ম্যাশ: খেয়ালী যুবরাজ থেকে রাজ্যের কান্ডারী

প্রকাশ | ০৫ অক্টোবর ২০১৯, ১৩:৪৫

উত্থান পর্ব

কৌশিক, চিত্রা নদীর পাড়ে বেড়ে উঠা এক দুরন্ত কিশোর, যে দাপিয়ে বেড়ায় নড়াইলের আনাচেকানাচে। ফুটবল নিয়ে বন্ধুদের সাথে মাঠ কাঁপানো ছেলেটা চিত্রা নদীর বুকে সাঁতরে বেড়াতে বেড়াতে যেন ধীরে ধীরে হয়ে উঠে বেপরোয়া। তান্ডব চালাতে থাকে ওইটুকুন বয়সেই। কারও কথায় যেন সে আপোষ করতে নারাজ, নিজেকে বাজী রেখে হয়ে উঠে অনন্য।

তাকেই যে একসময় দেশকে প্রতিনিধিত্ব করায় নেতৃত্ব দিতে হবে, সে কথা ছেলেটাও কি ভেবেছিলো কখনো? দুরন্ত সেই কৌশিকই যে হবে এক সময়ের ভালোবাসার দলপতি, ম্যাশ! তা কি কেউ বুঝেছিল? তবে ছেলেটা যে বিপ্লব ঘটাবে তা বোঝা গিয়েছিল কৈশরে তার বল হাতে চালানো তান্ডব দেখেই।

যে দেশের মরা পিচে স্পিন বলটাকেই সেরা মনে করা হয়, সেখানে দানবীয় গতির বোলার তৈরী হওয়াটা বিরলই বৈকি।

বিশেষ করে যখন একটু জোরের উপর বলটাকেই পেস বোলিং-এর আদর্শ ধরা হয়, ১১৫/১২০ কি.মি. গতিবেগে বল করাটাই যখন পেস বোলারদের জন্য হয় মানদন্ড। ঠিক সেই সময়টাতে একটা ছেলে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানদের ঘুম হারাম করে দিচ্ছিল নিয়মিত ১৩০/১৩৫ কি.মি. বেগে বল করে।

ছেলেটার নাম কৌশিক। ভীষণ দুরন্ত আর একরোখা, তবে দায়িত্ববোধ সম্পন্ন। সদ্য টেষ্ট স্ট্যাটাস পাওয়া বাংলাদেশ যখন একজন সত্যিকারের ফাস্ট বোলারের অভাবটা দারুণভাবে অনুভব করছিলো তখনি ক্রিকেট কর্তাব্যক্তিদের নজরে পড়ে যায় কৌশিক।

ছয়ফুটের অধিক উচ্চতার মানুষ আমাদের ভৌগলিক প্রেক্ষাপটে বিরল। কিন্তু ক্রিকেট আঙিনায় গতিতারকাদের উচ্চতা যে ছয়ফুট এর অধিক হতে হবে তা যেন অলিখিত নিয়ম। তাই ছয়ফুটের অধিক উচ্চতার কৌশিক বাংলার ক্রিকেটের জন্য আলোর দিশা হয়ে উঠলো। কোন প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ না খেলেও তাই ২০০১-০২ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্টেই অভিষেক হয়ে যায় কৌশিকের। বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি হয়ে উঠে সে সময়ের পরিক্রমায়।

কৌশিক থেকে মাশরাফি

বাংলাদেশ দলের তখনকার সময়ের কোচ আ্যান্ডি রবার্টস যখন নতুন আনকোড়া একটি ছেলেকে অভিষেক করিয়ে দিলেন তখন তার বিচক্ষণতা নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ থাকললেও তা অবান্তর প্রমাণিত হল দ্রুতই।

কৌশিক নামের দুরন্ত ছেলেটা পাল্টে গেল মাশরাফি বিন মর্তুজা নামে।

সারা বিশ্ব দেখল বাংলাদেশ নামক সদ্য টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া দলটায় ছয়ফুটি একটা ছেলে নিত্য নতুন বাউন্সার আর গতির দ্বারা প্রতিপকক্ষকে কুপোকাত করছে।

ইনজুরী প্রবণতা আর আপোষহীন মাশরাফি

মাশরাফির বোলিং করার স্টাইল্টাই ছিলো বিপদজনক। তাই তার ইনজুরীতে পড়ার সম্ভাবনা ছিলো অবধারিত। তবে মাশরাফি একটা জায়গায় ছিলেন অনন্য, আর তা হলো হাল না ছাড়ার গল্প। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই ইনজুরী বার বার তাকে আঘাত করেছে। প্রতিবারই তিনি ছিলেন সাহসিকতার সেরা উদাহরণ।

শেন বন্ড, শন টেইটের মতো গতি তারকারা যেখানে ইঞ্জুরীর কাছে হেরে ক্রিকেটকে বিদায় জানায়, সেখানে মাশরাফি প্রতিবার ফিরে এসেছেন দারুণভাবে। মাশরাফির ক্যারিয়ারের প্রায় ১৮ বছর চলমান, এই সময়ে বাংলাদেশ দল যতগুলো ম্যাচ খেলেছে, মাশরাফি খেলেছেন তার অর্ধেকেরও কম। কিছুদিন আগেই প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ওডিআই ক্রিকেটে ২৫০ উইকেট পেয়েছেন মাশরাফি, অথচ যদি ইনজুরীপ্রবণ না হতেন তবে সংখ্যাটা ৫০০ ছাড়িয়ে যেতেও পারতো।

খেয়ালী এক যুবরাজ

বোলিং যতক্ষণ করেন প্রতিপক্ষকে কোন সুযোগই দেন না মাশরাফি। সমীহ আদায় করতে পারেন যে কোন ব্যাটসম্যানের কাছ থেকেই। তবে ব্যাট হাতেও যথেষ্ট ভয়ংকর তিনটি টেষ্ট ও একটি ওডিয়াই ফিফটির মালিক মাশরাফি। শেষ দিকে তার ছোট্ট ক্যামিও গুলো দারুণ সাহায্য করেছে বাংলাদেশের লোয়ার অর্ডারে।

ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম জয়, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম জয় সবগুলোতেই মাশরাফির অবদান চির ভাস্বর। এমনকি বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ৫০ ওভারে ৩০০ রানের কোটা পূরণ করে মাশরাফির ১৬ বলে ৪৪ রানের উপর ভর করে।

বোলিং-ফিল্ডিং-ব্যাটিং তিন জায়গাতেই নিজের সেরাটা দিয়েছেন সব সময়। গা বাঁচিয়ে না খেলে গড়েছেন আপন সাম্রাজ্য। তাই বার বার শল্যবিদের ছুরির নিচেও যেতে হয়েছে তাকে। দুই হাটুতে মোট সাতবার অস্ত্রপচার করেও খেলাটা চালিয়ে যাচ্ছেন। মনের জোরে হার মানিয়েছেন প্রতিটা ভয়ংকর ইনজুরীকে।

যেভাবে হলেন আজকের মাশরাফি !

২০০১ থেকে ২০১৫, এই সময়ের মাশরাফির সাথে ২০১৫ পরবর্তী মাশরাফির ব্যাপক পার্থক্য। বয়স এবং সময় মানুষটাকে এতোটাই পরিণত করেছে যে কৌশিক থেকে ক্যাপ্টেন ম্যাশ হয়ে উঠেছেন তিনি। বর্তমান বাংলাদেশ দলে সবচেয়ে সিনিয়র খেলোয়ার, সবাই সম্মানটাও করেন সেই জায়গা থেকে।

নেতা মাশরাফির সবচেয়ে বড় গুণ- তিনি নেতা হওয়ার আগে মাশরাফি ভাই ছিলেন। দলের প্রতিটি সদস্যকে আগলে রেখেছেন নিজের মত করে। যে কারো যে কোন সমস্যায় সবার আগে ছুটে আসে মাশরাফি ভাইয়ের কাছে। খেলোয়াড়রা যেমন সবাই তাকে মান্য করে, তেমনি অনুপ্রেরণা হয়ে, উৎসাহ দিয়ে প্রতিটি খেলোয়াড়ের  সামর্থ্যের পুরোটা আদায় করতে জুড়ি নেই অধিনায়ক মাশরাফির। এখানেই নেতা মাশরাফির সার্থকতা। ২০১৫ বিশ্বকাপের নকআউট পর্ব, চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত ও পাকিস্তানের সাথে সিরিজ জয়, পরপর দুটি এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলা, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ দলের একদিনের ম্যাচে পরাশক্তি হয়ে উঠার পিছনে সাকিব-তামিম-মুশফিক-মাহমুদুল্লাহ-মুস্তাফিজদের অবদান সবচেয়ে বেশী।

তবে তাদেরকে এক সুতোয় গেঁথে, তাদের সেরাটা বের করে আনার ক্ষেত্রে একজন নেতা মাশরাফি সবার আগে, সবার সেরা। তাই একসময়ের খেয়ালী যুবরাজ আজকের বাংলার ক্রিকেট রাজ্যের অবিসংবাদিত নেতা, রাজ্যের কান্ডারী।

৫ অক্টোবর ১৯৮৩-তে নড়াইলে জন্ম নেওয়া মাশরাফি পা রাখলেন ৩৬ বছর বয়সে। ২০১৯ বিশ্বকাপের পর থেকেই ক্রিকেট পাড়ায় গুঞ্জন মাশরাফির অবসর নিয়ে। গত ১৮ টি বছর ধরে দেশের জন্য আত্মনিবেদিত মানুষটি সবসময়ের মত করে আরও অনেকদিন মাতিয়ে রাখুক বাংলাদেশের ড্রেসিংরুম, এই কামনা দেশের প্রতিটি ক্রিকেটপ্রেমীর। সেই মাশরাফি এলাকার মানুষের জন্য কাজ করবেন বলে হাতে নিয়েছেন দায়িত্ব। হয়েছেন সংসদ সদস্য। যেভাবেই থাকুক, তিনি আছেন মানুষের ভালোবাসার সাথেই।

ভালো থাকুক কৌশিক, ভালো থাকুক ক্যাপ্টেন ম্যাশ।