ৪৪টি দেশের বাছাই করা শিল্পীদের কাজ নিয়ে ইউনেস্কো আয়োজন করেছিল এক প্রদশনীর, ১৯৪৬ সালে। ভারতে প্রথিতযশা শিল্পীদের মধ্য থেকে তাঁর তিনটি বা চারটি কাজও প্রদর্শিত হয়েছিল এই প্রদর্শনীতে। পিকাসো, ব্রাক, মাতিস, শাগাল এই সব মাষ্টার শিল্পীদের কাজও এই প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়েছিল। ভারতবর্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, গগণেন্দ্রনাথ, রামকিংকর, যামিনী রায়, অমৃতা শেরগীলসহ জয়নুল আবেদিন ও সফিউদ্দীন আহমেদের কাজ প্রদর্শিত হয়েছিল। 

এই সময় অধ্যক্ষ অতুল বসু লেখায় এক অংশে উল্লেখ করলেন “নবীন শিল্পীদের মধ্যে সফিউদ্দীন আহমেদ ইতিমধ্যেই ভারত ও বহির্বিশ্বে নিজের জন্যে এক মর্যাদার আসন করে নিয়েছেন।” ১৯৪৮ সালে লন্ডনের রয়েল একাডেমীতে অনুষ্ঠিত হল খৃষ্টপূর্ব ২৪০০ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানের শিল্পকলার প্রদর্শনী। প্রদর্শনীতে সফিউদ্দীনের উড এনগ্রেভিং ‘সাঁওতাল রমণী’ দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকায় সফিউদ্দীনের উড এনগ্রেভিং ‘সাওতাল রমণী’ সম্পর্কে লেখা হলো: “শুধু একটি রসপুষ্ট চিত্রই নয়, মহৎ শিল্পসম্পদের রূপবান নিদর্শন।”
 
তথ্য সূত্র: উইকিপিডিয়া, কালি ও কলম

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত