নারীদের আট দফা দাবি নিয়ে ‘স্ফুলিঙ্গ’র আত্মপ্রকাশ

প্রকাশ | ২৮ আগস্ট ২০২১, ২২:০৮

আট দফা দাবি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করলো নারীদের নাগরিক প্লাটফর্ম ‘স্ফুলিঙ্গ’ | ছবি: সাকিব প্রত্যয়

দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার রাজনৈতিক ও মানবাধিকার কর্মী নারীদের সম্মিলিত উদ্যোগে নারীদের সাথে ঘটে যাওয়া মোরাল পুলিশিং, গণমাধ্যমের অসংবেদনশীল আচরণ এবং আইন ও বিচার বিভাগে পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করলো ‘স্ফুলিঙ্গ’ নামে নারীদের একটি নাগরিক প্লাটফর্ম।

২৮ আগস্ট (শনিবার) সকাল ১১টায় রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলরুমে ‘নারীর বিরুদ্ধে মোরাল পুলিশিং, গণমাধ্যমের অসংবেদনশীলতা এবং আইন ও বিচার বিভাগে পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে আমরা’ শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠকে আট দফা দাবি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে প্লাটফর্মটি।

গোলটেবিল বৈঠকের শুরুতেই উল্লেখিত কর্মসূচির অবস্থানপত্র পাঠ করেন স্ফুলিঙ্গের সদস্য পূরবী তালুকদার। পুরো বৈঠকটি যৌথভাবে সঞ্চালনা করেন স্ফুলিঙ্গের সদস্য মোশফেকা আরা শিমুল এবং ইশরাত জাহান উর্মি। 

বিগত বছরগুলোর বিভিন্ন ঘটনার বরাত দিয়ে নেতাকর্মীরা জানান, নারীর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মোরাল পুলিশিং এবং গণমাধ্যমে নারীর ব্যক্তিগত জীবনকে উন্মুক্ত করে প্রচার করা হচ্ছে কেলেঙ্কারিকরণের সংবাদ। এর মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা হয় সমাজের প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক জনমতকে। এরই সাথে এই পুরুষতান্ত্রিকতাকে কাজে লাগিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করা হয় রাষ্ট্রীয় প্রভাবশালীদের অপরাধ। এর পাশাপাশি বিচার বিভাগের বিশেষ ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব এবং আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক আইনের অপব্যবহার করে নারীদের নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করার বিষয়টি প্রায়শই পরিলক্ষিত হচ্ছে।

স্ফুলিঙ্গ মনে করে, একটি রাষ্ট্র এবং তার প্রতিষ্ঠানসমূহের দীর্ঘদিনের অগণতান্ত্রিক এবং পুরুষতান্ত্রিক চর্চাই নারীর বিরুদ্ধে তৈরি করছে এ অন্যায্যতা।

বৈঠক চলাকালীন ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সানজিদা নীরা জানান যে, গণমাধ্যম এবং বিজ্ঞাপনসমূহ তাদের কাটতি বাড়াতে নারীদের নিয়ে এই ধরণের অসংবেদনশীল সংবাদ পরিবেশন করে। নারীকে এভাবে উপস্থাপন না করেও যে গণমাধ্যম চলতে পারে এই ধারণায় আসতে হবে। 

১৯৯৫ সালের ইয়াসমিন ট্র্যাজেডির ঘটনা উল্লেখ করে আইনজীবি সুলতানা আক্তার রুবি বলেন, তখন একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল ইয়াসমিনের ন্যায়বিচারের পক্ষে। পুরো দেশের সামাজিক আন্দোলন, জনমানুষের আন্দোলন ইয়াসমিন ধর্ষণ এবং হত্যাকান্ড অপরাধে ন্যায়বিচারকে সম্ভব করেছিল। অথচ আমাদের এখন সেই গণতান্ত্রিক পরিবেশটাই নেই।

বৈঠকে স্ফুলিঙ্গের সাথে সংহতি প্রকাশ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, দেশে এই মুহুর্তে আইন বা আদালত বলে কিছু নেই। তাই ক্রসফায়ার,গুমের মত অহরহ ঘটনা আমরা দেখতে পাই যেখানে রাষ্ট্রীয় বাহিনী যাকে গুলি করতে চায়, তাকেই মেরে ফেলতে পারে। ক্রসফায়ারের পর এইসকল রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিবৃতি যে মিথ্যা তা সমাজের সবাই জানে। 

তিনি মনে করেন, গণমাধ্যম নারীবিদ্বেষী এইসকল সংবাদ পরিবেশন করে মূলত জনমত তৈরি করতে যা ইতোমধ্যে ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় নীতিমালা দিয়ে সমাজে প্রচলিত রয়েছে। এই প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন যে, একজন গার্মেন্টস শ্রমিক নারীকে মজুরি কম দিতে এবং প্রতিবাদ থামানো সহজ হয় যখন তার ব্যক্তিগত চরিত্রকে উন্মুক্ত করে তার বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডামুলক তথ্য প্রচার করা হয়।

গোলটেবিল বৈঠকে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, আলোকচিত্রী এবং বাংলাদেশ সাম্যবাদী আন্দোলনের সদস্য জান্নাতুল মাওয়া, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের সম্পাদক খান আসাদুজ্জামান মাসুম, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য লুনা নুর, নারী মুক্তি কেন্দ্রের ঢাকা নগরের সভাপতি তাসলিমা বিউটি, বিপ্লবী নারী ফোরাম ঢাকা নগরের সদস্য আমেনা আক্তার, কথাসাহিত্যিক নুরন্নবী শান্ত, কবি ও সাংবাদিক রহমান মুফিজ, উন্নয়নকর্মী ফেরদৌস আরা রুমী প্রমুখ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সানজিদা নীরা ও আইনজীবি তাসমিয়াহ নুহাইয়া আল আমিনসহ কয়েকজন আলোচক ভার্চুয়াল মাধ্যমে  যুক্ত হয়ে আলোচনায় অংশ নেন। এছাড়াও ওয়াইডাব্লিউসি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জেসমিন দিনাসহ প্রায় চল্লিশজন একটিভিস্ট উপস্থিত ছিলেন।

‘স্ফুলিঙ্গ’র আট দফা
‘নারীর বিরুদ্ধে মোরাল পুলিশিং, গণমাধ্যমের অসংবেদনশীলতা এবং আইন ও বিচার বিভাগে পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে আমরা’ শীর্ষক বৈঠকে স্ফুলিঙ্গের পক্ষ থেকে ৮ দফা দাবি আহবান করা হয়। দাবিগুলো- গণমাধ্যমকে মুক্ত এবং স্বাধীন করতে হবে/ আইনের অপব্যবহার করে নাগরিকের ব্যক্তিপরিসরে ঢুকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা বন্ধ করতে হবে/ প্রতিটি গণমাধ্যম এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমুহকে নারীর বিরুদ্ধে অসংবেদনশীল আচরণ, শব্দ চয়ন এবং ছবি ব্যবহার বন্ধ করতে হবে/ গণমাধ্যমে নারীর বিরুদ্ধে অসংবেদনশীল সংবাদ পরিবেশন, শব্দ চয়ন এবং ছবি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে/ প্রতিটি সাংবাদিক এবং গণমাধ্যমকর্মীদের উল্লেখিত নীতিমালা বিষয়ে অবগত করতে হবে এবং জেন্ডার সংবেদনশীলতার প্রশিক্ষণ দিতে হবে/ নারীর বিরুদ্ধে সমাজের প্রচলিত মোরাল পুলিশিং এর বিরুদ্ধে গণমাধ্যমকে সোচ্চার থাকতে হবে/ নারীর সহিংসতা সংক্রান্ত অভিযোগ স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে হবে। এ সকল অভিযোগে তদন্ত না করে অভিযুক্তকে আইনি প্রক্রিয়া থেকে অব্যাহতি দেওয়া যাবে না।/ বিচার বিভাগকে স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ করতে হবে।

সাহস২৪.কম/এসটি/এসএ.