সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ

বাংলাদেশ ৩-১ নেপাল: ইতিহাস গড়ল অদম্য মেয়েরা

প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২২:১৪

সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ- চ্যাম্পিয়ন ট্রফি হাতে বাংলাদেশের মেয়েদের উল্লাস। ছবি: সংগৃহীত

দুর্দান্ত ফুটবল খেলেই ফাইনালে এসেছিল বাংলাদেশের মেয়েরা। সেই দারাবাহিকতা বজায় রেখেই ফাইনালে নেমেছিল স্বাগতিক নেপালের বিপক্ষে। দিয়েছে তাদের সর্বোচ্চটা। ১৫ হাজার দর্শকের সামনে কর্দমাক্ত মাঠে নেপালকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পড়ল বাংলাদেশ।

সোমবার (১৯ সেপ্টেম্বর) কাঠমুন্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে ২০২২ নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে গোলাম রব্বানি ছোটনের শিষ্যরা। জোড়া গোল করেছেন কৃষ্ণা নারী সরকার আর বাকি গোলটি করেছেন শামসুন নাহার জুনিয়র। এর আগে ২০১৬ সালে একবার সাফের ফাইনাল খেলেছিল বাংলাদেশ। সেবার শক্তিশালি ভারতের কাছে হেরে সেরার মুকুটটা পড়া হয়নি তাদের।

এদিন ম্যাচ শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে হয়েছে তুমুল বৃষ্টি। আর এই বৃষ্টিতে মাঠ হয়ে যায় ভারী। কিন্তু এই ভারী মাঠেও ছন্দময় ফুটবল খেলেছেন মারিয়া, মনিকারা। ছন্দময় ফুটবল খেলতে নেমে ম্যাচের প্রথম মিনিটেই গোলের সুযোগ পেয়েছিল বাংলাদেশ। বক্সের বাইরে থেকে নেয়া মারিয়ার দূরপাল্লার শট আটকালেও পুরোপুরি গ্লাভসে জমাতে পারেননি নেপালের গোলরক্ষক আনজিলা সুব্বা। সিরাত জাহানের শট শেষ পর্যন্ত কর্নারের বিনিময়ে ফেরান আনজিলা।

চোট নিয়ে খেলতে নামা ফুলব্যাক সিরাত জাহান এদিন লড়তে পারেননি বেশিক্ষণ। ম্যাচের ১০ মিনিটের সময় মাঠ ছাড়ের তিনি। তার বদলে নামেন ফরোয়ার্ড শামসুন নাহার জুনিয়র। নামার ৩ মিনিট পরেই বাংলাদেশকে এগিয়ে দেন শামসুন নাহার। ম্যাচের ১৩তম মিনিটে ডান প্রান্ত দিয়ে মনিকা চাকমার বাড়ানো বলে দারুণ ফ্লিকে গোল করেন শামসুন নাহার। টুর্নামেন্টে এটিই নেপালের জালে প্রথম গোল। এরপর ম্যাচের ৩৪ মিনিটে বক্সের বাইরে থেকে ফ্রি-কিক নেন নেপালের দীপা শাহি। কিন্তু শটটি দারুণ দক্ষতায় ফিস্ট করেন বাংলাদেশের গোলরক্ষক রুপনা।

গোল শোধে মরিয়া নেপাল তখন পাল্টা আক্রমণে ব্যস্ত। কিন্তু ৪২ মিনিটে নেপালি দর্শকদের স্তব্ধ করে দেন কৃষ্ণা নারী সরকার। নেপালের ভুল পাস থেকে বল পেয়ে যান সাবিনা। এ দলনেতার ডিফেন্স চেরা পাস ধরে বক্সে ঢোকেন কৃষ্ণা। দুর্দান্ত হাওয়ায় ভাসানো শটে গোলকিপার আনজিলার মাথার ওপর দিয়ে বল জালে জড়িয়ে বাংলাদেশকে ২-০ করেন কৃষ্ণা। তবে দ্বিতীয় গোলটির আগে সমতায় ফিরতে পারত নেপাল। কিন্তু তা হয়নি। কর্নার থেকে বাংলাদেশ গোলকিপার রুপনা চাকমা ঠিকভাবে বল ধরতে পারেননি। এই সময় গোললাইন সেভ হয়েছে। বড় বাঁচাই বেঁচে গেছে বাংলাদেশ। কিন্তু খেলার ধারার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় গোলটি করে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল সাবিনার দল। এরপর প্রথমার্ধে আর কোনো গোল না হলে এই ২-০ গোলে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যায় বাংলাদেশ।

গোলের পর উল্লাসে মাতে সাবিনার দল। ছবি: সংগৃহীত

বিরতি থেকে ফিরে এসে গোল শোধে মরিয়া হয়ে ওঠে নেপাল। স্বাগতিকদের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার সাবিত্রা ভান্ডারি ছিলেন ডেঙ্গু জ্বরে অসুস্থ। পুরোপুরি ফিট না হলেও শেষ পর্যন্ত তাকে নামিয়ে দেন নেপালের কোচ। দলের এই সেরা স্ট্রাইকার নামার পর আক্রমণ বেড়ে যায় নেপালের। সাবিত্রা আর অনিতা মিলে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশের বক্সেও ঢুকেছেন। তাদের দুর্দান্ত আক্রমণে ম্যাচের ৬৯ মিনিটে একটি গোলও শোধ করেছে নেপাল। ডান প্রান্ত দিয়ে ঢোকেন অনিতা। শামসুন্নাহারকে ফেলে সহজেই ঢুকে যান বক্সে। এরপর কোনাকুনি শটে বাংলাদেশের জালে বল জড়িয়ে ব্যবধান কিছুটা কমান অনিতা। মুহূর্তেই যেন আবারও জেগে ওঠে দশরথ স্টেডিয়াম। এর চার মিনিট পর সমতায় ফিরতে পারত নেপাল। অনিতার কর্নারে বদলি সাবিত্রা ভান্ডারির শট চলে যায় পোস্ট ঘেঁষে।

এরপরই নেপালের উল্লাস থামিয়ে দেয় বাংলাদেশের মেয়েরা। ম্যাচ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ৭৭ মিনিটে কৃষ্ণার গোলে আবারও এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। নেপালের বক্সের সামান্য বাইরে থেকে সাবিনার বাড়িয়ে দেয়া বলে আবারও বক্সে ঢোকেন কৃষ্ণা। সামনে তখন শুধুই নেপালের গোলরক্ষক আনজিলা। সহজেই প্লেসিংয়ে নেপালের জালে বল জড়িয়ে নিজের জোড়া গোল পূর্ণ করেন কৃষ্ণা নারী সরকার। তখন স্কোরবোর্ডে গোলের সংখ্যা দেখা যায় বাংলাদেশ ৩ ও ১ নেপাল। রেফারির শেষ বাঁশি বাজার আগ মুহুর্তে আর কোনো গোল না হলে এই ৩-১ গোলের জয় নিয়ে উল্লাসে মাতে গোলাম রব্বানি ছোটনের দল, সঙ্গে লাল-সবুজের বাংলাদেশ। এই জয়ে এক যুগের অপেক্ষা শেষ হলো সাবিনাদের। ২০১০ সালে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজন শুরু হয়। সেই থেকে টানা পাঁচ আসরে চ্যাম্পিয়ন হয় ভারত। ২০১৬ সালে একবার সাবিনার দল ফাইনালে উঠেছিল। সেবার ভারতের কাছে ৩-১ গোলে হেরে শিরোপা খোয়াতে হয় ছোটনের দলকে।

টুর্নামেন্টের সেরা গোলদাতা ও সেরা খেলোয়াড় অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের মেয়েদের প্রথম সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ে বড় অবদান রেখেছেন দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। টুর্নামেন্টে দুটি হ্যাটট্রিকসহ মোট ৮ গোল করে তিনিই সর্বোচ্চ গোলাদাতা। ফাইনালে গোল না পেলেও গোলের সহায়তা করেছেন দলনেতা। টুর্নামেন্টের প্রথম রাউন্ডে মালদ্বীপের বিপক্ষে ৩-০ গোলের জয়ে দুটি গোল করেন সাবিনা। পাকিস্তানের বিপক্ষে ৬-০ গোলে জয়ে ৩ গোল এবং ভারতের বিপক্ষে ৩-০ গোলের জয়ে সাবিনা গোল না পেলেও সেমিফাইনালে ভুটানের বিপক্ষে ৮-০ গোলের জয়ে ৩ গোল করেন সাবিনা। তবে এর চেয়েও বড় স্বীকৃতিটা আদায় করে নিয়েছেন অধিনায়ক। হয়েছেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ও। টুর্নামেন্টে সেরা গোলকিপার বাংলাদেশের রুপনা চাকমা। ৫ ম্যাচে যার বিপক্ষে গোল হয়েছে মাত্র একটি।

জয়ের পর শিরোপা হাতে নিয়ে অধিনায়ক সাবিনা খাতুন প্রকাশ করেছেন তীব্র উচ্ছ্বাস, ‘দীর্ঘ ১২-১৩ বছরের অপেক্ষা শেষ হয়েছে। এই ট্রফি সারা দেশের, সারা দেশের মানুষের। ভালো লাগছে যে ট্রফিটা নিয়ে যেতে পারছি।’ ব্যক্তিগত অর্জন নিয়ে ২৮ বছর বয়সী সাবিনা বলেন, ‘আমরা ফেয়ার প্লে ট্রফি জিতেছি। আমি সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার ও আসরের সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড়ের পুরস্কারও জিতেছি। শিরোপা জেতার পাশাপাশি এটা আমার জন্য অনেক বড় অর্জন। আমি মনে করি, এটা আমার জীবনের সেরা দিন।’

১৯৮৪ সালে ছেলেদের সাফ গেমস শুরু হয়েছিল। তার ১৫ বছর পর ১৯৯৯ সালে সাফে প্রথম চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ পেয়েছিল বাংলাদেশ। তার ২২ বছর পর আবারও সাফের স্বাদ পেল বাংলাদেশ, এবার মেয়েদের হাত ধরে। এ পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে বোঝা যায় সাফ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে ছেলে দলের থেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে নারীদের দল। ২০২৩ সালের মার্চে পাকিস্তানে বসছে সাফের পরবর্তী আসর। বাংলাদেশ নারী দলের পরের লক্ষ্য নিশ্চিতভাবেই সাফ গেমস ফুটবলের শিরোপা জয়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত