তাজমহল: বন্ধ কক্ষগুলো খুলে দেওয়ার আবেদন খারিজ ভারতের আদালতে

প্রকাশ : ১৭ মে ২০২২, ১৯:৫৮

সাহস ডেস্ক
তাজমহলের আঙিনা ঝাড়ু দিচ্ছেন একজন পরিষ্কারকর্মী। ছবি: এএফপি

প্রত্নতাত্ত্বিক সার্ভের জন্য তাজমহলের ২২টি বন্ধকক্ষে ধর্মীয় কোন প্রতিমা পাওয়া যায় কিনা জানতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতার আবেদন খারিজ করেছে ভারতের একটি আদালত।

সতেরো শতকের দিকে মোঘল সম্রাট শাহজাহান তাজমহল নির্মাণ করেন। কিছু হিন্দুত্ববাদী ডানপন্থী দল দাবি তুলেছে, তাজমহল বহুবছর ধরে হিন্দুদের মন্দির হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। 'মন্দিরের শহর' খ্যাত অযোধ্যায় বিজেপির গণমাধ্যম শাখার প্রধান রাজনিশ সিং এলাহাবাদ 'হিন্দুত্ববাদী সংগঠন এবং স্বনামধন্য ধর্মগুরুদের দাবি' উল্লেখ করে হাইকোর্টের লক্ষ্ণৌ শাখায় অভিযোগ করেন, "তাজমহল পূর্বে একটি শিবমন্দির  ছিল। এই মন্দির থেকেই শাহজাহান তার স্ত্রীর জন্য সমাধিসৌধ পুনর্নির্মাণ করেন। "আমার উদ্বেগ মূলত তাজমহলের বন্ধ কক্ষগুলো নিয়েই," বলেন তিনি।

হিন্দুত্ববাদী সংগঠনসমূহ যে কক্ষগুলো খুলে দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল, নিরাপত্তাজনিত কারণে কয়েক দশক পূর্বেই প্রত্মতাত্ত্বিক দপ্তর থেকে সে কক্ষগুলো সিলগালা করে দেওয়া হয়। প্রত্মতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের বিভিন্ন পূর্ব বক্তব্য থেকে এমনটাই জানা যায়। ৭ই মে আবেদনের সময় রাজনিশ সিং অনুনয় করে বলেন, "আমাদের সকলের জানা উচিত কক্ষগুলোর ভেতরে কী আছে? আমাকে ভেতরে দেখতে দিন।"

এরপর ১২ মে রাজনিশ সিং এর আপিলকে একটি 'অযৌক্তিক দাবি' বলে খারিজ করে দেয় এলাহাবাদ হাইকোর্ট লক্ষ্ণৌ শাখা। কোর্টের মতে, "এই দাবির জন্য কোর্টের বাইরে বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। এসব ইতিহাসবিদদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত, কোর্ট দেখবে না কে কোন বিষয় নিয়ে রিসার্চ করবে। এরকম আপিল গ্রহনে কোর্ট সক্ষম নয়।"

তাজমহল একটি হিন্দু মন্দির- এ দাবী উঠে এসেছিল ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত ভারতীয় লেখক পি.এন. ওক এর "তাজমহল: দ্য ট্রু স্টোরি" বইটিতে। মি. ওক তার বইটিতে দাবি করেছেন, মুঘলদের ভারত আক্রমণের অনেক আগে ১২ শতকের দিকে এটি 'তেজো মহালয়া' বা ভগবান শিবের প্রাসাদ হিসেবে পরিচিত ছিল।

'মুঘল শাসকেরা অনেক মন্দিরকেই ধ্বংস করে মসজিদ নির্মাণ করেছে' উল্লেখ করে ভারতের হিন্দুত্ববাদী, হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলগুলি দাবী করেছে, ১৭ শতকের দিকে 'তেজো মহালয়া'কে তাজমহল এ পুনর্নির্মাণ করেন শাহজাহান। ২০১৭ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্থাটি কোর্টের নিকট বিবৃতি দেয় যে তাজমহল মূলত একটি মুসলিম সমাধিসৌধ, যা সম্রাট শাহজাহান তার মৃত স্ত্রী মমতাজের সম্মানে নির্মাণ করে। "তাজমহল হিন্দু মন্দির, এ দাবি হাস্যকর," জানান প্রথম সারির ইতিহাসবিদেরা।

মধ্যযুগীয় প্রত্নতত্ত্ব ও স্থাপত্যের বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত ভারতের আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যযুগীয় ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ আলী নাদিম রেজাভি বলেন, "অনেক ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ আছে, যা প্রমাণ করে তাজমহল শাহজাহানই নির্মাণ করেছেন।" তিনি বলেন "শুধুমাত্র  ওই সময়ের পারস্যের ইতিহাসই নয়, বেশ কিছু ইউরোপীয় পর্যটকদের ভ্রমণ বৃত্তান্ত এবং বিপুলসংখ্যক রাজস্থানী নথি পত্রও প্রমাণ দেয় সম্রাট শাহজাহান কাঠামোটা নির্মাণ করেছিলেন।"

ভয়েস অফ আমেরিকাকে 'রাজস্তান রাজ্যের আর্কাইভের' কথা উল্লেখ করে বলেন, "বিপুল সংখ্যক রাজস্থানী দলিলপত্র যেমন, ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত দলিল যা 'আরহসত্তা ইমারতি' নামে পরিচিত। খনি থেকে মাকরানা মার্বেলসহ তাজমহলের নির্মাণ সামগ্রী, যাবতীয় খরচসহ পরিবহন খরচ এর বিস্তারিত রসিদ এখনও 'বিকানার আর্কাইভ'এ রয়েছে।" "তাজমহলের স্থানে কোন মন্দির ছিল কিংবা সেটাকে ভেঙে ফেলা হয়েছে এমন ইঙ্গিত কখনোই কোন ঐতিহাসিক দলিলাদিতে পাওয়া যায়নি," বলেন তিনি, "সাদা মার্বেল পাথরে তৈরী এরকম গম্বুজের মত, ননি-পারটাইট (ইরানীয় স্থাপত্যশৈলী) পরিকল্পনায় নির্মিত হয়েছে, এমন মন্দির কোনো সময়কালেই দেখাতে পারবেন না। যদি কেউ বলে তাজমহল একটি হিন্দু স্থাপত্য ছিল অথবা এটিকে হিন্দু মন্দির ভেঙে নির্মাণ করা হয়েছে তাহলে এটা আসলেই হাস্যকর।"

রুটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক অড্রে ট্রাস্কা বলেন, "তাজমহল আগে শিবমন্দির ছিল এ ষড়যন্ত্রতত্ত্বটা 'পৃথিবী সমতল'  আর ' চাঁদ পনিরের তৈরি' এইসব বিতর্কের মতই ঠুনকো।" "তাজমহলের নির্মাণ ও পৃষ্ঠপোষকতা একজন মুঘল সম্রাটের হাতে ঘটেছিলো এটি সপ্তদশ শতাব্দীর ঐতিহাসিক নথিপত্রে  একেবারেই সুস্পষ্ট। দক্ষিণ এশিয়ার উত্তরাঞ্চলজুড়ে থাকা মুঘল সমাধিগুলোর ভেতরে এটি নির্দ্বিধায় সবচেয়ে দুর্দান্ত।" ট্রাস্কা বলেন, "আমি যতদূর বুঝতে পারি, তাজমহল সম্পর্কে এমন কোনো সুসঙ্গত তত্ত্ব নেই। নিছক একটি উন্মাদনাপূর্ণ ও খামখেয়ালি জাতীয়তাবাদী অহংকার- যা 'অ-হিন্দু' কোনোকিছুকেই ভারতীয় বলে ভাবতে চায় না। ভারতীয় ঐতিহ্যের মুসলিম অংশগুলোকে মুছে ফেলতে চায়।"

ভারতের বৃহত্তম হিন্দু সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কেন্দ্রীয় মুখপাত্র বিনোদ বনসাল বলেন, "এটি মোটেও হিন্দু-মুসলিম সংকট নয়,"  "অনেকেই জানতে চায় দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ করে রাখা কক্ষগুলির ভিতরে ঠিক কী রয়েছে! কর্তৃপক্ষের উচিত দরজা খুলে দিয়ে সিলগালা করা দরজার পিছনের সত্য তাদেরকে জানতে সহায়তা করা। সত্য বিশ্বের কাছে উন্মোচিত হওয়া উচিত।" "তাজমহল একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য। কেউ কোনো অবস্থাতেই এই স্মৃতিস্তম্ভের কোনো ক্ষতি করবে না," বলেন তিনি।

সূত্র: ভয়েজ অব আমেরিকা।

অনুবাদক
আফসানা আহমেদ ইভা
শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত