‘রোলিহ্লাহ্লা’ থেকে নেলসন: এক অবিসংবাদিত রাষ্ট্রনায়ক

প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০১৯, ১৩:২৩

সাহস ডেস্ক

দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত রাষ্ট্রনায়ক, দুনিয়ার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যাক্তিত্ব নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মবার্ষিকী আজ।

একশ’এক বছর আগে ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই থেম্বু রাজবংশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় তার নাম রাখা হয় ‘রোলিহ্লাহ্লা’ যার অর্থ হলো গাছের ডাল ভাঙে যে অর্থাৎ ‘দুষ্টু ছেলে’। স্কুলে পড়ার সময়ে তার শিক্ষিকা মদিঙ্গানে তার ইংরেজি নাম রাখেন নেলসন। আর বংশগত ভাবে ম্যান্ডেলা নামটি সঙ্গে জুড়ে যায়। ম্যান্ডেলা ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ আফ্রিকার দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের অধীনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ইউনিভার্সিটি অফ উইটওয়াটার্সরান্ডে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শুরু করেন।

১৯৪৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদে বিশ্বাসী দল ন্যাশনাল পার্টি নির্বাচনে জয়লাভ করে। ন্যাশনাল পার্টির ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মূলত ম্যান্ডেলা সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫২ সালে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস আহুত অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি। রাজনৈতিক জীবনের প্রথমভাগে তিনি মহাত্মা গান্ধীর দর্শণ দ্বারা প্রভাবিত হন। ম্যান্ডেলা প্রথম থেকেই অহিংস আন্দোলনের পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সরকার ১৯৫৬ সালের ৫ ডিসেম্বর ম্যান্ডেলা সহ প্রচুর বর্ণবাদ বিরোধীকর্মীকে দেশদ্রোহিতার মামলায় গ্রেপ্তার করে অনেককে নির্যাতন করে হত্যা করে। সুদীর্ঘ ৫ বছর (১৯৫৬-১৯৬১) ধরে মামলা চললেও পরে সব আসামী নির্দোষ প্রামণিত হয়।

মুক্তি পেয়ে ১৯৬১ সালে এএনসির সশস্ত্র অঙ্গসংগঠন ‘উমখোন্তো উই সিযওয়ে’ (অর্থাৎ ‘‘দেশের বল্লম’’) এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ম্যান্ডেলা। তিনি বর্ণবাদী সরকার ও তার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতী ও চোরাগোপ্তা হামলা পরিকল্পনা ও সমন্বয় করেন। এতেও বর্ণবাদী সরকার পিছু না হটলে প্রয়োজনবোধে গেরিলা যুদ্ধে যাবার জন্যও পরিকল্পনা করেন। ম্যান্ডেলার সহকর্মী উলফি কাদেশ ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে শুরু করেন সশস্ত্র আন্দোলন। ম্যান্ডেলা নিজে তার এই সশস্ত্র আন্দোলনকে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে নিতান্তই শেষ চেষ্টা বলে অভিহিত করেন। দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা নিপীড়ন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন সফল হবে না বলে তিনি উপলব্ধি করেন এবং এ জন্যই সশস্ত্র আন্দোলনের পথ বেছে নেন।

১৯৬২ সালের ৫ আগষ্ট ম্যান্ডেলাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে জোহানেসবার্গের দূর্গে আটক রাখা হয়। ১৯৬১ সালে শ্রমিক ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেয়া এবং বেআইনীভাবে দেশের বাইরে যাবার অভিযোগে তাকে অভিযুক্ত করা হয়। ১৯৬২ সালের ২৫ অক্টোবর ম্যান্ডেলাকে এই দুই অভিযোগে ৫ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। এর দুই বছর পর ১৯৬৪ সালের ১১ জুন ম্যান্ডেলার বিরুদ্ধে এএনসির সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্বদানের অভিযোগ আনা হয় ও শাস্তি দেয়া হয়। ম্যান্ডেলার কারাবাস শুরু হয় রবেন দ্বীপের কারাগারে। এখানে তিনি তার ২৭ বছরের কারাবাসের প্রথম ১৮ বছর কাটান। সশ্রম কারাদণ্ডের অংশ হিসাবে রবেন দ্বীপের কারাগারে ম্যান্ডেলা একটি চুনাপাথরের খনিতে শ্রমিক হিসাবে কাজ করতেন। কারাগারে থাকার সময়ে ম্যান্ডেলা লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষণ কর্মসূচীর আওতায় পড়াশোনা শুরু করেন।

১৯৬৪ সালের ২০ এপ্রিল প্রিটোরিয়াল সুপ্রিম কোর্টে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ম্যান্ডেলা তার জবানবন্দিতে ব্যাখ্যা করেন কেনো এএনসি সশস্ত্র আন্দোলন বেছে নিয়েছে। ম্যান্ডেলা বলেন, বহু বছর ধরে এএনসি অহিংস আন্দোলন চালিয়ে এসেছিলো। কিন্তু শার্পভিলেন গণহত্যার পর তারা অহিংস আন্দোলনের পথ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই গণহত্যা, কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকারকে অবজ্ঞা করে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র ঘোষণা দেয়া, জরুরি অবস্থার ঘোষণা এবং এএনসিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পরে ম্যান্ডেলা ও তার সহযোদ্ধারা অন্তর্ঘাতমূলক সশস্ত্র সংগ্রামকেই বেছে নেন। তাদের মতে সশস্ত্র আন্দোলন ছাড়া অন্য কোনো কিছুই হতো বিনাশর্তে আত্মসমর্পণের নামান্তর। আশির দশকে বর্ণবাদী সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে ম্যান্ডেলার দল। এতে অনেক বেসামরিক লোক হতাহত হন। ম্যান্ডেলা স্বীকার করেন, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে গিয়ে এএনসি অনেক সময় মানবাধিকার লংঘন করেছে।

বর্ণবাদের অবসানের পর ১৯৯৪ সালের ১০ মে নতুন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন নেলসন ম্যান্ডেলা। এর মাত্র এক দশক আগেও সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ শাসিত দক্ষিণ আফ্রিকায় এই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ছিল এক অকল্পনীয় ঘটনা। এই পরিবর্তনের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। শুধু দক্ষিণ আফ্রিকায় নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায়ও তিনি ভূমিকা রাখেন। ১৯৯৩ সালে তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও দেশের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি ক্ষমতা আঁকড়ে রাখেননি, প্রথম কার্যকালের শেষেই ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে অবসর নেন।

২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর গোটা দুনিয়ার কোটি কোটি ভক্তকে ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান এ কিংবদন্তী। এ সময় তার বয়স ছিল ৯৫।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত