পোশাকশিল্প ও করোনা ঝুঁকি

প্রকাশ | ১৫ মে ২০২০, ১৯:২৬ | আপডেট: ১৫ মে ২০২০, ১৯:৩১

এস. এম. খালিদ হোসেন

দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমনের মাত্রা যখন বেড়েই চলছে, বিশেষজ্ঞরা যেখানে মে মাসকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে পোশাক কারখানা খুলে দিয়ে সংক্রমনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেওয়া বর্তমান পরিস্থিতিতে খুবই উদ্বেগজনক একটি ব্যাপার।

পোশাক কারখানা হচ্ছে শ্রমঘন একটি শিল্প। অধিকাংশ গার্মেন্টস শ্রমিক কম ভাড়ার ছোট বাসায় থাকেন, যেখানে একই রুমে কয়েকজনকে থাকতে হয়। এছাড়া একাধিক পরিবারকে একই রান্নাঘর এবং বাথরুম ব্যবহার করতে হয়। করোনা রোধে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখাটা যেখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, সেখানে গার্মেন্টস শ্রমিকদের সেই দূরত্ব বজায় রাখা কতটুকু সম্ভবপর তা একটি প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। ফলে করোনা সংক্রমের ঝুঁকি অনেকাংশেই বেড়ে যেতে পারে। পোশাক শিল্পের কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে করোনা ভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। গত ২৬ এপ্রিল থেকে নতুন করে কারখানা খুলে দেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রমিক করোনায় সংক্রমিত হয়েছে যার মধ্যে অনেকের মৃত্যুও হয়েছে।

করোনার ঝুঁকি আর চাকুরি ও বেতনের অনিশ্চয়তার মাঝে উভয় সংকটে পড়েছে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানিখাত তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত লাখ লাখ শ্রমিক। সরকারের 'সবুজ সংকেত' পেয়ে বেশিরভাগ কারখানা উৎপাদন শুরু করলেও যথাযথ স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার পরিবেশ তৈরি করা হয়নি বেশিরভাগ কারখানায়। সীমিত আকারে কারখানাগুলো খোলার সিদ্দান্ত হলেও বর্তমানে শিল্পাঞ্চলের প্রায় অধিকাংশ পোশাক কারখানাগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। আংশিকভাবে কিছু কিছু বড় পোশাক কারখানা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেও অনেক কারখানাতেই স্বাস্থ্যবিধির নিয়ম নীতির কোনও পরোয়া করা হচ্ছে না যা গোটা পোশাক শিল্পকে এক চরম অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।পোশাকশিল্পের মালিকরা কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের সঠিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে হয়ত আমাদের দেশকে কঠিন বিপর্যয়কর এক পরিস্থিতির সন্মুখীন হতে হবে এবং চরম মূল্য দিতে হবে যা কখনই কাম্য নয়।

শ্রমিকদের অভিযোগ কারখানাগুলোতে নাম মাত্র স্বাস্থ্যবিধির কথা উল্লেখ থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কারখানার ভিতরে নিশ্চিত করা হচ্ছে না সঠিক স্বাস্থ্যসুরক্ষা। নেই কোনো নিরাপদ শারীরিক দূরত্বের কর্মপরিবেশ, মাস্ক, পিপিই বা সুরক্ষা সরঞ্জাম।আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) সতর্ক করে বলেছে, শ্রমিকদের কাজে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারলে ভাইরাসের দ্বিতীয় দফা ঢেউ আসতে পারে। আইএলও সরকারের প্রতি কর্মক্ষেত্রে কোভিড-১৯ রোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এ বিষয়ে নিয়োগকর্তা ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহন ও সংলাপের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে বলে মতামত ব্যক্ত করে সংস্থাটি।

কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং রপ্তানি আয়ের একটা বড় অংশ যোগানদানের ক্ষেত্রে পোশাকশিল্পের অবদান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনস্বীকার্য বিষয় যা নতুন করে আলোচনা করার প্রয়োজন নেই। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপিতে রপ্তানিমুখী শিল্পের অবদান ছিল ৪০.৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যার মধ্যে শুধুমাত্র পোশাকশিল্পের অবদানই ছিল ৩৪.১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে বাংলাদেশে পোশাকশিল্পের শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। এই বিপুল মুনাফার যোগান আসে মূলত শ্রমিকদের সস্তা শ্রম থেকে। বছরের পর বছর সরকার বাজেটের মাধ্যমে গতানুগতিক পথে এছাড়া বিভিন্ন অর্থনৈতিক অজুহাতে এ শিল্পের মালিকদের আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। কিন্ত তারপরও এ শিল্পের শ্রমিকদের মধ্যে বেতন ভাতা নিয়ে অসন্তোষ একটি নিত্য নৈমিত্তিক ব্যপার।

বর্তমান করোনা মহামারীর এই কঠিন সময়ে নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে চরম অনিশ্চয়তা।কারখানা লে-অফ ঘোষণা, শ্রমিক ছাঁটাই এবং বেতন না পাবার হতাশা থেকে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে বিভিন্ন শিল্পাঞ্চল। গত কয়েক দিনের সংবাদ পত্রের পাতায় চোখ বুলালে দেখা যাবে যে, গাজীপুর, আশুলিয়া এবং দেশের অন্যান্য স্থানের বেশ কয়েকটি্ পোশাক কারখানায়  শ্রমিক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে বেতন ছাড়া শ্রমিককে না খেয়ে মরতে হবে অথবা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনা উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হবে। একদিকে ক্ষুধার যন্ত্রণা আর অন্য দিকে করোনায় সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি। করোনা মহামারীর এই বৈশ্বিক সংকটে সরকারী মহল থেকে কারখানা মালিকদের বিভিন্ন প্রনোদনা ও সাহায্যের আশ্বাস দেওয়া হলেও সেদিকে কর্ণপাত করছে না অনেক শিল্পমালিক। করোনার প্রভাবে সরকারের ঘোষিত সাধারণ ছুটির মধ্যে কোনো ধরনের শিল্প-কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই না করতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর শিল্পমালিকদের নির্দেশনা দিয়েছিল। কিন্তু এ নির্দেশনা উপেক্ষা করেই কিছু গার্মেন্টস কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটেছে যা অত্যন্ত দুঃখজনক, হৃদয়বিদারক ও অমানবিক।

দেশের  এই বর্তমান দুর্যোগময় সময়ে যে যেখানে যে অবস্থায় আছে, সে সেখানে তার হাতকে সাধ্যমত প্রসারিত করবে এটাই সবার কাম্য, কোনো ধরনের সামাজিক অসন্তোষ কাম্য নয়। শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-ভাতা সহ ঈদের বোনাস প্রদান করা এবং সবোচ্চ স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।তাই দেশের কর্তাব্যক্তি সহ সকল নাগরিকসমাজ ও শিল্পমালিকদের প্রতি উদ্যাত আহ্বান থাকবে, আসুন আমরা সবাই প্রত্যেকের নিজের অবস্থান থেকে আরও বেশি দায়িত্বশীল হই, দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই এবং সহযোগীতার হাতকে সাধ্যমত প্রসারিত করে দেই। তবেই জাতির আকাশের এই অন্ধকাচ্ছন্ন মেঘ কেটে গিয়ে দেখা দিবে পরিষ্কার ঝলমলে সূর্যের কিরন।

ভালো থাকুক শ্রমিক সমাজ, ভালো থাকুক প্রিয় মানচিত্র।     

লেখকঃ শিক্ষক ও গবেষক, আর্মি আইবিএ সাভার(বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালস)
Email Address: [email protected]