ভয়াল ২৯ এপ্রিল

উপকূলবাসীকে এখনো তাড়ায় স্বজন হারানোর স্মৃতি

প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০১৭, ১৬:০০

উপকূলের হাজার হাজার মানুষ আপনজনকে হারিয়ে এখনো স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। দু’যুগ সময় পিছনে ফেলে এসেছেন তারা। কিন্তু স্বজন হারানোর বেদনা তাদের কখনো নিস্তার দেয় না।

উপকূলবাসীর স্বজন হারানোর সেই ভয়াল ২৯ এপ্রিল আজ। এদিনে ভারাক্রান্ত মনে কেউ মিলাদ পড়িয়ে, কেউ ছিন্নমূলদের মাঝে খাবার বিতরণ করে কিংবা বিলাপে শান্তনা খোঁজার চেষ্টা চালাবেন।
 
১৯৯১ সালের এই দিনে স্মরণকালের সেই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস চট্টগ্রাম কক্সবাজারের দ্বীপাঞ্চলসহ উপকূলীয় এলাকা তছনছ করে মহা ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করেছিল। রাতের অন্ধকারে মুহূর্তের মধ্যে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল উপকূলীয় এলাকা। দেশের মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিল প্রকৃতির করুণ এই রুদ্ধরোষ।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের এতবড় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি উপকূলের মানুষ আর কখনো হয়নি। তাই ২৯ এপ্রিল আসলে স্বজন হারা মানুষের কান্নায় এখনও ভারি হয় উপকূলের আকাশ বাতাস। সেই জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়া উপকূলবাসীকে স্বজন হারানোর বেদনা আজও অশ্রু ভারাক্রান্ত করে তোলে।

ক্ষতিগ্রস্তদের মতে, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল আবহাওয়া বিভাগ উপকূলীয় এলাকায় ৯নং সতর্ক সংকেত জারি করলেও অজ্ঞতার বশে লোকজন অন্যত্র সরে না যাওয়ায় মহা দুর্যোগের শিকার হন। রাত ১০টার পর ১০ থেকে ২০ ফুট উচ্চতায় সাগরের পানি মুহূর্তেই ধেয়ে এসে লোকালয়ে প্রবেশ করে। জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবলীলায় ওই রাতে অনেক মা হারায় সন্তান, স্বামী হারায় স্ত্রী, ভাই হারায় বোনকে। অনেক পরিবার আছে যাদের গোটা পরিবারই পানির স্রোতে হারিয়ে গেছে। ২৯ এপ্রিলের সে ভয়াল স্মৃতি মনে করে এখনও কেঁদে বেড়ায় স্বজন হারানো উপকূলবাসী।

ভয়াল এই ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় ১৯ জেলার ১০২ থানা ও ৯টি পৌরসভায় সরকারি হিসাব মতে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ জন নিহত, ১২ হাজার ১২৫ জন নিখোঁজ, ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫৪ জন আহত হয়। মাছ ধরার ট্রলার, নৌকা, বৈদ্যুতিক খুটি, গাছ-পালা, চিংড়ি ঘের, স্কুল-মাদ্রাসা, পানের বরজ, লাখ লাখ গবাদি পশু, ব্রিজ কালভার্ট ভেঙ্গে গিয়ে ক্ষতি সাধিত হয় কয়েক হাজার কোটি টাকার। তাই ২৬ বছর পরও অতীতের স্মৃতি চিহ্ন মুছে ফেলতে পারেনি উপকূলবাসী।

জানা গেছে, ১৫৬১ সালের জ্বলোচ্ছ্বাসেও উপকূলের বিপুল মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এছাড়া ১৭৬২ সালে, ১৭৯৫ সালের ৩ জুন, ১৮৯৭ সালের ২৪ অক্টোবরে, ১৯০৫ সালের ২৯ এপ্রিলে, ১৯৬৩ সালের ২৭ মে, ১৯৭২ সালের অক্টোবরে, ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে, ১৯৬৫ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জ্বলোচ্ছ্বাসে কুতুবদিয়াদ্বীপসহ উপকুলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সর্বশেষ ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের  ভয়াবহ জ্বলোচ্ছ্বাসে কুতুবদিয়া খুদিয়ার টেক নামক একটি এলাকা বিলীন হয়ে গেছে।

১৯৯১ সালের এ দিনে সব চেয়ে বেশী প্রাণহানী ঘটে কক্সবাজার জেলার দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর উপ-দ্বীপ ধলঘাটা-মাতারবাড়ি, পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়ন, কুতুবদিয়ার প্রায় পুরো উপজেলা এবং সদরের বৃহত্তর গোমাতলী এলাকায়। ওখানে অধিকাংশ বাড়ি থেকে পরিবারের ৫/৬ জন লোক মারাযান। অনেক যৌথপরিবারে একসাথে ৪০ জনও মারা গেছে এমনও রয়েছে। তাই এই দিনটিতে প্রতি বছর ওইসব স্মৃতি মনে করে এখনও স্বজন হারানোর বেদনায় প্রত্যেক বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে।

জেলা প্রশাসন সূত্রমতে, জেলার বিভিন্ন উপকূলে স্থাপিত ৫৩৪টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে বর্তমানে রয়েছে ৫১৬টি। এর মাঝে ৪১টি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে অনেক আগেই।

জেলা প্রশাসনের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০০৮ সালের ১২ জুন জেলার ব্যবহারের অনুপযোগী ১৫৪টি কেন্দ্র দ্রুত সংস্কার এবং জেলায় নতুন করে আরও ২৭৭টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে পত্র পাঠানো হয়েছিল। এরই ভিত্তিতে ২০০৮-২০০৯ অর্থসনে ২১২টি নতুন সাইক্লোন সেল্টার নিমার্ণের প্রক্রিয়া শুরুর তোড়জোড় হলেও শেষ পর্যন্ত তা আর আলোর মুখ দেখেনি। তবে সরকারি অর্থায়নে ইতোমধ্যে আট উপজেলায় ১২টি নতুন সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণাধিন রয়েছে। কিন্তু সংস্কার বিষয়ে নতুন কোন বরাদ্দ কিংবা নির্দেশনা আসেনি।  

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর সংস্কার ও অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা এবং নতুন করে আরও কেন্দ্র স্থাপনের জন্যও উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।

শুধু সাইক্লোন সেল্টার নয়, জেলার উপকুলের ২৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে চরম ঝুঁকিতে। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে মহেশখালী, পেকুয়া, কুতুবদিয়া , সদর উপজেলা এবং টেকনাফের বেশ কয়েকটি উপকূলীয় বেড়িবাঁধ বিলীন হয়েছিল। ওই ভাঙা বাঁধ এখনো পরিপূর্ণ মেরামত হয়নি। ফলে উপকুলের লাখো মানুষ এখনো ঝুঁকি নিয়ে বাস করছেন।

এদিকে দিবসটি যথাযথভাবে পালনের লক্ষ্যে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচী হাতে নিয়েছে ২৯ এপ্রিল’১৯৯১ স্মৃতি পরিষদ, কুতুবদিয়া ফাউন্ডেশনসহ নানা সংগঠন।

সকালে শোক র‌্যালি, মিলাদ ও নিহত এবং নিখোঁজদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত এবং দরিদ্রদের মাঝে বিশেষ খাবার বিতরণ করা হবে বলে জানিয়েছে সংগঠন সূত্র।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত