‘ভালো স্ট্রাইকার চাই’ জেমি ডের বিজ্ঞাপন

প্রকাশ : ১১ অক্টোবর ২০১৮, ১২:৫৫

সাহস ডেস্ক

‘ভালো স্ট্রাইকার চাই’—এমন একটি বিজ্ঞাপন দিতেই পারেন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের কোচ জেমি ডে। যেভাবে গোলের জন্য তাঁর স্ট্রাইকারদের হাপিত্যেশ করতে হচ্ছে, প্রতিপক্ষের পোস্টের সামনে গিয়ে গোলের ঠিকানা পাওয়ার জন্য মাথা কুটতে হচ্ছে; স্ট্রাইকার চেয়ে ডের বিজ্ঞাপন দেওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। অবশ্য শুধু এই ব্রিটিশ কোচ কেন? সাম্প্রতিক সময়ের সব কোচেরই তো একই অভিজ্ঞতা।

বাংলাদেশ কোচের কল্পিত সেই বিজ্ঞাপনে কোন শর্তগুলো থাকতে পারে? প্রথম টাচটা হতে হবে ভালো, বল নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলে মাথা উঁচু করার অভ্যাস আছে, গোলমুখে জায়গা তৈরি করতে পারে, গোল পোস্টে শট নেওয়ার সাহস আছে। এই গুণগুলো থাকলে উচ্চতা ও শারীরিক সক্ষমতার কথাগুলোও শিথিলযোগ্য। এমন বিজ্ঞাপন না দিয়ে আর বোধ হয় উপায় নেই!

সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের পর ঘরের মাঠে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপেও সেই পুরোনো চিত্রটা বড় করে ফুটে উঠল—একজন গোল করার লোকের অভাব। ফিলিপাইনের পর শক্তিশালী ফিলিস্তিনির বিপক্ষেও গোল নষ্ট করার দায়ে হার নিয়ে মাঠ ছাড়তে হলো বাংলাদেশকে। এই গোল না পাওয়াই এখন বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে বড় সর্বনাশা রোগের নাম।

গতকাল বাংলাদেশ-ফিলিস্তিন ম্যাচের রিপোর্ট কী বলে? বল দখলে দুই দল সমানে সমান। অথচ দুই গোল করা ছাড়াও ফিলিস্তিন বাংলাদেশ গোলরক্ষক রানার পরীক্ষা নিয়েছে কমপক্ষে পাঁচবার। সেখানে বাংলাদেশ নিরীহ একটা হেড ছাড়া গোলপোস্ট পর্যন্ত বলই নিতে পারেনি। বাংলাদেশের নম্বর নাইন নাবিব নেওয়াজ জীবন তো বল রাখতে পারেননি ফাঁকা পোস্টেও। এ ছাড়া আরও গোটা দুই ভালো সুযোগ হারিয়েছেন। দুবার মেরেছেন সাইড নেটে। উইং থেকে ভেসে আসা ক্রসে নিতে পারেননি হেড। ফলে কোচিং স্টাফ থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সবাই মেতেছেন নাবিবের মুণ্ডুপাতে।

নাবিব যদি উল্টো প্রশ্ন করেন, আমাকে মানসম্মত স্ট্রাইকার বানানোর চেষ্টা কেউ কখনো করেছেন? উত্তর, না। গ্রাম বা মফস্বল থেকে উঠে আসা বাংলাদেশের ফরোয়ার্ডরা খেলতে খেলতেই আজ জাতীয় দলের স্ট্রাইকার। স্ট্রাইকার হওয়ার মৌলিক গুণগুলো কী কী, তা তো জেনেছেন জাতীয় দলে বা প্রিমিয়ার লিগে বড় ক্লাবে আসার পর! আর এই পর্যায়ে এসে ঠেকার শিক্ষায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ চালিয়ে নেওয়া যায় না। এর সমাধান? স্ট্রাইকার তৈরি করতে হবে। অন্যথায় এভাবেই চলতে থাকবে গোলের জন্য হাপিত্যেশ। 

বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক কোচ সাইফুল বারি স্ট্রাইকার সমস্যা দূর করার জন্য তিনটি পরামর্শ দিয়েছেন। প্রথমত, একাডেমিতে ভালো কোচের অধীনে স্ট্রাইকার তৈরি করা। দ্বিতীয়ত, ক্রিকেট বোর্ড যেভাবে খেলোয়াড় (পেসার/স্পিনার) হান্ট করছে, সেভাবে স্ট্রাইকার হান্ট করে অনুশীলন করাতে হবে। তৃতীয়ত, উঠতি স্ট্রাইকারদের নিয়ে আলাদা অনুশীলনের ব্যবস্থা করা। কিন্তু এই কাজগুলো কে করবে? বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন, নাকি ক্লাবগুলো!

ফুটবলে একটি কথা আছে, ‘কেউ স্ট্রাইকার হয়ে জন্মায় অথবা তৈরি করে নিতে হয়।’ অথচ আধুনিক ফুটবলের এ যুগেও ফেডারেশনের নিজস্ব একটি ফুটবল একাডেমি নেই। ক্লাবগুলোর অনীহা খেলোয়াড় তৈরিতে। এ ছাড়া খেলোয়াড় উঠে আসার সব রাস্তাই তো বন্ধ। ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে লিগ হচ্ছে না, বয়সভিত্তিক পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদি কোনো ক্যাম্প নেই। তাহলে স্ট্রাইকার তৈরি হবে কোথায়?

কোচিং ইনস্ট্রাক্টর সাইফুল বারি তো এমনি এমনি একাডেমির কথা বলেননি। এই একাডেমিভিত্তিক ফুটবলের ওপর দাঁড়িয়েই তরতর করে বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশগুলো। বাংলাদেশের যেখানে একটি ফুটবল একাডেমিও নেই, সেখানে ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের নিজস্ব বড় (এলিট একাডেমি) আছে ২৭টি, মালদ্বীপের আছে টি, ভুটানের আছে ২টি এবং নেপালের আছে ১টি। ভুটানের মতো দেশও চেনচো গেইলশেনের মতো স্ট্রাইকার তৈরি করেছে। নেপালের আনফা একাডেমিতে তৈরি হয়েছে বিমল ঘাত্রির মতো ভালো মানের ফুটবলার। এই বিমল বেলজিয়ামের আন্ডারলেখট ক্লাবের জুনিয়র দলেও জায়গা করে নিয়েছে। আনফা একাডেমির গড়া মিডফিল্ডার রোহিত চাঁদ খেলছে ইন্দোনেশিয়ান লিগে।

শুধু বাফুফের কর্তাদের ভাবভঙ্গিতে মনে হয়, স্ট্রাইকার আপনাআপনিই জন্মানোর কথা। হ্যাঁ, আপনা-আপনি প্রকৃতিগত প্রতিভা নিয়েই এসেছিলেন সারওয়ার জামান নিপুর মতো স্ট্রাইকাররা। ২০১৫ সালে ভারতকে হারিয়ে অনূর্ধ্ব-১৬ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয় করা স্ট্রাইকার নিপুর দ্রুতগতি ও গোল করার সহজাত ক্ষমতা দেখে বাফুফে কর্তারা নিশ্চিত হয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের স্ট্রাইকার সমস্যা কেটে গেছে।’ নিপুসহ তাঁর দলের চার বছরের দায়িত্ব গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। চার বছর তো দূরের কথা, ওই দলের জন্য এক দিনের ক্যাম্পের ব্যবস্থা করতে পারেনি বাফুফে।

তিন বছর আগের গল্প না হয় বাদই থাকল। গত বছর অনূর্ধ্ব–১৫ সাফে ছয় গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন ফয়সাল হোসেন ফাহিম, চার গোল করেছিলেন মিরাজ মোল্লা। এই তরুণ স্ট্রাইকাররা এখন কোথায় আছে, কোন কোচের অধীনে অনুশীলন করছে, তা কি জানা আছে ফুটবল কর্তাদের? এ ছাড়া যে ছেলেটা বঙ্গবন্ধু স্কুল ফুটবলে বা ক্লিয়ার মেন স্কুল ফুটবল অনূর্ধ্ব–১৭’তে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছে, তার খবরও কি আছে বাফুফে কোচদের হাতে?

স্ট্রাইকার তৈরি করে নেওয়ার ক্ষমতা নেই। উল্টো বিদেশি কোটা বাড়ানোতে জাতীয় দলের স্ট্রাইকাররা নতুন মৌসুমে আবারও পড়তে যাচ্ছেন মহাবিপদে। গত বছর দুটি বিদেশি কোটা থাকায় তৌহিদুল আলম সবুজ, নাবিদের খেলার সুযোগ হয়েছিল। নতুন মৌসুমে বিদেশি কোটা দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে প্রায় প্রতিটি দলেই দেখা যাবে দুজন বিদেশি স্ট্রাইকার। দেখা যাবে সুফিল, সবুজ, জীবনরা খেলার সুযোগই পাচ্ছেন না। আর যারা ক্লাব দলেই নিয়মিত খেলার সুযোগ পাবেন না, তাঁদের কাছ থেকে জাতীয় দলে গোলের আশা করাটা নির্মম রসিকতা।

অবশ্য এমন সব রসিকতাই তো দেশের ফুটবলের বর্তমান চিত্র।

সাহস২৪.কম/খান

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত