মীর্জা গালিব

প্রকাশ : ২৭ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৮:২৫

 

সময়টা ১৮৫৭ সাল। ইংরেজ গোরা সৈন্যদের হাতে লালকেল্লার পতন হয়েছে। বিদ্রোহে ইন্ধন দেবার অভিযোগে লালকেল্লা থেকে শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে ধরে নিয়ে গেছে ইংরেজ বাহিনী। ওদিকে দিল্লীতে গৃহবন্দী হয়ে অাছেন মীর্জা গালিব। গোরা সৈন্যরা দিল্লীর বিশিষ্টজনদের হত্যা করেছে, অসংখ্য মানুষকে বন্দী করেছে। নিদারুন এক পরিস্থিতি বিরাজ করছে দিল্লী শহরে। এমন সময় মীর্জা গালিবের মহল্লায় শোনা গেল তুমুল শোরগোল। গোরা সৈন্যরা মীর্জা গালিবকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে সেনা শিবিরে। সেখানে ইংরেজ সেনা অফিসার কর্নেল ব্রাউনের সামনে হাজির করা হলো তাঁকে। গালিবকে জেরা করার এক ফাঁকে প্রশ্ন করা হলো, তিনি মুসলমান কিনা। লালকেল্লার সঙ্গে পূর্বের যোগাযোগের কারণে তাঁর ফাঁসি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এরকম জীবন-মরণ সমস্যার মাঝেও গালিব রসিকতার অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেন নি। জবাবে তিনি কর্নেল ব্রাউনকে রসিকতার সুরে উত্তর দিলেন, "মুসলমান, কিন্তু আধা।" জবাব শুনে কর্নেল ব্রাউনতো থ। সে আবার কেমন মুসলমান? গালিব হেসে বললেন, "শরাব পীতা হুঁ , লেকিন শুকুর নঁহী খাতা"। গালিবের এই জবাব শুনে কর্নেল ব্রাউনসহ ইংরেজ অফিসারগণ হেসে উঠলেন। গালিব ছাড়া পেলেন।

আধুনিক উর্দু সাহিত্যের শ্রেষ্ট কবি মীর্জা গালিব, পুরো নাম মীর্জা আসাদুল্লাহ বেগ খাঁ গালিব। ফারসি সাহিত্য রচনায়ও অবিসংবাদিত খ্যাতি রয়েছে তাঁর। মীর্জা গালিবের জন্ম ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর আগ্রায়। তিনি দীর্ঘ ৫০ বছর দিল্লীতে বসবাস করেছেন। জীবদ্দশায় সাহিত্য চর্চা ছাড়া আর কোনো পেশা গ্রহণ করেন নি তিনি। চলন বলনে দিল্লীর আশরাফ মুসলমানের ন্যায় অভিজাত গালিবের গজল, শের, কবিতা উর্দু সাহিত্যে তো বটেই বিশ্ব সাহিত্যেরও অমূল্য সম্পদ। শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের সভাকবি ছিলেন মীর্জা গালিব। বাহাদুর শাহ নিজেও একজন কবি ছিলেন। লালকেল্লায় মীর্জা গালিব ও বাহাদুর শাহ জাফরের কাব্য আড্ডা হতো।

অাগেই বলেছি, গালিব ৫০ বছর দিল্লীতে বসবাস করছেন। দিল্লী-আগ্রায় মুঘল পরিবারের সান্নিধ্য পেয়েছেন, কিন্তু নিজের বসবাসের জন্যে কখনও বাড়ি কেনার চেষ্টাও করেন নি। তিনি সারা জীবন থেকেছেন ভাড়া করা বাড়িতে। পাশাপাশি সারা জীবনই শুধু বই পড়েছেন, তবে মজার ব্যাপার হলো জীবনে তিনি একটি বইও কিনে পড়েন নি। দিল্লীর বইয়ের দোকান থেকে ভাড়ায় বই এনেই পড়ার কাজটি সেরেছেন।

মীর্জা গালিবের পূর্বপুরুষগণ আগ্রার আদি বাসিন্দা ছিলেন না৷ তাঁর ঠাকুরদা কাকান বেগ খাঁ সামরিক উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি হিসেবে সমরখন্দ থেকে ভারতে এসেছিলেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে পাঞ্জাবের গভর্ণর, মোগল সম্রাট শাহ আলম ও জয়পুরের মহারাজার অধীনে সামরিক দায়িত্ব পালন করেছেন৷ কাকান বেগের বিরাট পরিবারের মধ্যে তাঁর দুই পুত্র আবদুল্লাহ বেগ খাঁ ও নসরুল্লাহ বেগ খাঁ পিতার পদাংক অনুসরণ করে সৈনিকের পেশা গ্রহণ করেছিলেন বিভিন্ন শাসকের অধীনে৷ অষ্টাদশ শতাব্দীর ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারতে এই পেশা অত্যন্ত অনিশ্চিত ও বিপজ্জনক ছিল৷ পিতা আবদুল্লাহ বেগ খাঁর মৃত্যুর সময় গালিবের বয়স মাত্র চার বছর৷ ভাইয়ের পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন নসরুল্লাহ বেগ খাঁ৷ ১৮০৬ সালে নসরুল্লাহ বেগ খাঁ মারাঠাদের অধীনে আগ্রা দুর্গের অধিনায়ক হন এবং এক পর্যায়ে বৃটিশের কাছে দুর্গ সমর্পণ করলে তিনি বৃটিশ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পুরস্কৃত হন৷ চাচার মৃত্যুর সময়ে গালিবের বয়স নয় বছর৷

মির্জা গালিবের পিতা আগ্রার এক অভিজাত পরিবারে বিয়ে করেছিলেন৷ মামার বাড়িতেই গালিবের জন্ম এবং তুলনামূলকভাবে তিনি আরামদায়ক শৈশব কাটান৷ কিন্তু পিতা ও চাচার অকাল মৃত্যুতে তাঁর মধ্যে বঞ্চনার স্থায়ী প্রভাব হয়নি৷ তাছাড়াও বংশের ঐতিহ্যের কারণে অহংকারী গালিবের মধ্যে তাঁর মায়ের পিতৃগৃহে অবস্থানের প্রভাব নেতিবাচক ছিল৷ কিন্তু সৌভাগ্যবশত: শৈশবে তাঁর শিক্ষা এমন ছিল যে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ব্যাহত হয়নি৷ আগ্রার খ্যাতিমান পণ্ডিত শেখ মোয়াজ্জেম তাঁর শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ তিনি যুক্তিবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিত্‍সাশাস্ত্র ও অধিবিদ্যা ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ে পড়াশুনা করেন৷ কিন্তু তাঁর অত্যন্ত ঝোঁক ছিল ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি। বিশেষত ফার্সি ভাষার প্রতি৷ এসময়ে আরবি ও ফার্সি ভাষায় দক্ষ আবদুস সামাদ নামে এক জ্ঞানী ব্যক্তি আগ্রা সফর করেন৷ গালিব তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন৷ আবদুস সামাদ গালিবের মামার বাড়িতে দুই বছর অতিবাহিত করেন৷ গালিব কখনো কাউকে তার 'উস্তাদ' বলে স্বীকার না করলেও পরবর্তীকালে আবদুস সামাদের উল্লেখ করেছেন প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতার সাথে৷ নয় বছর বয়সেই গালিব ফার্সিতে কবিতা লিখতে শুরু করেন৷ পুরো জীবন ধরে তিনি ফার্সিকে তাঁর প্রথম প্রেম বলে বর্ণনা করেছেন৷ কিন্তু তিনি যে শৈশবেই উর্দুতে কবিতা লিখতেন তারও দৃষ্টান্ত রয়েছে৷ কবি আলতাফ হোসেন হালীর বর্ণনা অনুসারে কানাইয়া লাল নামে এক লোক গালিবের একটি মসনবী সংরক্ষণ করেছিলেন যা গালিবের আট বা নয় বছর বয়সে লিখা৷ এটির অস্তিত্ব গালিব বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিলেন৷ কিন্তু পরে যখন তাকে এটি দেখানো হয় তখন তিনি অত্যন্ত ব্যগ্রতার সাথে সেটি পাঠ করেন৷

বলা হয়ে থাকে যে, আগ্রার এক অভিজাত ও কবি হোসাইন-উদ-দৌলা একবার কিছু তরুণ কবির কবিতা নিয়ে যান লক্ষ্ণৌর বিখ্যাত কবি মীর তকী মীরের কাছে৷ মীর তকী কবি খ্যাতির পাশাপাশি চড়া মেজাজের জন্যেও পরিচিত ছিলেন। তিনি ভালো কবিতা ছাড়া সবই বাতিল করে দিতেন৷ কেউ সাহস করে তাঁকে গালিবের কবিতা দেখায় এবং গালিবের মেধা সম্পর্কে অবহিত করে৷ গালিবের গজল পাঠ করে তিনি মন্তব্য করেন যে, কোন ভালো উস্তাদের তত্ত্বাবধানে ছেলেটি বিরাট কবি হতে পারবে৷

১৮১০ সালের ৮ আগস্ট তের বছরের কম বয়সে গালিব নওয়াব ইলাহী বখশ খানের কন্যা ওমরাও বেগমকে বিয়ে করেন এবং বিয়ের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আগ্রা থেকে দিল্লিতে চলে আসেন৷ অবশ্য সাত বছর বয়স থেকেই তিনি দিল্লিতে আসতেন বলে নগরীটি তাঁর কাছে নতুন ছিল না৷ তাঁর শ্বশুর দিল্লির অভিজাতদের অন্যতম ছিলেন৷ 'মারুফ' ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন তিনি৷ কবি হিসেবে খ্যাতি লাভের জন্যে আগ্রার চাইতে দিল্লির পরিবেশ অনুকূল ছিল ৷ অবশ্য অব্যাহত রাজনৈতিক সমস্যার কারণে তার পূর্বেকার কবি মীর তকী মীর ও সওদাকে দিল্লি ত্যাগ করতে হয়েছিল৷ কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনায় বৃটিশ উপনিবেশিক শক্তির উপস্থিতি দিল্লির রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে শান্ত রেখেছিল৷

দিল্লিতে আগমণের পর গালিব চাঁদনী চকের কাছে একটি প্রাসাদ ভাড়া নেন৷ শ্বশুরের প্রভাবের কারণে দিল্লির অভিজাত মহলের সাথে পরিচিত হতে তাঁকে বেগ পেতে হয়নি৷ কিন্তু তাঁর কবি জীবনের সূচনা খুব স্বচ্ছন্দ ছিল না৷ তাঁর প্রথমদিকের কবিতা ফার্সি ঘেঁষা ছিল৷ উর্দু তখন সাধারণ মানুষের ভাষায় পরিণত হওয়ায় সাহিত্যের মাধ্যম হিসেবেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল৷ কিন্তু গালিবের ভেতরে ফার্সি কবি বুখারি, আসীর ও বেদীর প্রভাব ছিল৷

১৮৫৭তে দিল্লীর লালকেল্লা ও মোগল বাদশাহের ভাগ্যে ঘটে চরম পরিনতি। মুঘল বাদশাহকে লালকেল্লা থেকে বন্দি করা হয়। সঙ্গে মির্জার জীবনেও নেমে আসে চরম অন্ধকার। অতিশয় দুঃখে- কষ্টে নানা উত্থান পতনে জীবন অতিবাহিত হয় গালিবের। মদ্যপ, নাস্তিক হিসেবে নানা বদনামও জুটেছে কপালে। চৌসর নামক এক প্রকার বাজী ধরার খেলার অপরাধে ইংরেজ কোর্টে ৬ মাসের জেলও খাটতে হয়েছে তাকে।

ভারতবর্ষের ইতিহাসের চরম একটি ক্রান্তিকালের প্রত্যক্ষ সাক্ষী মির্জা গালিব। ১৮৫৭ এর দিল্লীর ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড- লুটতরাজ, সম্রাটের নির্বাসন দণ্ড, নিজের ভাগ্য বিপর্যয় সবই ঘটেছে তাঁর চোখের সামনে। সেই বিদ্রোহের দিনগুলোর কথা গালিব লিখেছেন তাঁর দিনলিপি ‘দাস্তাম্বু’ গ্রন্থে। পেনশনের জন্য ইংরেজদের দরজায় বারবার আবেদন করেছেন। কিছু সাহায্যের জন্যে কলকাতায়ও এসেছেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়েই ফিরেছেন। তবে কোনো প্রতিবন্ধকতাই থামাতে পারে নি মীর্জা গালিবের লেখনী। দুঃখের ভার সুক্ষ্ম রসিকতায় হালকা করে দিয়েছেন, বিদ্রুপের বাঁকা হাসিতে উড়িয়ে দিয়েছেন অনেক জটিল সমস্যা। মীর্জা গালিবের কাব্যে রসবোধ ও কৌতুক উর্দু সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত