পাঁচ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচ

প্রথমবার নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে বাংলাদেশের রেকর্ড জয়

প্রকাশ | ০১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৯:০১ | আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২২:১৬

জয় পেতে বাংলাদেশের দরকার ৩১ বলে মাত্র ৩ রান। ব্যাটে ছিলেন মুশফিকুর রহিম। বলে ছিলেন কোল ম্যাককনচি। ১৫তম ওভারের শেষ বলটি ম্যাককনচি দিলেন মিডল স্টাম্প সোজা। এগিয়ে এসে মিডউইকেট দিয়ে দারুণ শটে বাউন্ডারি মেরে দলের জয় এনে দিলেন মুশফিকুর রহিম। এই জয়ে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে দারুণ একটি রেকর্ড গড়ল বাংলাদেশ। টি-টোয়েন্টিতে টানা দশ ম্যাচ পর কিউইদের বিপক্ষে জয় পেলো টাইগাররা।

বুধবার (১ সেপ্টেম্বর) মিরপুর শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে পাঁচ ম্যাচ টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচে সফরকারি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৭ উইকেটের বড় জয় পেয়েছে স্বাগতিক বাংলাদেশ।

নিউজিল্যান্ডের দেওয়া মাত্র ৬১ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ১৫ ওভারে মাত্র ৩ উইকেট হারিয়ে ৬২ রান করে জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ।

স্বল্প রান হলেও টানিং উইকেট ধরে রাখতে পারেনি বাংলাদেশ। হারিয়েছে ৩ উইকেট। দলের হয়ে ওপেনিংয়ে নামেন মোহাম্মদ নাঈম ও লিটন দাস। স্পিন দিয়ে শুরু করল নিউজিল্যান্ড। প্রথম ওভারে ১ রানের বেশি তুলতে পারেনি বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ওভারে ম্যাককনচির বলেই নাঈমের পতন।

দ্বিতীয় ওভারে প্রথম বলটি ঝুলিয়ে দেন ম্যাককনচি। এগিয়ে এসে মারতে গিয়ে কাভারে থাকা হেনরি নিকোলাসের হাতে ধরা পরেন নাঈম। মাত্র ১ রান করে ফেরেন তিনি। এতেই আন্তর্জাতিক অভিষেকে প্রথম বলেই উইকেট পেলেন ম্যাককনচি। যদিও ব্যাট হাতে শূন্য রানে ফিরেছিলেন তিনি।

এরপর ফিরলেন লিটনও। তৃতীয় ওভারের পঞ্চম বলটি ঝুলিয়ে দেন এজাজ প্যাটেল। বেশ খানি ক্রিজের বাইরে এগিয়ে ড্রাইভ করতে গিয়ে মিস করেন লিটন। সাথে সাথে টম লাথাম গ্লবসে বলটি জড়িয়ে স্ট্যাম্প ভেঙে ফেললেন। আঙুল জাগালেন আম্পায়ার। মাত্র ১ রান করে স্ট্যাম্পিং হয়ে সাজ ঘরে ফিরে গেলেন লিটন দাস।

এরপর জুটি বাঁধা শুরু করলেন সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহিম। পাওয়ার প্লের ৬ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে ২২ রান তোলে বাংলাদেশ। কিন্তু দলীয় ৩৭ রানের সময় উইকেট হারান সাকিব। দশম ওভারে রচিন রবীন্দ্রর পঞ্চম বলে লেট কাট করতে গিয়ে ব্যাটের কোনায় লেগে কিপারের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডার। ৩৩ বলে ২ চারে ২৫ রান করেন তিনি। আর সাকিবের উইকেট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম উইকেট পেলেন রচিন রবীন্দ্র।

এরপর নামেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। তখন জিততে হলে দরকার ৬০ বলে ২৪ রান। পরে আর কোনো উইকেট হারায়নি বাংলাদেশ। ছোটো একটি জুটি বেঁধে অনায়াশে জয় নিয়ে ফেরেন মুশফিক-মাহমুদউল্লাহ। ২৬ বলে ১ চারে ১৬ রান করে অপরাজিত থাকেন মুশফিকুর রহিম এবং ২২ বলে ২ চারে ১৪ রান করে অপরাজিত থাকেন অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।

কিউইদের হয়ে এজাজ প্যাটেল, কোল ম্যাককনচি ও রচিন রবীন্দ্র ১টি করে উইকেট নেন।

এর আগে টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় নিউজিল্যান্ড। ব্যাট করতে নেমে ১৬.৫ ওভারে মাত্র ৬০ রানে সফরকারিদের অলআউট করে বাংলাদেশ।

শুরুতেই শেখ মেহেদী হাসানের উইকেট। শুরুর প্রথম ওভারের তৃতীয় বলে ক্যাচ নিয়ে গোল্ডেন ডাক উপহার দিলেন আন্তর্জাতিক অভিষেক হওয়া রাচিন রবীন্দ্রকে। প্রথম ওভারে মেদেহীর দ্বিতীয় বলে টম ব্লান্ডেল সিঙ্গেল নিয়ে স্ট্রাইক দেন রবীন্দকে। কিন্তু অভিষেক হওয়া রবীন্দ্র জীবনের প্রথম বল ফেইজ করেই বিদায় নিলেন শূন্য রানে। ব্যাটের কানায় লেগে সহজ ক্যাচ যায় মেহেদীর হাতে। কিউইদের হয়ে টি-টোয়েন্টি অভিষেকে গোল্ডেন ডাক পাওয়া চতুর্থ ক্রিকেটার এখন রবীন্দ্র। আগের তিনজন ম্যাথু সিনক্লেয়ার, কাইল মিলস ও ফিন অ্যালেন।

মেহেদীর পরই সাকিব আল হাসানের উইকেট। তৃতীয় ওভারে সাকিবের পঞ্চম বলটিতে কাট করতে গিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনেন উইলি ইয়াং। স্ট্যাম্পের বেশ বাইরের নিচু হওয়া বলটি কাট করতে গিয়ে ব্যাটের কানায় লেগে আঘাত করে স্টাম্পে। মাত্র ৫ রান করে বোল্ড হয়ে ফেরেন ইয়াং।

সাকিবের পর নাসুম আহমেদের আঘাত। কলিন ডি গ্র্যান্ডহোমকে চারে নামিয়েছে নিউজিল্যান্ড। কিন্তু তাতে সফল হতে পারেনি তারা। নাসুমের বল উড়িয়ে সুইপ করতে গিয়ে সীমানায় থাকা মোহাম্মদ নাঈমের হাতে ধরা পড়েন অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার ডি গ্র্যান্ডহোম।

এই একই ওভারে নাসুমের আরো এক উইকেট। ওপেনিংয়ে নেমে এক প্রান্ত থেকে তিন উইকেটের পতন দেখা টম ব্লান্ডেলকে বোল্ড করে ফেরান নাসুম। নাসুমের ঝুলিয়ে দেওয়া স্টাম্প সোজা বল জায়গা বানিয়ে খেলতে গিয়ে পুরোপুরি লাইন মিস করে বোল্ড হন ব্লান্ডেল। মাত্র ২ রান করে ফেরেন তিনি। একই ওভারে দুই উইকেট নিলেন নাসুম আহমেদ।

পাওয়ার প্লে যেন দুঃস্বপ্নের মতো কাটল কিউইদের। ৬ ওভারে মাত্র ১৮ রান করেই ৪ উইকেট হারায় কিউইরা।

এরপর ছোটো একটি জুটি বাঁধেন লায়ন লাথাম ও হেনরি নিকোলাস। কিন্তু এই জুটি বেশি দূর এগোতে পারেনি। তাদের মাত্র ৩৪ রানের জুটিতে আঘাত হানেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। ১১তম ওভারে সাইফউদ্দিনের শেষ বলটি ছিল লেগ স্টাম্পে অনেকটা শর্ট ডেলিভারি। কিন্তু বলটি পুল করতে গিয়ে টাইমিং মেলাতে পারেননি লাথাম। বলটি ব্যাটের উপরের দিকে লেগে ফাইন লেগে থাকা নাসুম আহমেদের হাতে চলে যায়। সহজেই ক্যাচটি ধরে ফেলেন নাসুম। ২৫ বলে ১৮ রান করে সাজঘরে ফেরেন টম লাথাম।

এরপর ফের সাকিবের আঘাত। ১২তম ওভারে মিডল স্টাম্পে থাকা ফুল লেংথ বলটি কবজির মোচড়ে খেলে মিড উইকেটে বৃত্তের ভেতরই সরাসরি মুশফিকুর রহিমের হাতে তুলে দেন ম্যাককনচি। শূন্য রানে ফেরেন তিনি। আরেক অভিষিক্ত রবীন্দ্রর মতো গোল্ডেন ডাক নিয়ে ফেরেন অভিষিক্ত এই কোল ম্যাককনচি। দলের তখন ৬ উইকেটে ৪৫ রান।

এর ৫ রান পর ফেরেন হেনরি নিকোলাস। তাকে ফেরান সাইফউদ্দিন। সাইফের ফুল লেংথ বলটি উড়িয়ে মারতে গিয়ে লং অনে কিছুটা দৌড়ে দারুন ক্যাচ ধরেন মুশফিকুর রহিম। যদিও বলটি স্লোয়ার ছিল, তাই মারে জোর হয়নি। ২৪ বলে ১৭ রান করে ফেরেন নিকোলস। ৫ বছর পর আউটফিল্ডে ফিল্ডিং করে মুশফিক নিলেন দ্বিতীয় ক্যাচ।

এরপরই মুস্তাফিজের আঘাত। দ্বিতীয় স্পেলে বল করতে এসে প্রথম বলেই উইকেট নিলে কাটারমাস্টার। ১৫তম ওভারের প্রথম বলটি কাটার দিয়েছিলেন তিনি। তবে তার চেনা অস্ত্র কাটার ছিল না এটি। হয়ে যায় ফুল লেংথ সিম আপ ডেলিভারি। কিন্তু ব্যাটে থাকা এজাজ প্যাটেল বাজে শট করে বোল্ড হন। তখন দলীয় ৫২ রান। মাত্র ৩ রান করে ফেরেন এজাজ। আর এই ম্যাচে মোস্তাফিজের এটাই প্রথম উইকেট।

তার ৩ রান পরেই আবারো মুস্তাফিজের উইকেট। একই ওভারেই। তার প্রথম ওভারের প্রথম বলে উইকেট পাওয়ার পর পঞ্চম বলে উইকেট পেলেন কাটারে। মোস্তাফিজের খাটো লেংথের বলটি হাঁটুগেড়ে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ফাইন লেগে থাকা শেখ মেহেদি হাসান হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন ডগ ব্রেসওয়েল। মাত্র ৫ রান করে ফেরেন তিনি।

তখন কিউইদের মাত্র ৫৫ রান, উইকেট হারিয়েছে ৯টি। হাতে শেষ উইকেট জ্যাকব ডাফি। বলে আসেন সাকিব। কিন্তু শেষ উইকেটটি ঘায়েল করতে পারেননি তিনি। তবে মোস্তাফিজ মোটেও ছাড় দেননি। সাকিবের পরের ওভারটি করতে আসেন মোস্তাফিজ। সেই ওভারের চতুর্থ বলটি স্টেটে উড়িয়ে মারেন জ্যাকব। সেখানে থাকা সাইফউদ্দিন উল্টো দৌড়ে লাফ দিয়ে ক্যাচটি ধরে ফেলেন। এতেই এতেই মাত্র ৬০ রানে গুটিয়ে যায় নিউজিল্যান্ড। 

কিউইদের ইতিহাসে যৌথ্যভাবে এটাই তাদের সর্বনিম্ন স্কোর। এর আগে ২০১৪ সালে চট্টগ্রামে এই ৬০ রানেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে গুটিয়ে গিয়েছিল কিউইরা।

কোনো প্রতিপক্ষকে সর্বনিম্ন রানে অলআউট করে প্রথম ইতিহাস গড়ল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বিপক্ষে কোনো প্রতিপক্ষের সর্বনিম্ন রানের রেকর্ডও এটা। পূর্নাঙ্গ ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে নিউজিল্যান্ডের আগের সর্বনিম্ন স্কোর ছিল ১৪৫।

শুধু নিউজিল্যান্ড নয়, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও সর্বনিম্ন রানের রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ। এর আগে মিরপুর স্টেডিয়ামেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচ সিরিজের শেষ ম্যাচে তাদের ৬২ রানে গুটিয়ে দিয়েছিল টাইগাররা। সেই সিরিজটি ৪-১ ব্যবধানে জিতেছিল বাংলাদেশ। তার পরের ম্যাচেই নিউজিল্যান্ডকে নিম্ন রানে গুটি দিলো টাইগাররা।

বাংলাদেশের হয়ে মোস্তাফিজুর রহমান ৩টি, নাসুম আহমেদ, সাকিব আল হাসান ও মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন ২টি করে এবং মেহেদী হাসান ১টি করে উইকেট নিয়েছেন।

ম্যাচ সেরা হয়েছেন সাকিব আল হাসান।