করোনাভাইরাস: যুক্তরাষ্ট্রে মারা যেতে পারে ১ থেকে ২ লাখ মানুষ

প্রকাশ : ৩১ মার্চ ২০২০, ১৪:৫০

সাহস ডেস্ক

যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসের প্রথম রোগী শনাক্ত হয় গত ২০ জানুয়ারি। এরপর ৫০ দিনে রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ছাড়ায় ১০ মার্চ। এরপরের এক সপ্তাহে রোগী ৫ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এরপরই শুরু হয় লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি। পরের ১২ দিনে রোগী বেড়ে হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার। সঙ্গে বেড়েছে মৃতের সংখ্যাও। সর্বশেষ গতকাল সোমবার রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত দেশটিতে আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৮৯। মারা গেছে ২ হাজার ৫৯৯ জন।

এই পরিস্থিতিতে গত রবিবার যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্য খাতের শীর্ষ এক ব্যক্তি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, দেশটিতে করোনাভাইরাসে ১ থেকে ২ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে।

কিন্তু প্রস্তুতির জন্য এত দীর্ঘ সময় পেলেও যুক্তরাষ্ট্রের এই হাল হলো কী কারণে? সম্পদের ঘাটতি নেই তাদের। আছে পর্যাপ্ত চিকিৎসা অবকাঠামো, সঙ্গে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। তারপরও এই পরিস্থিতি কেন? গতকাল ওয়াশিংটন পোস্ট-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০ জানুয়ারি প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ২২ জানুয়ারি এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘বিষয়টি বেশ ভালোভাবেই আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে।’

এরপর ১০ ফেব্রুয়ারি করোনাভাইরাসের সংখ্যা নিয়ে ট্রাম্পের মন্তব্য ছিল, ‘আমাদের দেশে মাত্র ১১ জন আক্রান্ত এবং তাঁরাও সেরে উঠছেন।’ ১৫ দিন পর ২৫ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আপনারা হয়তো করোনাভাইরাস নিয়ে প্রশ্ন করবেন। আমি বলছি, যুক্তরাষ্ট্রে বিষয়টি বেশ ভালোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আছে।’ দুই দিন পর ২৭ ফেব্রুয়ারি তিনি বলেন, ‘সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে। এটা আশ্চর্য, কিন্তু সত্যিই একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।’ ১০ দিন পর ৬ মার্চ ট্রাম্পের বক্তব্য ছিল, কেউ চাইলেই পরীক্ষা করাতে পারে। সব ব্যবস্থাই আছে। পরীক্ষা করা সত্যিই দারুণ।

দেড় মাস ধরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট যখন এসব বলে চলেছেন, তখন করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দিনে দিনে দু-চারজন করে বাড়ছে আর ছড়িয়ে পড়ছে দেশজুড়ে। এরপর গত অর্ধমাসে কীভাবে তা ছড়াল বিশ্ব দেখেছে। শুধু প্রেসিডেন্ট নন, ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সও একইভাবে আশ্বস্ত করে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রবাসীকে।

মার্কিন প্রশাসন একদিকে মুখে মুখে আশ্বস্ত করেছে, অন্যদিকে রোগ পরীক্ষা এবং লোকজনকে কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ) ও আইসোলেশনের (বিচ্ছিন্নকরণ) পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেয়নি। ঠিকমতো পরীক্ষা না হওয়ায় একটি ভুল বার্তা পেয়েছে দেশের মানুষ, জানতে পারেনি দেশে আসলে কত মানুষ আক্রান্ত। ফলে তারাও বিষয়টিকে সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি। চলাফেরা-মেলামেশায় সতর্ক হয়নি। এই ফাঁকে ট্রাম্পের সেই ‘মাত্র ১১ জন’ ছয় সপ্তাহের ব্যবধানে লাখ ছাড়িয়ে গেছে।

তবে চীনে জানুয়ারির শেষের দিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যখন বাড়ছিল, তখনই ট্রাম্প প্রশাসনকে সতর্ক করেছিল দেশটির রোগনিয়ন্ত্রণ সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)। মার্কিনদের চীন ভ্রমণে সতর্ক করার কথাও তারা জানিয়েছিল। এসব সতর্কতা এবং গোয়েন্দা প্রতিবেদন ট্রাম্প প্রশাসনের নজরে আনার জন্য সপ্তাহের পর সপ্তাহ চেষ্টা করেছেন স্বাস্থ্য ও হিউম্যান সার্ভিস মন্ত্রী অ্যালেক্স আজার।

করোনাভাইরাস একটি নতুন ধরনের ভাইরাস। এখনো পর্যন্ত ওষুধ নেই, চিকিৎসা নেই এমনকি দেশে দেশে এটির পরীক্ষা পদ্ধতিও ভিন্ন। কেননা, প্রতিনিয়ত জিনের গঠন বদলে ফেলছে ভাইরাসটি। এ কারণে চীন তাদের মতো করে পরীক্ষা পদ্ধতি উদ্ভাবন করে নিয়েছিল। অক্ষম দেশগুলোকে এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সেই অবস্থা নেই। ২০ জানুয়ারি প্রথম রোগী শনাক্তের চার দিনের মাথায় ২৪ জানুয়ারি পরীক্ষা পদ্ধতির নকশা করে দেশটির সিডিসি।

সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র পলিসি ফেলো জেরেমি কনিনডাইক বলেন, ‘আমেরিকানদের উপযোগী পরীক্ষা পদ্ধতি তৈরি করে নিয়েছিল সিডিসি। এবং আমরা সাধারণত এভাবেই কাজ করি। আমাদের যে সক্ষমতা আছে, অনেক দেশের তা নেই। কাজেই পরীক্ষা পদ্ধতি পাওয়ার জন্য তাদের নির্ভর করতে হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওপর। যুক্তরাষ্ট্রের তা করতে হয় না।’

প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর প্রথম ১০ দিন আক্রান্তের সংখ্যা এক অঙ্কের ঘরেই ছিল। ওই সময়ই ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এ একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন দুই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লুসিয়ানা বোরিও এবং স্কট গটলিব। নিবন্ধে তাঁরা সতর্ক করেছিলেন, ‘আক্রান্তের সংখ্যা যদি বাড়ে তাহলে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সিডিসিকে বেগ পেতে হবে। সরকারের এখনই উচিত ব্যক্তি খাতের সঙ্গে মিলে দ্রুত ব্যবহার-উপযোগী পরীক্ষার ব্যবস্থা করা এবং সংশ্লিষ্টদের কাছে তা পৌঁছে দেওয়া। মহামারি রুখতে সবার আগে কর্তব্য সন্দেহভাজন রোগীদের শনাক্ত করা, তাদের পরীক্ষার ব্যবস্থা করা এবং আলাদা করে ফেলা।’

কিন্তু সরকার অনেক দিন সময় পেয়েও শুরুর দিকে এসব উদ্যোগ নেয়নি। পরীক্ষার দায়িত্বও অনেক দিন সিডিসির বাইরে কারও হাতে দেওয়া হয়নি। অনেক মানুষের পরীক্ষা করার দরকার ছিল, কিন্তু তা করা হয়নি। ১৬ ফেব্রুয়ারি নাগাদ অর্থাৎ প্রথম প্রায় এক মাসে পরীক্ষা করা হয় মাত্র ৮০০ জনকে। অর্থাৎ প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে পরীক্ষা হয় মাত্র আড়াই জনের। দক্ষিণ কোরিয়াতেও করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের মতো একই দিনে। কিন্তু সেই একই সময়ে তারা প্রায় ৮ হাজার পরীক্ষা করিয়েছিল, যা তাদের দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতি ১০ লাখে ১৫৪ জন।

এর পরের সপ্তাহগুলোতে পরিষ্কার হয়ে যায় যে সংক্রমণ স্থানীয়ভাবে ছড়াতে শুরু করেছে। তখনো সারা দেশে সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ও ল্যাবে পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হয়নি।

২৪ ফেব্রুয়ারি সিডিসির ন্যাশনাল সেন্টার ফর ইমিউনাইজেশন অ্যান্ড রেসপিরেটরি ডিজিজের পরিচালক ন্যান্সি ম্যাসোনির সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের এখানে হয়তো স্থানীয়ভাবে সংক্রমণ শুরু হবে। আর এটা হলে অনেক মানুষ গুরুতরভাবে আক্রান্ত হবে।’

ঠিক সেদিনও ট্রাম্প টুইট করেন, ‘করোনাভাইরাস আমাদের এখানে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে।’

ট্রাম্পের যখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণে ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের তত দিন সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এরপর দিনে দিনে রোগী বেড়েছে, বাড়ানো হয়েছে সতর্কতা। সতর্কতা থেকে একপর্যায়ে নিষেধাজ্ঞা। একে একে সবকিছু বন্ধ, লকডাউন। কিন্তু তত দিনে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেড়েছে।

এই অবস্থায় ভবিষ্যতে কী ঘটতে চলেছে, তার একটা সম্ভাব্য চিত্র দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি এস ফাউসি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজের পরিচালক এবং করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গঠিত মার্কিন টাস্কফোর্সের সদস্য। রোববার হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমরা এখন যেসব বিধিনিষেধ, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলছি, তা ঠিকমতো পালন হলেও যুক্তরাষ্ট্রের ১ থেকে ২ লাখ মানুষ এই ভাইরাসে প্রাণ হারাবে। এসব না মানলে সংখ্যাটা ১০ লাখে ঠেকতে পারে।’ তাই নিষেধাজ্ঞা, লকডাউন, শাটডাউন এবং আরও যা যা আছে তার মেয়াদ আপাতত অন্তত এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত বাড়াতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

এরপর ট্রাম্প প্রশাসন ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত জাতীয় জরুরি অবস্থার মেয়াদ বাড়িয়েছে।

সূত্র: প্রথম আলো

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত