রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ফিরতে বাধ্য করছে সৌদি আরব

প্রকাশ : ০৮ নভেম্বর ২০১৮, ১৭:১৭

সাহস ডেস্ক

আটকাবস্থায় থাকা রোহিঙ্গা ও মানবাধিকার কর্মীদের উদ্ধৃত করে মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই জানিয়েছে, ভুয়া বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরবে গিয়ে আটক হওয়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ফিরতে বাধ্য করা হচ্ছে। তবে এমন একটি নথিতে তাদের স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হচ্ছে যেখানে বলা রয়েছে, তারা ‘স্বেচ্ছায় ফিরতে সম্মত’।

মিডল ইস্ট আই জানিয়েছে, এরইমধ্যে তাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এমন অবস্থায় আটক শরণার্থীরা আতঙ্কিত অবস্থার মধ্যে দিন পার করছেন। কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশে ফিরে গেলে আত্মহত্যা ছাড়া কোনও পথ থাকবে না তাদের।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, রোহিঙ্গারা ফাঁদে পড়েছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, তারা সৌদি আরবের এই কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে অবগত। তবে ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে বাংলাদেশ ও সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগে ব্যর্থ হয়েছে মিডল ইস্ট আই।

অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই’র দীর্ঘ চার মাসের অনুসন্ধানে জানা যায়, কোনও অভিযোগ ছাড়াই সৌদি আরবে বেশ কয়েক বছর ধরে আটক রাখা হয়েছে কয়েকশ রোহিঙ্গা পুরুষ, নারী ও শিশুদের। এদের বেশিরভাগ ২০১১ সালের পর মিয়ানমারের নিপীড়ন এড়াতে ও জীবিকার তাগিদে তেল সমৃদ্ধ দেশটিতে পৌঁছায় ভুয়া পাসপোর্ট নিয়ে। মিডল ইস্ট মনিটরের দাবি, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সৌদি সরকার। তাদের দাবি, অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চারদিনের সৌদি আরব সফর করার পরপরই তাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়।

মিডল ইস্ট জানায়, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও নেপাল থেকে ভুয়া পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরব পাড়ি জমাচ্ছে। সৌদি আরবে প্রবেশের পরই বিদেশি পাসপোর্টধারী সবাইকে সৌদি অভিবাসন কর্তৃপক্ষকে আঙুলের ছাপ দিতে হয়। ২০১০ সালে এই ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। এতে করে ভুয়া পাসপোর্ট নিয়ে আসা রোহিঙ্গারা ধরা পড়ছে। এই ব্যবস্থার আগে যাদের আটক করা হয়েছে তাদেরকে চিহ্নিত করতে স্থানীয় রোহিঙ্গাদের সহায়তা নেওয়া হতো। সৌদি সরকারের তথ্য মতে, শুমাইসি কারাগারে প্রায় ৩২ হাজার কাগজপত্রহীন শ্রমিককে আটক করা হয়েছে। অনেককেই গ্রেফতারের পরই নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়। রোহিঙ্গারাও আশঙ্কা করছেন, হয় তাদের বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির নয়তো মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হতে পারে।

কয়েকজন রোহিঙ্গা বন্দি অভিযোগ করেন,  এমন একটি নথিতে পুলিশ তাদের স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছে যেখানে বলা আছে যে ‘সম্পূর্ণ নিজ সম্মতিতে’ বাংলাদেশে যাচ্ছে তারা। সৌদি অভিবাসন পুলিশরা তাদের ওপর শারীরিক নিপীড়ন চালিয়ে করে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রোহিঙ্গা বলেন, ‘ফরমগুলো আগে থেকেই পূরণ করে রেখেছে বাংলাদেশি দূতাবাস ও সৌদি অভিবাসন পুলিশ। তাদের শুধু আমাদের আঙুলের ছাপ নিয়েছে এবং  আমাদের ঘুষিও মেরেছে।’ ওই রোহিঙ্গা আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে গেলে আমাদের আশ্রয় শিবিরে থাকতে হবে। সেখানে আমাদের কি ভবিষ্যত আছে?’

গত বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্ব-পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ৭ লাখেরও বেশি মানুষ। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৭ সালের নভেম্বরে ‘অ্যারেঞ্জমেন্ট অন রিটার্ন অব ডিসপ্লেসড পার্সন্স ফ্রম রাখাইন স্টেট’ নামে  বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পন্ন হয়। তবে এখন পর্যন্ত প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় একজন রোহিঙ্গাকেও ফিরিয়ে নেওয়ার সুনিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ বলছে, এখন পর্যন্ত কোনও রোহিঙ্গাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিরিয়ে নেয়নি মিয়ানমার।

তবে ইতোমধ্যে সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা পাঠানো শুরু হয়ে গেছে বলে জানান দেশটিতে আটক রোহিঙ্গারা। তারা জানান প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ জন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে। আগে আটক কেন্দ্রে মোবাইল ব্যবহার করতে দলেও এখন কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। আব্দুল গোলাম ছদ্মনামে এক রোহিঙ্গা বলেন, আগে আমরা বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গা পরিবান নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। আর এখন আমাদেরই সেখানে যেতে হচ্ছে।’ তাদের আশঙ্কা বাংলাদেশে গেলে আবার মিয়ানমারেই ফিরে যেতে হবে তাদের। আব্দুল গোলাম বলেন, ‘আমরা খুবই দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছি। অসুস্থ হয়ে পড়ছি। আমরা এখানে অনেকদিন ধরে আটকে আছি এবং মুক্তির আশা করছিলাম।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশে ফিরে গেলে আমাদের আত্মহত্যা ছাড়া কোনও পথ থাকবে না। গোলাম বলেন, অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিরাও রোহিঙ্গাদের সাহায্যের আবেদন প্রত্যাখান করেছে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো সৌদি আরবের এই পদক্ষেপের সমালোচনা করেছে। মানবাধিকার কর্মীরা বলছে, শুধুমাত্র বাংলাদেশই রোহিঙ্গাদের আবেদনে সাড়া দিয়েছে। বিশ্বজুড়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা অধিকারকর্মী নায় সান লুইন বলেন, সৌদি সরকারের উচিত তাদের জোর করে না পাঠিয়ে তাদের নিয়ে কাজ করা। তাদের বেশিরভাগই শিক্ষিত এবং দশম শ্রেণী পাশ। বার্মিজ ভাষাও জানে তারা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষক অ্যাডাম কুগল বলেন, ‘সৌদি আরবে আটককৃত রোহিঙ্গারা একটি ফাঁদে আটক পড়ে গেছে। হয় তাদের অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক থাকতে হবে নয়তো তৃতীয় একটি দেশে যেতে হবে যেখানে তাদের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বসবাস করতে হবে। অ্যাডাম মনে করেন, সৌদি আরবের এমন পদক্ষেপ বন্ধ করে তাদের আশ্রয় দেওয়া উচিত।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার মুখপাত্র আমিনা জুবারি বলেন, তারা সৌদি আরবের এই পদক্ষেপ সম্পর্কে অবগত। তারা এই বিষয়ে সৌদি সরকারের সঙ্গে কথা বললে তারা জানায় কোনও রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হয়নি। যারা অন্য দেশের ভুয়া পরিচয় দিয়ে সৌদি আরবে প্রবেশ করেছে তাদের সেই দেশেই ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা তাদের।

১৯৫১ সালে রিফিউজি কনভেনশন অনুযায়ী কোনও শরণার্থী নীতি নেই সৌদি আরবেরর। ফলে শরণার্থীদের কাজের অনুমতি কিংবা চলাচলের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হয় না দেশটির।  দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে সৌদি আরবেই সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গার বসবাস। ১৯৭৩ সালে বাদশা ফয়সালের সময় মিয়ানমারে সহিংসতার শিকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হয়। সেদেশে জন্ম নেওয়া রোহিঙ্গাদেরও ক্ষেত্রেও একই নীতি অনুসরণ করা হয়।

বাংলা ট্রিবিউন

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত