আমরা অক্সফোর্ডের সারাহ গিলবার্টকে চিনি কিন্তু ঘরের বিজ্ঞানী বিজন কুমার শীল অচেনাই রয়ে যান

প্রকাশ : ২৮ এপ্রিল ২০২০, ১৩:৪৮

আমরা অক্সফোর্ডের অধ্যাপক সারা গিলবার্টকে চিনি কিন্তু ঘরের কীর্তিমান বিজন কুমার শীলকে চিনি না। অথচ সারা গিলবার্টের ট্রায়ালে থাকা ভ্যাকসিনের চেয়ে তাঁর উদ্ভাবিত করোনা শনাক্তকরণ কিট এ মুহূর্তে মানব জাতির জন্য কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অথচ গবেষক সারা ভাইরাল হলেও আপন নামের মতোই আড়ালেই থেকে যান বিজ্ঞানী বিজন কুমার শীল। উন্নত বিশ্বে জন্ম নিলে সারার মতো তাকে নিয়েই এ মুহূর্তে কম হইচই হতো না। 

কৃষক পরিবারের সন্তান

নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়ায় ১৯৬১ সালে এক কৃষক পরিবারে জন্ম বিজন কুমার শীলের। অকপটেই স্বীকার করেন তিনি কৃষক পরিবারের সন্তান। বাবাও ছিলেন একজন কৃষক। ছোটবেলা বাবার সঙ্গে কাজ করেছেন মাঠে। বাবা রসিক চন্দ্র শীল ও মা কিরণময়ী শীল। ২ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যে বিজন ছিলেন পঞ্চম। বনপাড়ার সেন্ট যোসেফ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক, পাবনার সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ভর্তি হন ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন ভেটেরিনারি সায়েন্স বিষয়ে। কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল অর্জন করেন। প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন অণুজীববিজ্ঞানে।

তারপর কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে একসময় যুক্তরাজ্যে যান। সেখানে দ্য ইউনিভার্সিটি অব সারে থেকে ১৯৯২ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো নিয়ে (ডেভেলপমেন্ট অব মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডিজ)। সেই থেকে বিজন কুমার শীলের অণুজীববিজ্ঞানে আগ্রহ, বিশেষ করে তাঁর ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর গবেষণা আর থেমে থাকেনি। এই গবেষণা এনে দিয়েছে বিশ্ববাসী তাঁর পরিচিতি, অণুজীববিজ্ঞানী হিসেবে বিশেষ খ্যাতি। অণুজীববিজ্ঞান নিয়ে ১৪টি উদ্ভাবনের পেটেন্ট রয়েছে নিজ নামে। পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় গবেষণা জার্নালগুলোতে ২০টির বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। ২০টির বেশি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন তিনি। বিজন কুমার শীলের স্ত্রী অপর্ণা রায় একজন প্রাণী চিকিৎসক। দাম্পত্য জীবনে তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।

কর্মজীবন

ড. বিজন কুমার শীল সিংগাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুকাল শিক্ষকতা করেন। এরপর ঐ চাকরি ছেড়ে জয়েন করেন এমপি নামক একটা বায়োলজিকস আমেরিকান কোম্পানিতে, ওটার মালিক ছিলেন যুগোস্লাভিয়ার একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। এরপর নিজেই বায়োলজিক্যাল রিয়েজেন্ট তৈরি ও ব্যবসা শুরু করেন। সম্প্রতি তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগ দেন মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্টে। সেখানে তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি মনোযোগ দেন গবেষণায়।

করোনাভাইরাস সনাক্তকরণের পদ্ধতি আবিষ্কার

২০০৩ সালে বিশ্বব্যাপী সার্স ভাইরাস আলোচনায় আসে। সার্স সংক্রমণের সময় বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল সিঙ্গাপুর গবেষণাগারে কয়েকজন সহকারীকে নিয়ে সার্স ভাইরাস দ্রুত নির্ণয়ের পদ্ধতি আবিষ্কারে মনোনিবেশ করেন। ড. বিজন কুমার শীলের নেতৃত্বে ড. নিহাদ আদনান, ড. মোহাম্মদ রাঈদ জমিরউদ্দিন ও ড. ফিরোজ আহমেদ সার্স ভাইরাস শনাক্তকরণ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। ‘র‌্যাপিড ডট ব্লট’ পদ্ধতিটি ড. বিজন কুমার শীলের নামে পেটেন্ট করা। পরে এটি চীন সরকার কিনে নেয় এবং দেশটি সফলভাবে সার্স মোকাবেলা করে। উল্লেখ্য, তার আগে ১৯৯৯ সালে হঠাৎ একবার বাংলাদেশে ছাগলের মড়ক শুরু হয়। ছাগলের মড়ক ঠেকানোর জন্য সেবার পিপিআর ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছিলেন তিনি।

সিঙ্গাপুরেই গবেষণা করছিলেন তিনি ডেঙ্গুর ওপরে। যে ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ ধারণ করে বিশেষ করে ঢাকা মহানগরীর জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। এখনও ডেঙ্গু সংকট কাটেনি। এ সংকটে এখনও তিনি আমাদের আলোর সন্ধান দিতে পারেন। গবেষণা চলাকালে বছর দুয়েক আগে তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগ দেন। সম্প্রতি ফের বিশ্ব যখন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে বিপর্যস্ত তখন এ অনুজীববিজ্ঞানী মনযোগ দেন করোনা শনাক্তকরণ কিট উদ্ভাবনে এবং সার্স ভাইরাস নিয়ে গবেষণা অভিজ্ঞতা থাকায় খুব তাড়াতাড়ি তিনি ও তাঁর দল সফলতার মুখ দেখেন। গণস্বাস্থ্য র‌্যাপিড ডট ব্লট (জি র‌্যাপিড ডট ব্লট) নামের এই কিট তৈরির দলে সম্পৃক্ত রয়েছেন আরও কজন অণুজীববিজ্ঞানী। 

তাঁরা হলেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নিহাদ আদনান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রাশেদ জমিরউদ্দিন এবং আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ড. আহসানুল হক।

তাঁদের এই দলগত গবেষণাকাজ সমন্বয় করেন গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা. মহিবুল্লা খন্দকার। সার্বিক তত্ত্বাবধানে ও প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতায় আরও ছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ।

গণমাধ্যমকে ইতোমধ্যে তারা জানিয়েছেন বিদেশ থেকে আমদানি করলে এ কিটের দাম পড়ত ৪-৫ হাজার টাকা মত। সেখানে তাদের উদ্ভাবিত কিটের খরচ পড়বে মাত্র তিনশ থেকে চারশ টাকার মধ্যে। বৈশ্বিক করোনা মহামারীর কালে তাঁর নেতৃত্বে এ আবিষ্কার নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের হতদরিদ্র মানুষের জন্য অর্থনৈতিকভাবে খুবই সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য হবে এ কিট।

অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী বিজন কুমার শীল আমাদের আনসাং হিরো। এই বৈশ্বিক মহামারী ও ক্রান্তিকালে আমাদের প্রকৃত বীর। বিশ্ববরেণ্য এ বিজ্ঞানী বাঙালির গর্বের ধন। তাকে অশেষ শ্রদ্ধা জানাই। শ্রদ্ধা জানাই গবেষণাগারে বিনিদ্র থাকা তাঁর সকল গবেষক সহযোদ্ধাদের।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ