রোহিঙ্গাদের নিয়ে বিপদে মিয়ানমার

প্রকাশ : ১২ ডিসেম্বর ২০১৯, ১১:৩৭

সাহস ডেস্ক

একদিকে আন্তর্জাতিক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে মিয়ানমারকে, অন্যদিকে সেই রোহিঙ্গা সংকটের কারণেই রাখাইন রাজ্যে শুরু হয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। বলা হচ্ছে, এই রাজ্যের অর্থনৈতিক সংকট থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে পুরো দেশই। সব মিলিয়ে মিয়ানমার পড়েছে শাঁখের করাতে, দুই দিকের ধার সামলাতে হচ্ছে দেশটিকে।

দুই বছরের বেশি সময় আগে রোহিঙ্গা সংকটের সূত্রপাত। ওই সময় রাখাইন রাজ্য থেকে দলে দলে রোহিঙ্গা মুসলিমরা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে শুরু করেন। ব্যাংকক পোস্টের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা সংকটের কারণে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে রাখাইন রাজ্য। এখন এর প্রভাব পুরো দেশেই পড়তে শুরু করেছে। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা তরুণ মিয়ানমারের অন্যান্য অঞ্চল ও দেশের বাইরে চলে গেছেন। নিপীড়নের কারণে রাখাইনের কমপক্ষে ৩০ শতাংশ তরুণ রাজ্য ছেড়ে চলে গেছেন বলে স্থানীয় জরিপে জানা গেছে। গবেষকেরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও নির্যাতনের ভয়ে এই তরুণেরা জীবনের বাকিটা সময় পরিচয় গোপন করে চলতে চান। সংশ্লিষ্ট এক গবেষক বলেছেন, রাখাইন রাজ্যের কিছু গ্রামে জনসংখ্যা ব্যাপক হারে কমে গেছে। প্রায় পুরুষশূন্য এসব গ্রামে আছেন শুধু শিশু ও বৃদ্ধরা।

এই বিপুল তরুণ শ্রমশক্তির অভাবে পুরো রাখাইন রাজ্যে নির্মাণশিল্পের কাজ থমকে গেছে। রাখাইনের বিভিন্ন গ্রামের বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না শুঁটকি মাছ। কেননা, মাছ শুকানোর জন্য ন্যূনতম যে শ্রমশক্তি প্রয়োজন, সেটিও নেই। কারণ, এসব এলাকা থেকে রোহিঙ্গা মুসলিম জেলেরা পালিয়ে গেছেন। পর্যটনশিল্পের রথের চাকাও আর চলছে না। সংঘাত জর্জর রাখাইন রাজ্যে এখন পর্যটক খুঁজে পাওয়া ভার।

আবার রাখাইনে বর্তমানে থাকা রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে মানবেতর পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। গার্ডিয়ানের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, রাখাইনের সরকারিভাবে ‘বন্ধ’ করে দেওয়া রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় জীবনমানের কোনো উন্নতি হয়নি। রোহিঙ্গারা এখনো সেখানে ভয়ভীতির মধ্যে দুঃসহ দিন যাপন করছেন। সেখানে তাঁরা কোনো উন্নত সুযোগ-সুবিধা পান না। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসুবিধা প্রায় শূন্য।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের নিদারুণ অভাবের কারণে রাখাইনের বর্তমান সম্প্রদায়গুলো ক্রমে মদ্যপানের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ব্যাংকক পোস্টের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় রাখাইনে স্থানীয় গ্র্যান্ড রয়্যাল হুইস্কির বিক্রি সবচেয়ে বেশি। অথচ জনসংখ্যার হিসাবে রাখাইন অন্য রাজ্যগুলোর চেয়ে অনেক পেছনে। রাখাইনে কাজ করা বিভিন্ন দাতা সংস্থার স্থানীয় কর্মীরা বলছেন, রাজ্যে মদ ছাড়াও অন্যান্য মাদকদ্রব্য ব্যবহারের হারও বেড়ে চলেছে।

মিয়ানমারের সরকার অবশ্য রাখাইন রাজ্যের অর্থনৈতিক কাঠামোকে পুনরুজ্জীবিত করতে নতুন রোডম্যাপ নিয়ে কাজ করছে। জাতিসংঘের সাবেক প্রধান কফি আনানের নেতৃত্বে একটি কমিশন এই রোডম্যাপ তৈরিতে সহায়তা করেছে। কিন্তু এই রোডম্যাপ পুরোপুরি কার্যকর করা নিয়েও সংশয় রয়েছে।

বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমার বেশ কিছুদিন আগেই রাখাইন রাজ্যকে বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। কিন্তু স্থানীয় লোকজন সেই ঘোষণায় খুব একটা ভরসা পাচ্ছেন না। সরকারের তরফ থেকে দেওয়া নিত্যনতুন নিয়মে তাঁরা শঙ্কিত এবং ব্যবসায় উৎসাহিত বোধও করছেন না। ওই রাজ্যে চীনের আনাগোনা বেড়ে যাওয়াটাও তাঁরা ভালোভাবে নিচ্ছেন না। ফলে, ব্যবসার পালে হাওয়া বইছে না। অন্যদিকে চীনের ঋণের ফাঁদে মিয়ানমারের আটকে পড়ারও আশঙ্কা বাড়ছে।

এদিকে রাখাইনের অর্থনৈতিক সংকট মাথায় নিয়ে আদালতে দাঁড়াতে হয়েছে মিয়ানমারকে। রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার দ্য হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মঙ্গলবার শুরু হয়েছে। প্রথম দিন মামলার বাদীপক্ষ গাম্বিয়া ও তাদের আইনজীবীরা বক্তব্য দেন। গতকাল বুধবার মিয়ানমার বক্তব্য দিয়েছে। মিয়ানমারের পক্ষে দেশটির স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি নিজেদের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, তাঁর দেশের সেনাসদস্যরা যুদ্ধাপরাধ করে থাকলে তা মিয়ানমারের দেশীয় তদন্ত ও বিচারব্যবস্থায় নিষ্পত্তি করা হবে। এটিকে আন্তর্জাতিকীকরণের সুযোগ নেই। তাঁর দাবি, ১৯৪৮-এর গণহত্যা সনদ এখানে প্রযোজ্য নয়। আদালতে অভিযোগকারী গাম্বিয়ার বিভিন্ন তথ্যকে বিভ্রান্তিকর বলেও মন্তব্য করেছেন সু চি।

তিন দিনের এই শুনানি আজ বৃহস্পতিবার শেষ হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইসিজেতে এই মামলা দীর্ঘদিন ধরে চলার আশঙ্কা আছে। পুরো বিচারকাজ শেষ হতে ১০ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত সময়ও লেগে যেতে পারে।

ধারণা করা হচ্ছে, তিন দিনের নির্ধারিত শুনানির পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চাপে পড়বে মিয়ানমার। বিশেষ করে দেশটির সেনাবাহিনী ও বেসামরিক সরকার এখন থেকে রোহিঙ্গা বিষয়ে সঠিক পথে থাকতে বাধ্য হবে। কোনো বিতর্কিত কাজ করে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে পার পাওয়া আর সম্ভব হবে না। আবার রোহিঙ্গা সংকট পরিস্থিতির উন্নতিতে মিয়ানমার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেটিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানাতে হবে নিয়মিত বিরতিতে। তবে হ্যাঁ, আগের ভুল শুধরে নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাবে সু চির সরকার।

কিন্তু যদি সবকিছু মিয়ানমারের পরিকল্পনামাফিক না এগোয় এবং সু চি সরকারের পক্ষে না আসে, তবেই বিপদ। বিশ্লেষকেরা বলছেন, যদি আইসিজে থেকে প্রত্যাশিত সমর্থন সু চি আদায় করতে না পারেন, তবে মিয়ানমারে আসা বৈদেশিক বিনিয়োগ স্তিমিত হয়ে যেতে পারে। এমনকি পশ্চিমা বিনিয়োগ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও আছে। মিয়ানমারের মিত্র হিসেবে পরিচিত জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড তখন বিকল্প চিন্তা করতে পারে।

গণহত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হলে সবচেয়ে বড় যে সমস্যায় পড়বে মিয়ানমার, সেটি হলো পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন হারানো। আসতে পারে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক নানা নিষেধাজ্ঞা। শুধু চীনা ঢালে তখন আর রক্ষা পাবে না সু চির দেশ।

সূত্র: প্রথম আলো

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত