সংসদে বঙ্গবন্ধুর সম্পাদিত ভাষণ প্রচারের দায় প্রধানমন্ত্রী এড়াতে পারলেও স্পিকার পারেন না
প্রকাশ | ২২ নভেম্বর ২০২০, ১২:২২ | আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২০, ১৭:৪৯
জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। সংসদে তিনিই সর্বেসর্বা, বিধি অনুযায়ী সেখানে প্রধানমন্ত্রীকেও তার নির্দেশনা মেনে চলতে হয়। সেখানে কোন ভুল ত্রুটির দায় প্রথমত তার ঘাড়েই বর্তায়। ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর সংসদে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দিয়েছিলেন। গত ১৫ নভেম্বর তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সংসদে আনা সাধারণ প্রস্তাব গ্রহণের আগে সেই ভাষণটিই অধিবেশনে শোনানো হয়। বিডিনিউজ লিখেছে স্পিকার নিজে স্বীকারও করেছেন সেই ভাষণের কিছু অংশ বাদ পড়েছে।
আমাদের দেশে কোন একটা অঘটন ঘটলে কেউ দোষ কাঁধে নিয়ে পদত্যাগও করে না বা ক্ষমাও চায় না। আর সংশোধনও করে না। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর ভাষ্যানুযায়ী, "সংসদ ওই ভাষণ সম্পাদনা করেনি, বেতার থেকে পাওয়া ভাষণটি হুবহু প্রচার করা হয়েছে।" শুধু এই কথা বলে জাতীয় সংসদের স্পিকার তার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না।
বিগত দিনগুলোতে আমরা অনেকবার শুনেছি আওয়ামী লীগের মধ্যে এবং প্রশাসনের মধ্যে জামাত-শিবিরের চর ঢুকে গেছে। আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম জীবদ্দশায় সে কথা বারবার বলেছেন। এর আগে রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রনালয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়কে দোষারোপ করেছে। তারা বলেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে যেভাবে তালিকা পেয়েছে সেভাবে প্রকাশ করেছে মাত্র। কিন্তু কেউ দোষ স্বীকার করেনি। আর এসবের কোন তদন্ত বাংলাদেশে হয়নি। আর হলেও তার ফলাফল কখনও জনগণ জানতে পারেনি।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর উচিৎ ছিল সেটা খতিয়ে দেখা। তার কর্মে অবহেলার জন্য তাকে কোন কৈফিয়ত দিতে হয়নি। যদি জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকতো তাহলে জাতীয় সংসদ মৌলবাদীদের তুষ্ট করতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে জুয়া খেলতো না। রাজাকারের তালিকা নিয়ে যা ঘটেছিল, তা থেকে জাতীয় সংসদের স্পিকারের সতর্ক হওয়া উচিৎ ছিল। কেন তিনি যাচাই-বাছাই না করে ভাষণটা বাজানোর অনুমতি দিলেন? এই প্রশ্ন বাংলাদেশের জনগণ তার কাছে রাখতে পারে।
আমি আর মাননীয়া স্পিকার একই শিক্ষাবর্ষের ছাত্র-ছাত্রী ছিলাম। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন আর আমি পিছনের সারির একজন। কিন্তু যে ব্যাপারগুলো আমি বা আমরা মত পিছনের সারির মানুষগুলোও সহজে ধরতে পারি বা পারছি, তা উনি পারেন না এটা উন্মাদেও বিশ্বাস করবে না। স্পিকারের তো সংসদের পূর্বের রেকর্ড থেকে জানা উচিৎ ছিল ভাষণটা কত মিনিটের। আর যেটা তারা বেতার থেকে পেলেন সেটা কত মিনিটের। এই ডিজিটাল যুগে এটা পরখ করতে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের প্রয়োজন। জনগণ জনাবা স্পিকারকে ভোট দিয়ে ওই আসনে বসিয়েছে এ সকল কর্মগুলো নির্ভুলভাবে সম্পাদিত হবে বলে। তা না হলে আমার মত পিছনের কাতারের লোকগুলো ওখানে বসে যেত।
জাতীয় সংসদের স্পিকারের যে কর্মীবাহিনী তাতে তো সব কাজ তাকে নিজেও করতে হয় না। আর বঙ্গবন্ধুর জন্য যদি তার কর্মীবাহিনী এটা যাচাই-বাছাই করতে এক ঘণ্টা সময় দিতে না পারে, তাহলে আমাদের করের টাকায় এই কর্মীবাহিনী পোষার আদৌ কী কোন যৌক্তিকতা আছে?
সোশাল মিডিয়ার অত্যন্ত সক্রিয় দুজন কর্মী মাহবুবুর রহমান জালাল ও অমি রহমান পিয়াল এ দুজনকে আমি সামনাসামনি কখনও দেখিনি। তবে তাদের সাথে আমার ফোনে কথা হয়েছে। এ দুইজনকে তাদের কাজের জন্য আমি শ্রদ্ধা করি। তারা অত্যন্ত আবেগের জায়গা থেকে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আমি তার বিরোধিতা করছি না। তবে এক্ষেত্রে আমি মনে করি এ কুকর্মের দায় জাতীয় সংসদের। এখানে স্পিকার তার দায়িত্ব কোনভাবেই এড়িয়ে যেতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি তার দৃষ্টি আকর্ষণও জরুরী। কারণ ভাষণটা প্রচারের আনুষ্ঠানিকতা জাতীয় সংসদ করেছে, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় না। আর স্পিকার এ কথা বলে পার পেতে পারেন না যে, বেতার থেকে তিনি যেমন পেয়েছেন তেমন বাজানো হয়েছে। আমাদের স্পিকার বাজারে যখন কোন পণ্য কিনতে যান সেটা পরখ করে নেন নিশ্চয়ই, আসল না নকল। সুতি শাড়ীকে কোন দোকানদার সিল্ক বলে চালিয়ে দিতে চাইলে বোধকরি তিনি মেনে নেন না, বা সিল্কের মূল্যও দেন না। তাহলে কেন তিনি এক্ষেত্রে পরখ করে দেখলেন না? বঙ্গবন্ধু কী এতই অবহেলার পাত্র?
গত কয়েক বছর ধরে আমি বিরামহীন লিখে গেছি ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে বৈসাদৃশ্যগুলো। এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় সরকারের কোন কর্তাব্যক্তির নজরে সে লেখাগুলো পড়েনি। পড়ে থাকলেও তা সংশোধন করা হয়নি। ৭ই মার্চের ভাষণ সংবিধানে সংযোজন নিয়ে যে বৈসাদৃশ্যগুলো দেখা গিয়েছে তা নিয়ে আমি জনাবা স্পিকারকে একটা ই-মেইল করেছিলাম [email protected] এই ঠিকানায়। ২০১৮ সালের জুলাইয়ের ১৩ তারিখে জার্মান সময় বিকাল ৪টা ৪১ মিনিটে। সকল প্রমাণ সেখানে সংযোজন করেছিলাম। সেই মেলের প্রাপ্তি স্বীকার বা উত্তর আজও আমি পাইনি। তবে ঠিকানা ঠিক ছিল ডিজিটাল মিডিয়া ইয়াহু মেল সরবরাহ করতে পেরেছিল। আমার অভিযোগের পর ব্যবস্থা নিলে সরকারকে আইনজীবী সুবীর নন্দী দাসের করা রিটের মোকাবেলা করতে হত না। সরকার আন্তরিক হলে আদালতের বাইরে এগুলো নিষ্পত্তি করা যেত। একটা ভুল ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত যাই হোক না কেন, সেটা শুধরে নেবার মানসিকতা হারিয়ে ফেললে সঙ্কট তৈরি হয়। মনে রাখতে হবে বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে কোন আপোষ করার মানসিকতা এখনও বাঙালির জন্মেনি।
অমি রহমান পিয়ালের পোষ্টে সুমন দেব নাথ মন্তব্য করেছেন, “তিনি সংসদের ঐ অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন না? থাকলে তখন কেন তিনি নিজেই নিজের বাবার ভাষণের অংশবিশেষ প্রচারের জন্য প্রতিবাদ করেননি? এটার জন্য এক্টিভিস্টদের কেনইবা প্রতিবাদ করতে হবে শেখ হাসিনা বেঁচে থাকতে?”
সুমন দেব নাথ ইংল্যান্ড প্রবাসী বাঙালি আমি জানিনা তিনি এখন কোন দেশের নাগরিক। তবে তিনি বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে থাকলে, ‘সেটা আমাদের জন্য জাতীয় লজ্জা।’ তিনি যা বুঝিয়েছেন তাতে বঙ্গবন্ধুর সন্তানকেই তার জন্য প্রতিবাদ করতে হবে, আর কেউ করতে পারবে না। আমার কাছে এই মন্তব্যটা খুবই হাস্যকর লেগেছিল। মানুষ এতটা স্বার্থপর কেমনে হতে পারে আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম। বঙ্গবন্ধু তার সমস্ত জীবন বাঙালির কল্যাণে উৎসর্গ করেছেন। আর আজ তাঁকে যখন বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, তখন যে দুজন অ্যাক্টিভিস্ট এ নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, তাদেরকে স্বাগত জানানো উচিত। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কিন্তু তা না করে তিনি কটাক্ষ করেছেন।
ওই মন্তব্যের উত্তরে আমি লিখেছিলাম, “বঙ্গবন্ধুর পরিচয় শেখ হাসিনার বাবা না। তিনি আমাদের জাতির জনক অতএব যে কেউ প্রতিবাদ করতে পারে। আর পারা উচিৎ। বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নে আমরা শেখ হাসিনার পদক্ষেপের জন্য বসে থাকতে পারি না। অতএব এক্টিভিস্টরা তার অপেক্ষায় বসে না থেকে সুনাগরিকের পরিচয় দিয়েছেন।”
সুমন দেব নাথদের একটা কথা মনে রাখতে হবে। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সারাটা জীবন মুখস্থ করে রাখেননি। আর সেটা সম্ভবও না। অতএব তিনি উপস্থিত থাকলেই তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করতে পারতেন সেটা মনে করার কোন কারণ নেই। আর প্রশ্নটা প্রতিবাদ করার না, ভুলটা কেন হবে? কেন হল, উদ্দেশ্য কী তাদের, তা জানা এখন জরুরী। আর সেটা যে ভুলে ঘটেনি তা পিয়াল ভাই প্রমাণ করে দিয়েছেন।
আমি ৭ই মার্চ সম্পর্কে তের বছর ধরে একটি মৌলিক গবেষণা করার চেষ্টা করেছি এবং ৩৭৯ পৃষ্ঠার একটি বইও লিখেছি। এর অর্থও এই না যে, আমি ৭ই মার্চ সম্পর্কে সব জানি। হয়তো অনেকের চেয়ে বেশী জানি। তাই ৭ই মার্চের ভুল ত্রুটি গুলো দ্রুত আমার চোখে পড়ে। আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সন্তান। তাই যারা যে বিষয়ে জানি সেখানে কোন বৈসাদৃশ্য চোখে পড়লে প্রতিবাদ করি। তেমন পিয়াল ভাই ও জালাল ভাই করেছেন। আর এখানেই বঙ্গবন্ধুর জীবনের সার্থকতা। নিজের সন্তান বা আত্মীয়ের জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয় না, জনগণ তার জন্য করে। কারণ তিনি জাতির পিতা, শুধু বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতা না।
আমার কাছে মনে হচ্ছে একের পর এক এ জাতীয় দুর্ঘটনার মধ্যে কোথাও যেন একটা যোগসূত্র আছে। চক্রান্তকারীরা ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। পরখ করে দেখছে তারা প্রতিবাদের সম্মুখীন হয় কিনা অথবা সেই প্রতিবাদ কতটা প্রবল। যেমন (১) ৭ই মার্চের ভাষণ ভুলভাবে সংবিধানে মুদ্রণ। (২) রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম। (৩) বঙ্গবন্ধুর চার মূলনীতির গুরুত্বপূর্ণ দুই মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের ব্যাখ্যাকে ছেঁটে ফেলা। (৪) মৌলবাদী সংগঠনের রাজধানীর ধোলাইরপাড়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করার মত ধৃষ্টতা। (৫) সংসদে প্রচারিত ভাষণের সাথে অন্য সময়ের চলচ্চিত্র সংযোজন। যেমনটি করা হয়েছে ৭ই মার্চের ভাষণের শুরুতে। এ ব্যাপারে আমি ৭ই মার্চ, ২০১৯ বিডিনিউজে "৭ মার্চ: সরকারিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অবহেলায় ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে." নিবন্ধে বিস্তারিত লিখেছিলাম।
বিশ্বে এখনও তিনটা দেশে সমাজতন্ত্র বিদ্যমান। দেশগুলো হল চীন, কিউবা ও উত্তর কোরিয়া। কিউবার সাথে বাংলাদেশের আগের সেই উষ্ণ সম্পর্ক আর নেই। উত্তর করিয়াও বাকি বিশ্ব থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। কিন্তু চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাধীনতা উত্তর কালের সময় পেরিয়ে এখন অনেক মজবুত। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময় অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে সব রকম সম্পর্ক চীনের সাথে গভীর। এক চেটিয়া ভারতের প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে তিনি বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য, বানিজ্যিক ভারসাম্য বাজায় রাখতে তিনি একচেটিয়া কোন দেশকে প্রাধান্য দেননি। একচেটিয়া চীনকে প্রাধান্য দিয়ে শ্রীলংকা ও মাল-দ্বীপকে বিপাকে পড়তে হয়েছে।
আমাদের সংবিধানের মূলনীতিতে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা স্বাভাবিক কারণেই আভ্যন্তরীণ মৌলবাদীরা পছন্দ করে না। আর এ সকল মৌলবাদীদের বিদেশী প্রভুদেরও প্রচণ্ড বিদ্বেষ লক্ষ করা যায়। যুক্তরাষ্ট্র সমাজতন্ত্রের ঘোর বিরোধী। এই দেশটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগা গোঁড়ায় প্রভাব বিস্তার করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ভারত একটা পুঁজিবাদী রাষ্ট্র দেশটা বর্তমান পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে সমাজতন্ত্র পছন্দ করে না। বিশেষ করে ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা কোনটাই পছন্দ করে না। প্রতিবেশী ক্ষুদ্র একটা দেশের প্রগতিশীল সংবিধান তাদেরকে চাপের মধ্যে রাখে।
পশ্চিম বাংলায়ও এখন প্রতিক্রিয়াশীলরা ক্ষমতায়। তারাও সমাজতন্ত্রের ভয়ে ভীত। তাছাড়া মমতা ব্যানার্জির সরকার বাংলাদেশে মৌলবাদীদের উস্কানি দিয়েছে এবং সহায়তা দিয়েছে। মোটকথা বর্তমান ভারতীয় সরকার ও পশ্চিম বাংলার রাজ্য সরকার কেউই এ দুটো মূলনীতিকে পছন্দ করে না। ধর্ম নিরপেক্ষতা বিজেপিকে শঙ্কিত করে। কলকাতার ঐতিহ্যবাহী সরকারি বেকার হোস্টেলের বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকক্ষে তার যে ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে, পশ্চিম বাংলার মৌলবাদীরাও তা অপসারণের দাবী জানিয়েছিল একসময়। মমতার সরকার বাংলাদেশকে বিপাকে ফেলতে সব রকম পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা জল বণ্টনে সকল আন্তর্জাতিক নিয়ম নীতি উপেক্ষা করে আমাদের বিপাকে ফেলেছে। এসব কারণেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী ফারাক্কা বিরোধী বাধের কথা ভেবেছেন। চীনের সাথে তিনি চুক্তি করতে চেয়েছেন। আর স্বাভাবিক কারণেই সেটা বিজেপি ও তার দোসর তৃনমূল কংগ্রেসের পছন্দ হয়নি।
এসব কারণে ভারত ও পশ্চিমবঙ্গ এবং তাদের দোসর যুক্তরাষ্ট্র মৌলবাদীদের উস্কানি দিয়ে থাকতে পারে। তাছাড়া এসব দেশের চরেরা প্রশাসন ও রাজনীতিতে ঘাপটি মেরে আছে। আর বি.এন.পি. ও জামাতের যে সকল চরেরা সরকারি দলের মধ্যে ঢুকে গেছে তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই উপরে আলোচিত চক্রান্তগুলো সফল হয়েছে।
চীনের যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা তাতে তাদের সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে কোন সমস্যা থাকতে পারে না। তারা অতীতের সব বৈরিতা ছেড়ে এখন বাংলাদেশের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যস্ত। চীন বাংলাদেশকে কিছু সুবিধা দিয়ে হলেও ভারতকে চাপে রাখতে আগ্রহী। এসব বিবেচনায় পরিষ্কার বর্তমান সরকারকে বিপাকে ফেলতে ভারতের ভূমিকা থাকতে পারে। বিজেপির মত একটা দল বি.এন.পি.কে বেশী পছন্দ করবে সেটাই স্বাভাবিক।
যেই এই অপকর্ম করে থাকুক না কেন জাতীয় সংসদের তথা মাননীয়া স্পিকারের উচিত হবে একটা উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত দল গঠন করে সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহের মধ্যে একটা রিপোর্ট প্রদান করা। এবং তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা। আর তারা কোন বিদেশী রাষ্ট্রের চর হয়ে কাজ করছে কিনা সেগুলো খতিয়ে দেখা। এর দায় কোনোভাবেই আমি প্রধানমন্ত্রীর উপর চাপাতে পারিনা। একজন প্রধানমন্ত্রীরও বিশ্রাম এর প্রয়োজন আছে। তার নিজের যথেষ্ট কাজ আছে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে। আর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সংসদে প্রচার নিয়ে যে অঘটন ঘটেছে প্রাথমিকভাবে তার দায় কোন ভাবেই প্রধানমন্ত্রীর না।
পরিশেষে বলব যদি এই জাতীয় ঘটনা একের পর এক হতেই থাকে তাহলে বঙ্গবন্ধু ভক্তরা বর্তমান আওয়ামী লীগ বিমুখী হবে। সরকার একটা বিশাল বঙ্গবন্ধু ভক্তের সমর্থন হারাবে। সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী, সরকার ও আওয়ামী লীগকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কোন পথে এগুবে। দলছুট বি.এন.পি., জামাত ও মৌলবাদী যারা দলের মধ্যে ঢুকে পড়েছে তাদের দিকে। নাকি যারা দুর্দিনে আওয়ামী লীগের সাথে ছিল, যারা পরীক্ষিত নেতা কর্মী, যারা প্রকৃতই বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করে তাদের দিকে।
এটা পরিষ্কার যে জনাবা স্পিকার বঙ্গবন্ধুর উপর যথেষ্ট বাড়ীর কাজ(হোম ওয়ার্ক) না করেই সংসদের সেদিনের অধিবেশনের আয়োজন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে প্রস্তুতিহীন এই কার্যকলাপ জাতিকে মর্মাহত ও লজ্জিত করেছে। ভেবে দেখেন মাননীয়া স্পিকার এই সুযোগ এই দিন কী আর ফিরে পাবেন? কিন্তু ভবিষ্যতে হয়তো কেউ এইদিনটিকে জাতীয় লজ্জা দিবস হিসাবে পালনের প্রস্তাব রাখবে।
পরিশেষে যা বলতে চাই তাহল বেতার সংসদকে সম্পাদিত ভাষণ দিয়েছে এর অর্থ এই না যে বঙ্গবন্ধুর সে ভাষণগুলো হারিয়ে গেছে। অমি রহমান পিয়াল ও মাহবুবুর রহমান জালাল তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই তারা লিখেছেন কোন অংশ বাদ গেছে। অতএব সরকার তাদের সাহায্য নিতে পারে। আর ৭ই মার্চের ভাষণের ব্যাপারে বলতে পারি, সেই ঐতিহাসিক ভাষণ হারিয়ে যায়নি। ১৮মিনিট ৩৯ সেকেন্ডের সে ভাষণ আমার কাছেও সংরক্ষিত আছে। যার একটা কপি উচ্চ আদালতে প্রমাণ হিসাবে দাখিল করা হয়েছে। মাননীয় স্পিকার ইতিহাসকে অবহেলা করার কোন সুযোগ আমাদের নেই। ৭ই মার্চ না আসলে আপনি আজ স্পিকার বা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আজ সে পদে থাকতেন কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সেক্ষেত্রে আমরা জাতির জনকের স্মৃতি বিজড়িত এসকল ভাষণ বিকৃতভাবে উপস্থাপন মেনে নিতে পারি না। ভবিষ্যতে যাতে এ জাতীয় দৃশ্যের অবতারণা না হয় সেজন্য এ সকল মূল্যবান নথী চীর স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
লেখক: তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, অল ইউরোপিয়ান বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন এবং জার্মান বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন।