অনন্ত নক্ষত্র ঋত্বিক ঘটক
প্রকাশ : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৪:৪৮
![](https://www.sahos24.com/templates/sahos-v2/images/sahosh.png)
![](/assets/news_photos/2017/02/06/image-16845.jpg)
বাংলা চলচ্চিত্রে চলচ্চিত্রকার হিসাবে দুয়েকজনের নাম অনেকটা কালো আকাশে জ্বলজ্বলে তারার মত জ্বলতে থাকে। আমরা ভুলে যাই তাঁদের কথা, তাঁদের অবদানের কথা। মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় সেসব তারা। তবুও সেই মেঘ চিরস্থায়ী নয়, নাগরিক ভীড়ে 'তক্কো গপ্পে' ফিরে আসে আমাদের মাঝে পুণরায় জীবিত হয়ে।
ঋত্বিক ঘটক তেমনই একটা তারা, যে জ্বলছে শারিরিক মৃত্যুর পরও। কবিতা দিয়ে শুরু। তারপর গল্প উপন্যাস লেখা শুরু করলেন তিনি। দেখিয়ে দিতে চাইলেন সমাজের অন্ধকূপের গভীরতা। তবু মন ভরেনি তাঁর, বসে থাকেন নি তিনি। নিজের বক্তব্য আরও জোড়ালো করে, আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে তিনি শুরু করলেন নাটক লেখার কাজ, নাটক বানাবার কাজ।তাতেও এ শিল্পীর মন ভরে নি। তাঁর নতুন যুদ্ধাস্ত্র হল সিনেমা, সমাজের নিপীড়িত মানুষের পক্ষে।
ঋত্বিক ঘটক ৪ নভেম্বর ১৯২৫-এ বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর একজন যমজ বোনও ছিল, নাম প্রতীতি দেবী। নয় ভাইবোনের মধ্যে তাঁরাই ছিলেন বয়েসে ছোট। তাঁর বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক ছিলেন পেশায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, সেইসাথে তিনি কবি এবং চিত্রনাট্যকারও ছিলেন। মা ইন্দুবালা দেবীও ছিলেন অনেকটাই সংস্কৃতমনা।
দেশভাগের ঠিক আগে আগেই তাঁরা ঢাকা ছেড়ে চলে গেল কলকাতাতে আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে। সেখানেই গড়ে উঠল তাঁর কর্মক্ষেত্র, তাঁর যুদ্ধক্ষেত্র। বিভিন্ন আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়লেন তিনি, লিখতে লাগলেন নাটক, সিনেমার চিত্রনাট্য।
তাঁর নিজের জীবনটাই অনেকটা সিনেমার মত। বিয়ে করলেন সুরমা দেবীকে। তাঁদের তিন সন্তানও হয়েছিল। কিন্তু মানসিক চাপে পর্যদুস্ত হয়ে তাঁকে যখন মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, সুরমা দেবী তাঁদের তিন সন্তানকে নিয়ে চলে যান তার পূর্বপুরুষদের বাড়ি শিলং এ।
সেই অবস্থাতেও লড়াই করেছেন ঋত্বিক ঘটক। ফিরে এসেছেন যুদ্ধ করে, আবার নতুন করে যুদ্ধ শুরু করতে।
১৯৫২ সালে তিনি তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। যদিও তিনি বেঁচে থাকতে সেই চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় নি। তাঁর প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের নাম 'অযান্ত্রিক'। কমেডি ঘরাণার এ চলচ্চিত্রটি মূলত তাঁর কমার্শিয়াল কাজ হিসেবেই ধরা হয়। তাঁর লেখা চিত্রনাট্য 'মধুমতি' বাণিজ্যিকভাবে সবচেয়ে সফল চলচ্চিত্র। বাঙালি চলচ্চিত্রকার বিমল রায় এচলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন হিন্দিতে। সেবারই প্রথম তাঁর গল্প 'ফ্লিমফেয়ার বেস্ট স্টোরি'-তে নমিনেশন পায়।
তাঁর নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের সংখ্যা মাত্র ৮। তবে মাত্র এই ক'টি চলচ্চিত্র বানিয়েই তিনি চলচ্চিত্র ইতিহাসে নিজের নাম পাকাপাকিভাবে বসিয়ে নিয়েছেন। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলো হচ্ছে, মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), কোমল গান্ধার (১৯৬১), সুবর্ণরেখা (১৯৬২)।
১৯৬৬ সালে তিনি পুনে চলে যান। সেখানে Film and Television Institute of India (FTII)-তে শিক্ষকতা করতেন। ওখানে থাকাকালীনই তাঁর দু'জন ছাত্রের 'ফিয়ার অ্যান্ড রদ্যেভ্যুঁ' নামের এক চলচিত্র তৈরিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭০ সালে তিনি আবার সিনেমা বানাবার কাজে ফিরে আসেন। বাংলাদেশী এক প্রযোজকের অর্থায়নে তিনি ১৯৭৩ সালে বানান 'তিতাস একটি নদীর নাম'। দিনদিন চলচ্চিত্র তৈরি করা তাঁর পক্ষে কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল অতিরিক্ত মদ্যপান এবং একের পর এক রোগে ভুগে। তবু তিনি দমে যান নি। চালিয়ে গেছেন তাঁর নিজস্ব সংগ্রাম। তারই ফলস্বরূপ তিনি আত্মজীবনীমূলক চলচ্চিত্র বানান। চলচ্চিত্রটির নাম 'যুক্তি তক্কো আর গপ্পো'। সেখানে প্রধান চরিত্রের নাম ছিল নীলকণ্ঠ।
এছাড়াও তাঁর অসংখ্য অসম্পূর্ণ শর্ট ফ্লিম আর ফিচার তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেন নি কিংবা করেন নি।
মানুষ স্রষ্টাকে চেনে, তার থেকেও বেশি চেনে তার সৃষ্টিকর্মকে। কিন্তু সৃষ্টি হবার প্রক্রিয়ার দিকে তারা ফিরেও তাকায় না। এভাবেই অগোচরে রয়ে যায় একটি সংগ্রামী জীবনের উপাখ্যান। ঋত্বিক ঘটকের দ্রোহ, ক্ষোভ, আশা, বিদ্রোহ, ভালবাসা আর জীবনীশক্তি চাপা পড়ে থাকে নি। বেড়িয়ে এসেছে তাঁর অসংখ্য সম্পূর্ণ-অসম্পূর্ণ কাজের মধ্য দিয়ে।
১৯৭৬ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি এই চলচ্চিত্র জগতের নক্ষত্র যাত্রা করেছিলেন মহাশূণ্যে। তাঁর এই মহাপ্রয়ান দিবসে রইল সশ্রদ্ধ শত-কোটি প্রণাম। শক্তি চট্টপাধ্যায়ের লেখা কিছু পঙ্ক্তি তাঁর চরণে,
“আর কেউ নেই যে কড়কাবে
বিদ্যুত চাবুকে এই মধ্যবিত্তি, সম্পদ, সন্তোষ মানুষের
তুমি গেছ, র্স্পধা গেছে, বিনয় এসেছে”।