শুভ জন্মদিন প্রিয় বন্ধু উইলিয়াম এ এস ওডারল্যান্ড

প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৪:৫৯

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে যারা সম্পৃক্ত হয়েছিলেন, তারা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাসকে করেছেন গৌরবান্বিত ও মহিমান্বিত। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী ভূমিকা ও সুমহান অবদান এ দেশের মানুষ চিরকাল মনে রাখবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে একজন বিদেশি নাগরিক বীরপ্রতীক উপাধি পেয়েছেন। অনেকেই হয়তো তার নাম জানি না। তিনি হলেন ওডারল্যান্ড। তিনি ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর নেদারল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন।

গতকাল ছিল আমাদের দেশের অকৃত্তিম বন্ধু বীর প্রতীক উইলিয়াম এ এস ওডারল্যান্ডের জন্মদিন। শুভ জন্মদিন প্রিয় বন্ধু। আপনি থাকবেন বাংলাদেশের প্রতিটি স্পন্দনে, হাওয়ায়, নিঃশ্বাসে।

১৯৭০ সালের শেষ দিকে ঢাকায় আসেন ওডারল্যান্ড। পদ বাটা সু কোম্পানির প্রোডাকশন ম্যানেজার। কয়েক মাসের মধেই তিনি কোম্পানি-ম্যানেজার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই কোম্পানি-ম্যানেজার। এমন সময় তিনি নিজের মধ্যে আবিষ্কার করেন নতুন এক যুদ্ধের মুখোমুখি প্রাক্তন-সৈনিককে।

অপারেশন সার্চ লাইটের সময় তিনি লুকিয়ে সে রাতের ভয়াবহতার কিছু ছবি তুলে পাঠান আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। প্রথমদিকে তিনি দখলদার পাকবাহিনীর পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের গোপন তথ্য সংগ্রহ করে আগেভাগেই মুক্তিযোদ্ধাদের তা জানিয়ে দিতেন। একজন বিদেশি হিসেবে পাকবাহিনীর নিকট তাঁর নিঃসংশয় গ্রহণযোগ্যতা ছিল বলে তিনি সেনাসদরে অনেকটা অবাধ বিচরণের এবং প্রায়শ সেনানিবাসে সামরিক অফিসারদের আলোচনা সভায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান। তিনি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ, আর্থিক সহায়তা এবং সকল সম্ভাব্য উপায়ে সাহায্য করতেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গেরিলা কমান্ডো হিসেবে স্বীয় অভিজ্ঞতা কাজে লাগালেন। বাটা কারখানা প্রাঙ্গণসহ টঙ্গীর কয়েকটি গোপন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত গেরিলা প্রশিক্ষণ দিতেন। কমান্ডো হিসেবে তিনি ছিলেন অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। তিনি মুক্তিকামী বাঙালি যোদ্ধাদের নিয়ে টঙ্গী-ভৈরব রেলব্রিজ, কালভার্ট ধ্বংস করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করতে থাকেন। ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বহু অপারেশন তাঁর পরিকল্পনায় ও পরিচালনায় সংঘটিত হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখেন। এ ব্যাপারে তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘ইউরোপের যৌবনের অভিজ্ঞতাগুলো যেন আমি নিজের মধ্যে ফিরে পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশে যা কিছু ঘটছে বিশ্ববাসীকে সেসব জানানো উচিত।’

জীবদ্দশায় ওডারল্যান্ড মুক্তিযুদ্ধের উপর কোনো স্মৃতিচারণ লিখে যাননি। তবে, ক্ষুদ্রাকারের কিছু চিঠিপত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে অনেক কিছু অবতারণা করেছিলেন। তিনি এক চিরকুটে লিখেছেন, ‘আমার জন্ম ১৯১৭ সালের ডিসেম্বরে, আমস্টারডামে। ইউরোপে তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তৃতীয় বছর। ১৯৩৬ সালে আমি ন্যাশনাল সার্ভিসে যেতে বাধ্য হই। এর কিছুদিন পর বাটা সু কোম্পানিতে আমার চাকরি হয়। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে ডাচ বাহিনীর পক্ষে লড়াই করে নাভেসি বাহিনীর বর্বতার সম্মুখীন হই।’

তিনি আরো লেখেন, ‘নাৎসি বাহিনীর ক্যাম্প থেকে ছাড়া পাবার পর আমি আন্ডারগ্রাউন্ড তৎপরতায় যুক্ত হই। জার্মান এবং বিভিন্ন ডাচ উপভাষায় আমি অনর্গল কথা বলতে পারতাম। এই সময় জার্মান হাই কমান্ডের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ফলে, ডাচ আন্ডার গ্রাউন্ড তৎপরতাকে যেমন আমি সাহায্য করতে পেরেছিলাম, তেমনি মিত্রবাহিনীকে জরুরি তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে পেরেছিলাম। ১৯৭১ সালে মার্চ মাসে ঢাকায় ট্যাংক নামার পরও একই ব্যাপার হয়েছিল।’ 

ওডারল্যান্ডের চোখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বেদনা, রক্তাক্ত স্মৃতি আর বাংলার মুক্তিযুদ্ধ একাকার হয়ে পড়েছিল। আর তাই তিনি বাংলার মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতা দেখে আমার ইউরোপের যৌবনের অভিজ্ঞতাগুলো ফিরে পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, যা কিছু ঘটছে বিশ্ববাসীকে কারো না কারো জানানো উচিত। আমি অবাধেই চলাফেরা করতে পারছিলাম। নিরীহ মানুষজনের উপর পাকিস্তানিরা যেসব ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছিল, সেসবের ছবিও তুলতে পেরেছিলাম। এরপর সেই ছবিগুলো বিদেশি বিভিন্ন মিডিয়াতে পাঠিয়ে দিতাম।’ তিনি লেখেন, ‘হানাদার বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগের পরিধি বাড়িয়ে নানা তথ্য গোপনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজে লাগাতে থাকলাম। এরপর ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়লাম মুক্তিযুদ্ধের আরো গভীরে। বাটার শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করে টংগীসহ সেক্টর ১ এবং ২ নম্বরে গড়ে তুলি গেরিলা বাহিনী। আর নিজেই দায়িত্ব নিলাম প্রশিক্ষকের।’ 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী এ অকুতোভয় বীর আরো লিখেছেন, ‘সেসময় বাঙালিদের জন্য যে ভালোবাসা আর টান আমি অনুভব করেছি, এ ছিল তারই বহিঃপ্রকাশ।’ 

যুদ্ধ শেষে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করা হয়। চাকরি শেষে ১৯৭৮ সালে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় চলে যান। এরপর ২০০১ সালের ১৮ মে বাংলাদেশের এই বন্ধু বীরপ্রতীক ওডারল্যান্ড পরলোকগমন করেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত