নিজের ব্যর্থতা ঢাকতেই গিলগিট-বালতিস্তানকে প্রদেশ ঘোষণা ইমরান খানের!

প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২০, ১৮:০৪

হাসান ইবনে হামিদ

পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের গিলগিট-বালতিস্তানকে বিশেষ প্রদেশের মর্যাদা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইমরান সরকার। দীর্ঘদিন যাবত কাশ্মীরের উত্তর সীমান্তঘেঁষা গিলগিট-বালতিস্তানকে জোর করে শাসন করে আসছে ইসলামাবাদ। গত ১ নভেম্বর রোববার দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান গিলগিট-বালতিস্তানে গিয়ে তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও নদী বাঁধ নির্মাণসহ একাধিক প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার সময় এই ঘোষণা দেন। উল্লেখ্য, পাকিস্তানের পঞ্চম প্রদেশ হিসেবে এটি যুক্ত হবে। কিন্তু ১৯৪৭ সালে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী গিলগিট-বালতিস্তান ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের অংশ এবং এই চুক্তিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে,জোর করে দখল করা এ এলাকার কোনো পরিবর্তন করার অধিকার কারোনেই। তাহলে কেনো এই ঘোষণা সে প্রশ্ন অনেকের! মূলত এই ঘোষণা এমন এক সময় আসলো যখন পাকিস্তান ইমরান বিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল। চারদিকে সমালোচনা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছে, এই ঘোষণা নিজের প্রধানমন্ত্রী পদ টিকিয়ে রাখতে দিয়েছেন ইমরান খান। এই বিক্ষোভের মোড় অন্যদিকে ঘুরাতেই ইমরান খান কখনো কাশ্মির ইস্যুতে উচ্চস্বরে কথা বলছেন আবার এখন এই নতুন প্রদেশের ঘোষণা দিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমালোচকদের এই দাবী ঠিক কতোটুকু যৌক্তিক তা নিশ্চয়ই আলোচনার দাবী রাখে। সত্যিই কি নিজের ব্যর্থতা ও ইমরান পতন আন্দোলন ধামাচাপা দিতে এ পথ বেছে নিয়েছেন এক সময়ের বাইশ গজের এই তারকা?

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরানখানেরপদত্যাগেরদাবীতেগত বছরের নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে ‘পিডিএম মুভমেন্ট’।মূলতমেয়াদ শুরুর দুই বছর যেতে না যেতেই ২০১৯ সাল থেকে বিরোধী জোটের প্রবলবিক্ষোভের মুখে পরে ইমরান খান ও তার সরকার। এবার ইমরান খানকে সরাতে ‘পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট (পিডিএম)’ নামে জোট বেধেছে পাকিস্তানের ১১টি রাজনৈতিক দল। এই জোটে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের দল পিএমএল (এন) ও বিলওয়াল ভুট্টোর দল পিপিপি সহ ছোট-বড়-আঞ্চলিক মিলিয়ে আরও ৯টি দল রয়েছে। গত ২১ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিক এক ঘোষণার মাধ্যমে এই জোটের যাত্রা শুরু হয়। সেই জোটের উদ্যোগে একের পর এক সমাবেশ হচ্ছে লাহোর করাচিসহ পাকিস্তানের বড় শহরগুলোতে। ইমরান বিরোধী বিক্ষোভে গত ১৬ অক্টোবর শুক্রবার কয়েক লাখ লোকের সমাগম ঘটে লাহোরে, সেই গণজমায়েত কাঁপিয়ে তোলে ইমরান সরকারের মসনদ। একইভাবে ১৮ অক্টোবর ইমরান সরকারের পদত্যাগ ও পতনের ডাক দেয়া হয় করাচি শহরের সমাবেশ থেকে। কিন্তু মাত্র আড়াই বছরের সরকার কি এমন কাজ করেছে যে গোটা দেশ এক লহমায় ইমরান ও তার সরকারের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছে। লাখো মানুষ দিনরাত রাজপথে অবস্থান নিয়ে ইমরান সরকারের পদত্যাগ চাইছে? এই আন্দোলনকে কি তাহলে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে চাইছে ইমরান খান? কিন্তু প্রশ্ন এসেই যায় মাত্র দুই বছরের শাসনকালে এমন কি ব্যর্থতা ইমরান খানের যে গোটা দেশ তার পদত্যাগের দাবীতে একাট্টা!

করোনা পরিস্থিতিতে গোটা বিশ্ব অর্থনীতি একটি বড় ধাক্কা খেয়েছে, বিপর্যয় নেমে এসেছে সার্বিক দিকেই। স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানেও এর প্রভাব পড়েছে বিস্তর। কেননা পাকিস্তানের অর্থনীতি এমনিতেই ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। তলাবিহীন ঝুড়ি হয়ে অনুদানের অর্থে কোনমতে দিন কাটাচ্ছে। এর মাঝে করোনা পুরো পরিস্থিতিকেই ঘোলাটে করে দেয়। আর তাই করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই অর্থাৎ মার্চ মাসে ইমরান খান ঘোষণা দেন যে, তার দেশে লকডাউন কার্যকর করবেন না। কারণ ভোটের আগে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন তার কিছুই পূরণ করতে পারেন নি ইমরান খান। তাই লকডাউনের ঝুঁকি নিতেই চাননি। কিন্তু অবশেষে দুই দফা লকডাউন দিতে হয় ইমরান সরকারকে অনেকটা বাধ্য হয়েই। ফলে অর্থনীতি বড় ধরণের হুমকির মুখে পরে। বেকারত্ব যায় আরো বেড়ে, কর্মহীন মানুষ জড়িয়ে যায় নানা অপরাধে। খাদ্যের জন্য মানুষের হাহাকার আর বাসস্থানহীন মানুষের আর্তনাদের মতো পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার বদলে ইমরান খান প্রশাসন তা ধামাচাপা দিয়ে কাশ্মীর ইস্যুতে মাতামাতি করছিল। অন্যদিকে আবার আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার যুদ্ধে নিজেদের সেনা পাঠিয়েছে পাকিস্তান। যাতে বেজায় বিরক্ত সেদেশের মানুষ। তাদের বক্তব্য পরিস্কার, ঘরে যেখানে খাবার নেই সেখানে নিজ গৃহে খাবার না দিয়ে কাশ্মীর ইস্যুতে এতো বড় গলায় কিভাবে কথা বলে সরকার? গিলগিট-বালতিস্তানকে নতুন প্রদেশের ঘোষণাই বা কিভাবে দেন ইমরান খান? কোন সাহসে নিজের অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার যুদ্ধে নিজেদের সেনা পাঠিয়ে অর্থ খরচ করেন?

দুর্বল ও ভারসাম্যহীন প্রবৃদ্ধির কারণে পাকিস্তানের অর্থনীতি গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। অর্থনৈতিক সন্ধিক্ষণের মধ্য দিয়ে যাওয়া দেশটিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও সাহসী সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। কিন্তু এক্ষেত্রে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে ইমরান খানের সরকার। এখন পর্যন্ত কার্যকর এমন কোন পদক্ষেপ তারা নিতে পারেন নি যাতে দেশের বেকারত্ব কমানো যায়, মানুষের মুখে খাদ্যের যোগান দেয়া যায়।বৃহৎ রাজস্ব ও অর্থনৈতিক ঘাটতি এবং দুর্বল ও ভারসাম্যহীন প্রবৃদ্ধিতে ভোগা দেশটিতে পরিবর্তন আনবেন ইমরান সেই আশায় ছিলো পাকিস্তানের জনগণ। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন এখন পুরোপুরি শেষ করে দিয়েছেন ইমরান খান। এই আশাহত জনতাই এখন রাস্তায় নেমে ইমরান সরকারের প্রতিবাদে যুক্ত হয়েছে। এদিকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মার্কেট রিসার্চ কোম্পানির একটি সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, পাকিস্তানের ৮০ শতাংশ মানুষ বর্তমান সরকারের কাজে সন্তুষ্ট নয়। তারা পাকিস্তানের বিভিন্ন গ্রাম ও মফস্বল এলাকায় গত সেপ্টেম্বর মাসে ওই সমীক্ষা চালিয়েছে। ১৮ বছরের উর্দ্ধে থাকা ৫০০ জন পুরুষ ও ৫০০ জন মহিলার সঙ্গে কথা বলে তারা।সমীক্ষায় অংশ নেওয়া পাকিস্তানি জনগণের মত, ২০১৯ সালের পর থেকেই ভুল পথে হাঁটছে দেশ। ক্রমশ বেহাল হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যার জন্য দায়ী বর্তমান ইমরানের নেতৃত্বাধীন সরকার। তাছাড়া প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে দুই জন পাকিস্তানি মনে করেন, বেকারত্বের পরিমাণ যেভাবে বাড়ছে তা সরকারের ভুল নীতির জেরে।দেশের মুদ্রাস্ফীতি, দারিদ্রতার জন্যেও ইমরান খানের সরকারকে দায়ী করছে ৪০ শতাংশ জনগণ। সমীক্ষায় আরও উঠে এসেছে, পাকিস্তান অধিকৃত পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখোয়া এলাকায় দুর্নীতিই সবচেয়ে বড় সমস্যা। আর সিন্ধুপ্রদেশের মানুষের অসন্তোষ লোডশেডিংয়ের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে।তার মানে ইমরান সরকারের বিরুদ্ধে জনতা এখন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে গিয়েছে নতুন এই জোটের মাধ্যমে। তারা চায় ইমরান সরকারের পতন ও নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের পছন্দের সরকার গঠন করতে। আর এই আন্দোলনকে ধামাচাপা দিয়ে তর্জন গর্জনের মাধ্যমে ইমরান খান নিজেকে টিকিয়ে রাখতে চাইছে। এরই অংশ হিসেবে কাশ্মীর ইস্যু, গিলগিট-বালতিস্তান ইস্যু সামনে এসেছে।

গিলগিট-বালতিস্তানকে নতুন প্রদেশ ঘোষণার পর নতুন আরেকটি প্রশ্ন সামনে এসেছে। কেননা এই ঘোষণা এমন এক সময় আসলো যার কিছুদিন পূর্বেই আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা‘লএন্ডসোসাইটিএলায়েন্স’ভারত-পাকিস্তানের বাজেট পর্যালোচনার মাধ্যমে স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছে,পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিট-বালতিস্তানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক খাতে পাকিস্তান যে পরিমাণ বরাদ্দ দিচ্ছে তার চেয়ে জম্মু কাশ্মীরে ভারতের বরাদ্দের পরিমাণ অনেক বেশি।ভারত পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের দুই অংশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কেমন সেটি বিশ্লেষণ করেতে গিয়ে তারা যে তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করেছে সেখানে এক ভয়াবহ বৈষম্যের চিত্র ফুটে ওঠেছে।পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আজাদ কাশ্মীর, গিলগিট-বালতিস্তানের বাসিন্দাদের জন্য ইসলালামাবাদ যে পরিমাণ বাজেট শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে দিয়েছে তার থেকে কয়েক গুণ বেশি নাগরিক সুবিধা দিচ্ছে দিল্লি। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এই বৈষম্যের চিত্র ফলাও করে প্রচারের পর পরেই ইমরান খান দ্রুত গিলগিট-বালতিস্তান পরিদর্শনে গিয়ে নতুন প্রদেশের ঘোষণা দিয়ে দিলেন, যা স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে রাজনৈতিক এবং নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে করা হয়েছে। এখন দেখার বিষয় এসব রাজনৈতিক ট্রামকার্ড খেলে কি ইমরান খান নিজের গদি বাঁচাতে পারবেন নাকি পতন অবশ্যম্ভাবী! এতোসব সমস্যার মাঝে নতুন বিরোধী জোটের যে আন্দোলন তা থেকে কি রেহায় পাবেন ইমরান খান! এখন দেখার বিষয়, শুধু সেনাবাহিনীর উপর ভর করে আর কতোদিন প্রধানমন্ত্রী পদ টিকিয়ে রাখতে পারেন ইমরান খান! 

হাসান ইবনে হামিদ- রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ