পানি সংকটে তিনশ’ কোটি মানুষ

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কি পানি নিয়ে!

প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৬:৪৩

ড. মো. কামরুজ্জামান

পানি একটি রাসায়নিক পদার্থ। এটা আল্লাহ তায়ালার এক বিশেষ নিয়ামত। পৃথিবীর সমস্ত জীবের জীবনধারণের জন্য পানি একটি অত্যাবশ্যক পদার্থ।বিশ্বের সব প্রাণী তাই পানির ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে। পানি শুধু মানুষের পান করার জন্য নয়। বরং আরো বহুবিধ কাজের এটি একটি প্রধান উপকরণ। ভূপৃষ্ঠের ৭০.৯% অংশজুড়ে পানির অবস্থান। 

পৃথিবীতে প্রাপ্ত পানির ৯৬.৫% পাওয়া যায় মহাসাগরে। ১.৭% পাওয়া যায় ভ‚গর্ভে। ১.৭% পাওয়া যায় হিমশৈল ও তুষার হিসেবে। একটি ক্ষুদ্র অংশ পাওয়া যায় অন্যান্য বড়জলাশয়ে।আর ০.০০১% পাওয়া যায় বায়ুমন্ডলে অবস্থিত মেঘ, জলীয়বাষ্প, বৃষ্টিপাত, তুষারপাত, ইত্যাদিরূপে। (যুগান্তর ডেস্ক, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, অনলাইন সংস্করণ।) আন্তর্জাতিক পানি গবেষকদের মতে, পৃথিবীর পানির মাত্র ২.৫% হলো বিশুদ্ধ পানি এবং বাকি ৯৮.৮% হলো ভ‚গর্ভস্থ পানি ও বরফ। বিশুদ্ধ পানির ০.৩%-এরও কম অংশ পাওয়া যায় নদীতে, হ্রদে ও বায়ুমন্ডলে। পানি নিজেই প্রকৃতির সবচেয়ে রহস্যময় একটি পদার্থ। এর রয়েছে অস্বাভাবিক তাপধারণ ক্ষমতা। যা না থাকলে পৃথিবীতে কোনো প্রাণই টিকে থাকতে পারত না। এটি একটি মহামূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। বিশ্বব্যাপী নিরাপদ ও পরিচ্ছন্ন পানির উৎসকে ঘিরে শহর, বন্দর, কলকারখানা ইত্যাদি গড়ে উঠেছে। 

বিশুদ্ধ পানির ব্যবসা বর্তমান পৃথিবীতে খুব লাভজনক। বিশ্ব স্টক মার্কেটে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পানির এ ব্যবসা তেল ও সোনাকে ছাড়িয়ে গেছে। যা কিনা বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির চেয়েও অনেক বেশি। (http://moneymorning.com/2013/11/21/investing-in-water-stocks-get-your-share-of-a-20-trillion-market/)
আগামী ২৫ বছরে বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ তাদের সমুদ্রবন্দর, রেল ও সড়ক যোগাযোগের জন্য যে অর্থ খরচ করবে তার থেকে অনেক বেশি অর্থ খরচ করতে হবে নাগরিকদের বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য। পৃথিবীতে বিশুদ্ধ পানির এত ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে যে, আগামীতে আর তৈল-গ্যাস নয় বরং যুদ্ধ হবে পানি নিয়ে। 

আজকাল উন্নত এবং অনুন্নত প্রায় অধিকাংশ দেশের শহরাঞ্চলে রান্নাঘরে বা বাথরুমে কল ছাড়লেই পানি পাওয়া যায়। কিন্তু আফ্রিকার গরিব দেশগুলোর জনসাধারণকে একটু পানির জন্য প্রতিদিন গড়ে আধাঘণ্টা হাঁটতে হয়। কিন্তু এত কষ্ট করে সংগ্রহ করা সে পানি তারা পান করতে পারে না। কারণ সংগৃহীত এ পানি পানের অযোগ্য থাকে। পানের অযোগ্য এ পানি পান করার চিন্তা বাংলাদেশের মানুষ কখনো ঘুণাক্ষরেও করে না। 

বর্তমান বিশ্বের ৮০ কোটি মানুষের কাছে পান যোগ্য সুপেয় পানি নেই।   (MILLIONS LACK SAFE WATER. http://water.org/water-crisis/water-facts/water/)|  সুপেয় পানিঅঞ্চলের মানুষ মলমূত্র ত্যাগ করে ঐ পানি দিয়েই ফ্লাশ করে। আবার ঐ একই পানি দিয়ে টয়লেট পরিষ্কার করে। এই স্বাভাবিক ব্যাপারটি বিশ্বের ৩০০ কোটি মানুষের কাছে স্বপ্নবিলাসের মতো। শৌচাগার তো দূরের কথা, মলত্যাগের পর শৌচ কাজের জন্য পানিই যেখানে অপ্রতুল, সেখানে পিওর পানি দিয়ে ফ্লাশের কথা চিন্তাও তারা করে না। 

পৃথিবীতে ২০০ কোটি এমন বনি আদম আছে যারা মল-মূত্র মিশ্রিত পানি পান করে। আর প্রতি বছর ৮ লাখ মানুষ দূষিত পানি পান করে মারা যায়। প্রতিদিন ৩ হাজার শিশু বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে ভোগে। এমতাবস্থায় একজন জ্ঞানী মানুষকে এক গ্লাস পিওর পানি পান করতে মহাচিন্তায় ফেলে দেয়। 

প্রাকৃতিকভাবেই বাংলাদেশে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভূ-পৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানিসম্পদ। বাংলাদেশের মানুষ তাদের দৈনন্দিন পানির চাহিদা পূরণ করে কয়েকটি উৎস থেকে। শহর অঞ্চলের মানুষ সাধারণত ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করে। সিলেট, মৌলভী বাজার, চট্টগ্রাম, খুলনা, বাগেরহাটসহ বেশ কিছু অঞ্চলের মানুষকে দেখা যায় তারা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে তা পান করে। আবার নিজস্ব অভিজ্ঞতায় কিছু মানুষকে দেখা যায় তারা পুকুরের পানিই সব কাজে ব্যবহার করে। 

সিলেট ও পার্বত্য এলাকার অনেক মানুষ পাহাড়ি ঝরনার পানিও ব্যবহার করে। এছাড়া নদী এলাকার মানুষ নদীর পানি দিয়েই তাদের সব কার্য সম্পাদন করে। বাংলাদেশের জন্য এই সুপেয় পানি অন্য অনেক দেশের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড যে কৃষি; তার মূল উৎস পানি। পানি ছাড়া কোন ফসল হয় না বললে চলে। এই মিঠাপানি দিয়েই কৃষকরা চাষাবাদ করছেন। অপরিকল্পিত ব্যবহার এবং অপব্যবহার পানির গুণগতমান দ্রুত কমিয়ে দিচ্ছে। এতে ভূ-গর্ভস্থও ভূপরিভাগের পানি দূষিত হয়ে পড়ছে। কৃষিকাজ এবং অন্যান্য কাজে ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর নির্ভর করার ফলে এর স্তর গড়ে ৭.৫ মিটারের নিচে নেমে গেছে। 

অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ঢাকা শহরের দুই কোটি মানুষের পানির প্রয়োজন মিটাতে গিয়ে রাজধানীর অনেক অঞ্চলে পানির স্তর ৭০ মিটার নিচে নেমে গেছে। আন্তর্জাতিক পানি বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, আগামী ৪০ বছরে বাংলাদেশের ভূ-গর্ভস্থ পানির সঞ্চয় প্রায় ৩৮ শতাংশ হ্রাস পাবে। একদিকে বৃষ্টিপাত কমে যাবে অপরদিকে বর্ষার সময়ও কমে আসবে। ফলে ভ‚মিকম্প, ভ‚মিধস ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বাংলাদেশ। ভয়াবহ এ বিপর্যয় আর তীব্র পানি চাহিদা থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই এখন থেকে উন্নত পানি ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দেয়া উচিত। বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক বিশ্বে সুপেয় পানির জন্য নানা প্রকারের ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ করা হচ্ছে। 

এসব ব্যবস্থাপনা কখনো কাজে লাগছে, আবার কখনো বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনছে। বাংলাদেশের পানি ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট দুর্বলতা বা ঘাটতি দেখা যায়। তাই এদেশের মানুষের জন্য একটি উন্নত ও বাস্তবমুখী পানি ব্যবস্থাপনা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। পানি ব্যবস্থাপনায় ইসলামের সুস্পষ্ট ও যৌক্তিক কিছু বিধান আছে। তাই এ ব্যবস্থাপনা প্রণয়নে ইসলামি বিধি-বিধানের সহায়তা নেয়া যেতে পারে। ইসলাম পানি ব্যবস্থাপনার নানাবিধ পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছে। এসব নীতি ও পদ্ধতি বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে উন্নত ও সুপরিকল্পিত বলে প্রমাণিত। 

ইসলামি বিধান মতে, পানি আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত এক বিশেষ নিয়ামত। তাই পানির ওপর সব প্রাণীর সীমাহীন অধিকার রয়েছে। এ সম্পর্কে নবী (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন অপরকে উদ্বৃত্ত পানি ব্যবহারে বাধা না দেয়, যাতে চতুষ্পদ জন্তুর ঘাস খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।’ (ইবনু মাজা, অধ্যায় : ১৩/ বিচার ও বিধান, হাদিস নাম্বার:২৪৭৮।) ‘যে ব্যক্তি তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি মানুষকে দেয় না, কিয়ামতের দিন তাকে আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত রাখা হবে। কারণ এ পানি মানুষের হাতের তৈরি নয়।’ (বুখারী)। 

আন্তর্জাতিক পানি বণ্টন নীতিতে ধর্মীয় এ বিধান উল্লেখ করা যেতে পারে। কুটনীতিতে এ বিধান লিপিবদ্ধ করে তা প্রয়োগ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের নদী ও খালগুলো কলকারখানার বর্জ্য নিক্ষেপের ফলে পানির স্বাভাবিক গতিধারা ব্যাহত হচ্ছে। 

ইসলাম এটাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। হাদিসে এসেছে, ‘তোমাদের কেউ যেন বদ্ধ পানিতে পেশাব না করে। কারণ মানুষ ঐ পানি দিয়েই গোসল করে।’ (বুখারী, মুসলিম, তিরমিজি, ইবনু মাজাহ, নাসাঈ)। পানির অপচয় একটি নিন্দনীয় কাজ। অথচ বাংলাদেশে প্রতিদিন পানি অপচয় হয় ৫৭ কোটি লিটার (দৈনিক প্রথম আলো, ২৯ মার্চ, ২০১৪)। ইসলাম পানি ব্যবহারে অত্যন্ত যতœবান হওয়ার উপদেশ ও উৎসাহ প্রদান করে। কোনোভাবেই পানির অপচয় ইসলাম সমর্থন করে না। যদি নদী অথবা সাগরপাড়ে মানুষ অজু-গোসল করে সেক্ষেত্রেও প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করা ইসলামে নিষিদ্ধ। হাদিসে এসেছে, ‘একদা রাসুল (সা.) সা’দ (রা.)-এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় সা’দ (রা.) অজু করছিলেন। তার অজুতে পানি বেশি খরচ হচ্ছিল। রাসুল (সা.) তা দেখে বললেন, কেন এই অপচয়? সা’দ (রা.) আরজ করলেন, অজুতেও কি অপচয় হয়? রাসুল (সা.) বললেন, হ্যাঁ, এমনকি বহমান নদীতে অজু করলেও।’ (ইবনু মাজাহ, অধ্যায়: ১/ পবিত্রতা ও তার সুন্নাতসমূহ, হাদিস নাম্বার:৪২৫।) মানবজীবনে পানি ব্যবহারের এ বিধান সকল ধর্ম, সকল বর্ণ ও সকল দেশের জন্য সমভাবে কল্যাণজনক হবে; যদি সেটা পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাস্তব প্রয়োগ ঘটানো যায়। 

বর্তমান বর্জ্য পানি ব্যবহার বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। সৌদি আরবের সর্বোচ্চ শরিয়া বোর্ড কর্তৃক ১৯৮০ সালে বর্জ্য পানি ব্যবহারের ফতোয়া জারির পর নবায়নকৃত পানি মক্কা ও মদিনার মুসল্লিদের টয়লেট ফ্লাশিং ও অজুর কাজে ব্যবহার করা হয়। কুয়েত সরকার সেদেশের ১৭শত হেক্টর জমিতে রসুন, পেঁয়াজ, মরিচসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে ব্যবহার করে সুফল পায়। এছাড়া ১৯৯৮ সালে জর্ডান সরকার ৭০ মিলিয়ন কিউবিক বর্জ্য পানি দেশের বিভিন্ন উৎপাদনমুখী কাজে ব্যবহার করে। যা দেশের মোট পানি ব্যবহারের ১২%। 

পরবর্তীতে ফিলিস্তিনের বর্জ্য পানি দিয়ে চাষাবাদ করা জমি থেকে উৎপাদিত বেগুন, মরিচ, আপেল, আঙ্গুর ও সবজি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনায় ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে তা নিরাপদ বলে ঘোষণা করা হয়। (Dr. Muhammad Ashraf, Importance of Water in the Light of Quran and Sunnah and Ways of its Saving, Pakistan Council of Research in Water Resources, Islamabad, 2015.) সুতরাং বাংলাদেশের পানি সংকট দূরীকরণ ও উন্নত পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এখন থেকেই বর্জ্য পানি ব্যবহারের প্রতি গুরুত্ব¡ দেয়া উচিত। কারণ এটি স্বাস্থ্যসম্মত ও পরীক্ষিত বলে প্রমাণিত হয়েছে।

লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ও নির্বাহী সদস্য (জাশিপ)
Email: [email protected]

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ