বাফুফের নির্বাচন এবং নয়, নব্বই এর দোলাচল

প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২০, ১৯:৩৫

বলা হয়ে থাকে যার হয় না নয়'এ তার হয় না নব্বই এও। কাজী সালাউদ্দিন এর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের ক্ষেত্রেও কী তেমনটাই হচ্ছে?

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি হিসেবে তিন মেয়াদে প্রায় ১২ বছর শেষ করেছেন দেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার কাজী সালাউদ্দিন চৌধুরী। চতুর্থ মেয়াদে প্রবেশের ক্ষণ গুনছেন তিনি। অথচ গত নির্বাচনে বলেছিলেন, ওটাই তাঁর শেষ নির্বাচন। সবকিছু গোছাতে পারলে তাঁর আর বাফুফের সভাপতি থাকার প্রয়োজন হবে না। কিন্তু সেই তিনি এখন বলছেন, অসমাপ্ত  কাজ শেষ করতে তাঁর আরেক মেয়াদ লাগবে।

চতুর্থবার নির্বাচিত হলে কী করবেন কাজী সালাউদ্দিন? গত ১২ বছরে কী করেছেন তিনি? সেটিও বিশ্লেষণের বিষয়। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের বয়স ৪৮ বছর। প্রথম ৩৬ বছরের চেয়ে বেশি আলোচনায় সর্বশেষ ১২ বছর। যেদিন থেকে বাফুফের দায়িত্ব নিয়েছেন সালাউদ্দিন। সব বাদ দিয়ে গত চার বছরের খতিয়ান বলছে, বয়সভিত্তিক ও জাতীয় দলের বিদেশি কোচিং স্টাফের পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ব্যয় আর বয়সভিত্তিক স্তরে কিছু সাফল্য ছাড়া দৃশ্যমান বড় অর্জন নেই এই সময়ে।

সর্বশেষ গত চার বছরে ১০০ কোটি টাকার ওপরে খরচ করেছে বাফুফে। যার মধ্যে প্রশাসনিক ব্যয়ই প্রায় ৪০ কোটি টাকা। বিনিময়ে প্রাপ্তি কী? জাতীয় দলের ফিফা র‌্যাঙ্কিং ঠেকেছে ইতিহাসে সর্বনিম্ন ১৯৭ (এখন অবশ্য ১৮৭) পর্যন্ত।

২০০৮ সালের ২৮ এপ্রিল তিনি দায়িত্ব নেয়ার ১৯ দিন আগে ঘোষিত ফিফা র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৮০। গত ১১ জুন ঘোষিত সর্বশেষ র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৭ নম্বরে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে-এই চার মাস ১৯৭ নম্বরে ছিল বাংলাদেশ। সর্বশেষ র‍্যাংকিংয়ের হিসেবে কাজী মো. সালাউদ্দিনের সভাপতিত্বের এই ১২ বছরে বাংলাদেশ পিছিয়েছে ৭ ধাপ।

এছাড়া তৃণমূলেতো কিছুই করতে পারেননি কাজী সালাউদ্দিন। বাফুফে ‘ঢাকা ফুটবল ফেডারেশন’ই রয়ে গেছে। বছরে অন্তত ২০-২৫টি জেলায় লিগ হয় না। তবু কোনো জবাবদিহি নেই।

২০০৮ সালে প্রথমবার বাফুফের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে কাজী সালাউদ্দিন বলেছিলেন, ‘আগে ঢাকার ফুটবলটা ঠিক করি। তারপর ঢাকার বাইরে হাত দেব।’ আশান্বিত হয়েছিলেন অনেকে। এটা ঠিক যে তিনি দেশের শীর্ষ ফুটবল লিগ নিয়মিত আয়োজন করতে পেরেছেন। তবে ফুটবল উন্নয়নে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাব রয়ে গেছে আগের মতোই। অথচ স্বপ্নের মতো বলেছিলেন, ‘২০২২ কাতার বিশ্বকাপে খেলবে বাংলাদেশ।’ সেই অলীক স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়ে অচিরেই। এশিয়ার সেরা ২০ দলেও ঢোকেনি বাংলাদেশ। উল্টো গত বছর বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ঢুকতেই প্রাণ ওষ্ঠাগত হয় এশিয়ার ৪৬ দেশে ৪২তম দলটির!

খারাপের মধ্যে ভালো, ২০১৮ এশিয়ান গেমসে প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠা (অনূর্ধ্ব-২৩ দল)। বর্তমান জাতীয় দলটা অবশ্য কাজী সালাউদ্দিনের চোখে ৫০ বছরের মধ্যে সেরা। তবে বাস্তবতা হলো, গত চারটি সাফ টুর্নামেন্টে গ্রুপ পর্বই পেরোতে পারেনি বাংলাদেশ। কদিন আগে সাফ গেমসে (অনূর্ধ্ব-২৩) হয়েছে ভরাডুবি। এতে বাফুফে সভাপতি বলেন, ‘আমি তো মাঠে খেলে দিতে পারব না। আমার কাজ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা।’

এত অর্থ খরচের পরও জাতীয় দল সালাউদ্দিনের সময়ই না পারলে আর কবে পারবে? ২০১০ সালে অনূর্ধ্ব-২৩ দল এসএ গেমসে সোনা জেতার পর থেকেই ট্রফিবিহীন বাংলাদেশের ফুটবল। এ সময়ে ফিফার দেওয়া দুটি টার্ফ ছাড়া ফুটবলে কোথায়ও কোনো সফলতা নেই।

কাজী মো. সালাউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিটি ১২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে পড়েছিল জাতীয় দল প্রথমবারের মতো ভুটানের কাছে হারায়। ২০১৬ সালের ১০ অক্টোবর থিম্পুতে এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের ফিরতি ম্যাচে বাংলাদেশকে ৩-১ গোলে হারিয়ে লজ্জা দিয়েছিল ভুটান। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে সেটাই ভুটানের বিরুদ্ধে প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র হার। তার এক মাস আগে হোম ম্যাচও জিততে পারেনি বাংলাদেশ। ভুটানের সঙ্গে করেছিল গোলশূন্য ড্র।

ভুটানের বিরুদ্ধে খেলা ১৩ টি আন্তর্জাতিক ম্যাচের মধ্যে একটি হার ও দুটি ড্র-সবাই হয়েছে বাফুফের সর্বশেষ তিন কমিটির সময়ে। ভুটান বাংলাদেশকে প্রথম রুখে দিয়েছিল ২০০৮ সালে। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ভুটানের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করেছিল বাংলাদেশ। ভুটানের বিপক্ষে ম্যাচ হারার পর রাজপথে মিছিল ও বাফুফে ভবনের সামনে মানববন্ধন পর্যন্ত হয়েছিল।

ফুটবলে এত টাকা খরচ হচ্ছে, অথচ আজ পর্যন্ত নিজস্ব একটা জিম নেই বাফুফের। একাডেমি তো আকাশের চাঁদ! ক্লাবগুলোকেও কার্যকরভাবে খেলোয়াড় তৈরির পথে আনতে পারেনি বাফুফে। ঘরোয়া ফুটবলের কাঠামো এই রোদ, এই বৃষ্টির মতো। যখন ইচ্ছা বিদেশি ফুটবলার বাড়ে। ক্লাব যা চায় তা-ই করে লিগ কমিটি। বোঝাই যায় না কাজী সালাউদ্দিনের মতো একজন বাফুফে সভাপতির চেয়ারে। শীর্ষ ফুটবলাররা এক মৌসুমে ৫০-৬০ লাখ টাকা করে পান, ফুটবলে দৃশ্যমান উন্নতি বলতে এটিই।

আবারও এসেছে বাফুফে নির্বাচন। এই নির্বাচন এলেই শুরু হয় টাকার খেলা। অথচ সালাউদ্দিনের যুগেও গ্যালারি থাকে শূন্য। ফুটবলের বিপণন নেই। লিগ শুরু হয়েছে স্পনসর ছাড়াই। ঢাকার নিচের দিকের লিগগুলো অনিয়মিত। এক পাইওনিয়ার লিগ চার-পাঁচবার বন্ধ  হয়ে শেষ হয় ছয় মাস পর। ৭ বছর পর নারী লিগের উদ্যোগ নিয়ে চলছে তেলেসমাতি কারবার।

নারী ফুটবলে সাফল্য এলেও ভিত্তিটা ভীষণ নড়বড়ে। সালাউদ্দিনের আশপাশে থাকা বাফুফের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ক্লাবই নারী ফুটবল নিয়ে অনাগ্রহী। ফেডারেশনে বিভেদ তো আছেই। সালাউদ্দিনের বিরোধী পক্ষের আনা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তে নেমেছে দুদক। উন্নয়নের বদলে ফুটবলের ভাবমূর্তিতে কালিমাই পড়ছে শুধু।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত