বান্দরবানে প্রবারণা উৎসব শুরু

প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০১৮, ১৪:৪৪

আকাশে বর্ণিল ফানুস উড়িয়ে বান্দরবানে শুরু হয়েছে আত্মশুদ্ধি ও অশুভকে বর্জন করে সত্য ও সুন্দরকে বরণ করে নিতে মারমা সম্প্রদায়ের প্রবারণা পূর্ণিমা উৎসব (ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে)। 

মঙ্গলবার (২৩ অক্টোবর) রাত ৯টায় ঐতিহ্যবাহী রাজবাড়ি মাঠে উৎসব উদযাপন পরিষদের আয়োজনে ফানুস উড়িয়ে এ উৎসবের উদ্বোধন করেন বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা। 

পরে শুরু হয় স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন মার্মা শিল্পী গোষ্ঠীর পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এর আগে জেলা শহরের ক্যাংগুলোতে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন, আদিবাসী পল্লীতে বিভিন্ন ধরনের পাহাড়ি পিঠা তৈরি উৎসবে মেতে উঠেন মারমা সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণীরা। গান বাজনা আর বাহারী পোশাকে সজ্জিত হয়ে রাস্তায় নেমে এ উৎসবকে বরণ করে নেন তারা।

এসময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- পুলিশ সুপার জাকির হোসেন মজুমদার, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের পরিচালক মংনুচিং, উৎসব উদযাপন কমিটির সভাপতি তিংতিংম্যা, সাধারণ সম্পাদক মংমংসিং প্রমুখ। 

উৎসব উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মংমংচিং জানান, সকালে ধর্মদেশনা, ফুলপূজা, বিহারে আহার দান করা হবে আর সন্ধ্যায় পূণ্যলাভের আশায় হাজার প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও ফানুশ ওড়ানো হবে। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে প্রধান সড়কের রথ প্রদক্ষিণ শেষে মধ্যরাতে বান্দরবানের সাঙ্গু নদীতে এই অনুষ্ঠানের ইতি টানা হবে।

বৌদ্ধ মতে, এ পুণ্যময় পূর্ণিমা তিথিতে মহামানব তথাগত গৌতম বুদ্ধ তাবতিংস স্বর্গে মাতৃদেবীকে অভিধর্ম দেশনার পর ভারতের সাংকাশ্য নগরে অবতরণ করেন। মানব জাতির সুখ, শান্তি ও কল্যাণে দিকে দিকে স্বধর্ম প্রচারের জন্য তার ভিক্ষু সংঘকে নির্দেশ প্রদান করেন। একই দিনে তার তিন মাসের বর্ষাবাসের পরিসমাপ্তি ঘটে।

পূজনীয় ভিক্ষু সংঘের ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত শেষে আসে এ প্রবারণা তিথি। প্রবারণা হলো আত্মশুদ্ধি ও অশুভকে বর্জন করে সত্য ও সুন্দরকে বরণের অনুষ্ঠান। এ প্রবারণা পূর্ণিমার পরদিন থেকে এক মাস ধরে দেশের প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারে শুরু হবে শুভ কঠিন চীবর দানোৎসব।

বাংলাপিডিয়া বলা হয়েছে, বৌদ্ধদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। এর অপর নাম আশ্বিনী পূর্ণিমা। ‘প্রবারণা’ শব্দের অর্থ প্রকৃষ্টরূপে বরণ করা, নিষেধ করা ইত্যাদি। ‘বরণ করা’ অর্থে বিশুদ্ধ বিনয়াচারে জীবন পরিচালিত করার আদর্শে ব্রতী হওয়া, আর ‘নিষেধ’ অর্থে আদর্শ ও ধর্মাচারের পরিপন্থী কর্মসমূহ পরিহার করাকে বোঝায়।  বর্ষাবাস সমাপনান্তে ভিক্ষুসংঘ আপন আপন দোষত্রুটি অপর ভিক্ষুসংঘের নিকট প্রকাশ করে তার প্রায়শ্চিত্ত বিধানের আহবান জানায়। এমনকি অজ্ঞাতসারে কোনো অপরাধ হয়ে থাকলে তার জন্যও ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়। অর্থাৎ দৈনন্দিন জীবনাচারের প্রতিটি মুহূর্তে সচেতনভাবে ঘটিতব্য সর্ববিধ দোষকে বর্জন করে গুণের প্রতি আকৃষ্ট থাকার চেতনা সৃষ্টি করাই প্রবারণার উদ্দেশ্য। শ্রাবস্তীর জেতবনে অবস্থানকালে  গৌতম বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘের পালনীয় হিসেবে এর প্রবর্তন করেন।

আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে প্রবারণা পালিত হয়। প্রবারণার পর ভিক্ষুসংঘকে অধীত জ্ঞান প্রচারের জন্য গ্রামে-গঞ্জে যেতে হয়। এ সময় তাঁরা কল্যাণের বাণী প্রচার করেন, যাতে দেব-মনুষ্যসহ সব প্রাণীর কল্যাণ সাধিত হয়। এভাবে প্রবারণা শেষ হওয়ার পর প্রতিটি বৌদ্ধবিহারে পালিত হয় কঠিন চীবর দান উৎসব।

প্রবারণা পূর্ণিমার অন্য একটি উৎসবময় দিক হলো ফানুস উত্তোলন। বৌদ্ধশাস্ত্রমতে বুদ্ধদেব আধ্যাত্মিক শক্তিবলে দেবলোকে গিয়ে মাকে ধর্মদেশনা করে এদিন স্বর্গ থেকে মর্ত্যে অবতরণ করেন। এ কারণে বৌদ্ধগণ প্রবারণা পূর্ণিমায় আকাশে প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের প্রতীকরূপে ফানুস উত্তোলন করে।

এ সংক্রান্ত আরেকটি কাহিনী হলো: সিদ্ধার্থ গৌতম কোনো এক সময় মাথার এক গুচ্ছ চুল কেটে বলেছিলেন তিনি যদি সিদ্ধিলাভের উপযুক্ত হন তাহলে এই কর্তিত চুল যেন নিম্নে পতিত না হয়ে ঊর্ধ্বে উঠে যায়। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী চুলগুচ্ছ আকাশে উঠে গিয়েছিল। তাই বুদ্ধের কেশধাতু পূজার স্মৃতিস্বরূপ আকাশে এই ফানুস ওড়ানো হয়। এ করণে আত্মবিশ্লেষণের শিক্ষা, মাতৃকর্তব্য পালন ও বিনয়বিধান অনুশীলনের বহুবিধ মহিমায় এই প্রবারণা পূর্ণিমা মহিমান্বিত। প্রতিবছর আশ্বিনী পূর্ণিমায় বৌদ্ধরা শ্রদ্ধা-ভক্তি সহকারে প্রবারণা পূর্ণিমা পালন করে। এ উপলক্ষে আয়োজন করা হয় বুদ্ধপূজাসহ নানা পুণ্যানুষ্ঠানের। বাঙালি বৌদ্ধদের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে এ পূর্ণিমার আবেদন খুবই গভীর।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত