"সাকিব আল হাসান ২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের অবিসংবাদিত সেরা খেলোয়াড়। কেন?"

প্রকাশ : ২০ জুন ২০১৯, ১৫:৪৫

সাহস ডেস্ক

এই বিশ্বকাপের দেড়শো জন খেলোয়াড়ের মধ্যে একজন খেলোয়াড়ই সম্ভবত একইসাথে তার দেশের সেরা ব্যাটসম্যান এবং বোলার। তার নাম সাকিব আল হাসান।কোনো বিতর্ক ছাড়াই এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড়।

সাকিবকে আন্ডাররেটেড বলা হয় সাধারণত। খুব কৌতুহলের বিষয় যে সাকিব কিন্তু যেসব প্লেয়ারের সাথে অথবা বিপক্ষে খেলেন তারা কিন্তু কেউই সাকিবকে আন্ডাররেটেড করেন না।বরাবরই প্রতিপক্ষের কাছ থেকে প্রাপ্য সম্মান পেয়ে আসছেন সাকিব আল হাসান। ক্রিকেটবোদ্ধারাও তার স্তুতিতে মেতে আছেন অনেকদিন থেকেই। ২০১৫ সালে একইসাথে ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটের এক নাম্বার অলরাউন্ডার হয়ে আছেন সাকিব আল হাসান। অনেকদিন ধরেই এই রাজমুকুট তার মাথায়। কিন্তু সাকিব যেহেতু ক্রিকেটের ঐতিহ্যবাহী দলগুলোর একজন প্লেয়ার না সে হিসেবে সাকিবের বহুমুখী অতিমানবিক পারফরম্যান্সকে উপেক্ষা করে গেছেন কেউ কেউ।

২০০০ সালে যখন সাকিব তেরো বছরের ক্রিকেটার ছিলেন তখনকার দুইটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বাংলাদেশ ক্রিকেটের রুপান্তর ঘটাতে সহায়তা করেছে।

প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটা হলো বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাসপ্রাপ্তি যেটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের অবকাঠামোগত উন্নয়নের বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে ২৯ বছরের এই ক্রিকেটীয় যাত্রার সবচেয়ে উন্নতি ঘটেছে এই স্ট্যাটাস পেয়ে। বাংলাদেশে কিন্তু আরো আগে থেকেই ক্রিকেটের মূল স্থাপিত। বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের অংশ হয়ে ছিলো তখনও এখানে টেস্ট ম্যাচের আয়োজন হয়েছে।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাকিব আল হাসানের সিলেকশন।

দক্ষিণ পশ্চিম বাংলাদেশের জেলা মাগুরাতে বেড়ে উঠা সাকিব পরবর্তীতে মনে করেন যে সেখানে ছোটোবেলা থেকেই সংগ্রাম করার একটা মানসিকতা গড়ে উঠেছিলো তার।

জাতীয় ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানে আসার পর থেকে নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি প্রাপ্ত সকল সুযোগ সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে নিজের দক্ষতাকে ক্ষুরধার করার কাজে মনযোগী হয়ে পড়েছিলেন সাকিব আল হাসান।

ছয় বছর পর ১৯ বছর বয়সে সাকিব আল হাসানের যখন অভিষেক হয়, তখন তিনি এমন একটা টিমে এসেছিলেন যাদের দুইবছর আগে একটানা পয়তাল্লিশটা ওয়ানডে ম্যাচ হারার তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে।

দলে আসার পরপরই সাকিব তার সহজাত ব্যাটিং এবং বিচক্ষণ বোলিং দিয়ে দলের অপরিহার্য সদস্য হয়ে উঠেন তার দলের তিক্ত অতীত অভিজ্ঞতা ভুলে মুক্ত স্বাধীন বাঘ হয়ে৷

বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ ছিলো ভুলে যাওয়ার মত। সেবার কেনিয়া কানাডার মত দলের সাথেও বাংলাদেশকে হারতে হয়েছিলো।

কিন্তু সাকিব দলে আসার পর ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ৫৩ রানের ঝলমলে ইনিংস খেলে ভারতের বিপক্ষে এবং দক্ষিণ আফ্রিকার টপ অর্ডারের দুইজনকে আউট করে দিয়ে জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন।

বাংলাদেশের যে সামর্থ্য, বিপরীতে বাজে ধরনের অধারাবাহিকতা এদেশের গোড়া ক্রিকেট ভক্তদেরকে ক্ষুব্ধ করেছে অনেকবার।

বাংলাদেশ ক্রিকেটের পেইস বোলিং এর বিপক্ষে দুর্বলতা, দুর্বল ফিটনেস এবং দুর্নীতির প্রভাব সবকিছু মিলিয়ে এদেশের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অনেক কষ্টসাধ্য ছিলো।

সবকিছু ছাপিয়ে সাকিব আল হাসান ঠিকই বাংলাদেশের ক্রিকেটের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকারুপে প্রতীয়মান হয়ে ছিলেন বিভিন্ন সময়ে। ২০১২ সালের এশিয়াকাপে দলকে ফাইনালে তুলেছিলেন সেবার ম্যান অব দ্যা সিরিজ হয়ে। বাংলাদেশ টিমকে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিতে তুলেছিলেন ১১৪ রানের এক অনবদ্য ইনিংস খেলে দল যখন ৩৩ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে লজ্জাজনক এক পরাজয়ের মুখোমুখি এসে দাড়িয়েছিলো। আবার এক টেস্টের দুই ইনিংসে দশ উইকেট এবং ৮৪ রানের ইনিংস খেলে অস্ট্রেলিয়ার সাথে প্রথম টেস্ট ম্যাচ বিজয়েও সাকিব আল হাসান ছিলেন। তিনি বরাবরের মতই হয়ে আছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সুন্দরতম দিনগুলোর সারথি।

নিজের উপর অদম্য বিশ্বাস থাকার পরেও,যে সাকিব কর্তৃক প্রজ্জ্বলিত আগুন দলকে তাতিয়ে রেখেছে সবসময় তার চলার পথ কিন্তু মসৃণ ছিলো না সবসময়। তাকে ২০১৪ সালে কোচের সাথে দ্বন্দের জের ধরে ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিলো।

বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা সাকিব ফিরে এসেছেন আরো পরিপক্ব হয়ে।তিনি এখন দলের টেস্ট এবং টি টুয়েন্টি ফরম্যাটের ক্যাপ্টেন।

তুলনামূলকভাবে একটা দুর্বল দলের সবচেয়ে সেরা খেলোয়াড় হওয়ায় সাকিবকে অনেকসময়ই বন্ধুর পথে হাটতে হয়েছে। কিন্তু তার মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস, লড়াই করার অদম্য আগ্রহ নিয়ে তিনি সবসময়ই এই কণ্টকপূর্ণ পথ পরম আলিঙ্গনে আকড়ে ধরেছিলেন। সাকিব তার লেফট আর্ম স্পিন দিয়ে মধ্যের ওভারগুলো না করে পাওয়ারপ্লে আর ডেথ ওভারে বোলিং করছেন। গতবছর থেকে নিজ আগ্রহে তিন নাম্বার পজিশনে ব্যাটিংও করছেন। ১৯ ইনিংসে তার ব্যাটিং গড়ও ঈর্ষণীয় ৫৯.৬৮। এ বছর তা অতি মানবীয় পর্যায়ে চলে আসছে। সাত ইনিংস খেলে ১৩১ এভারেজে ১০১.৩৫ স্ট্রাইক রেটে খেলে দলকে জিতিয়েছেন পাঁচটি ম্যাচে, যেখানে আবার ইংল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের মত দলের সাথে টানা সেঞ্চুরিও আছে। আতহার আলী খানের ভাষায় ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ৩২২ রানের ইনিংস চেজ করতে গিয়ে যে অসাধারণ এক সেঞ্চুরি করলেন, সেটা নিয়ে খুব একটা উচ্ছাসও দেখান নি। দলকে জয়ের বন্দরে পৌছানোর জন্য ছিলেন হিমালয়ের মত অবিচল। অসাধারণ এক জয়ের পরেও সাকিবের ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হলো খুব সাধারণ একটা ম্যাচই জিতিয়েছেন তিনি। এ আর এমন কি। সবসময়, সব জায়গায় ভালো খেলে খেলে অভ্যস্ত হয়ে গেলে বড় খেলোয়াড়েরা যেমন এটিচ্যুড প্রদর্শন করেন সাকিব ছিলেন তেমনই।

আর সাকিব তো শুধু বড় খেলোয়াড় না, সাকিব সবচেয়ে বড় খেলোয়াড়দের একজন।


ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রতিবেদন থেকে লেখাটি অনুবাদ করেছেন আবদুল্লাহ আল নোমান অন্তর।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত