‘বাতিল’ নাকি ‘স্থগিত’!

প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০২০, ১২:৩৭

হাসান ইবনে হামিদ

করোনা ভাইরাসের ভয়াল থাবায় গোটা বিশ্ব দিশেহারা। চীনের উহান শহর থেকে দ্রুতই এটি ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ার দেশগুলোতে। সর্বত্রই আতংক, জারি করা হচ্ছে রেড এলার্ট, সরকারি ও বেসরকারিভাবে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে। 

ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতে এর আঁচ লেগেছে। গত ৫ মার্চ ভারতের পররাষ্ট্র দফতর আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জানায় যে, আগামি ১৭ মার্চ ‘মুজিববর্ষ’ উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে আসবেন। মোদির বাংলাদেশ সফরের কথা ঘোষিত হলেও করোনা ভাইরাসের কারণে ব্রাসেলসে ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ সম্মেলন স্থগিত রাখার কথাও জানানো হয়েছে। ওই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মোদির যোগ দেয়ার কথা ছিল। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রবীশ কুমার জানান, ওই শীর্ষ সম্মেলনের পরবর্তী দিন উপযুক্ত সময়ে স্থির করা হবে। কেনো ইউরোপের প্রোগ্রাম বাতিল করা হলো তা আমাদের অজানা নয়। বর্তমানে চীনের পর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো। ইতালির অবস্থা খুবই ভয়াবহ। হাজারো মানুষ আছে কেয়ার সেন্টারে, এখন পর্যন্ত শুধু ইতালিতেই শ’য়ের উপরে মানুষ নিহতের খবর পাওয়া গিয়েছে। এমতাবস্থায় ইউরোপে ভ্রমণ কখনো নিরাপদ হতে পারেনা। তাই সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে নরেন্দ্র মোদীর ইউরোপ সফর বাতিল করলেও বাংলাদেশে আসবেন বলে জানান। কিন্তু বিপত্তিটা বাঁধে এর পরই। ৫ মার্চ বৃহস্পতিবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রবিশ কুমার যখন আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের বিষয়টা এরপরেই গত ৮ মার্চ রবিবার বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত রোগী ধরা পড়ে। এবং এটি নিয়ে অনেকটা নীরব থাকার পলিসি নেয় স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেকের নেতৃত্বে রোববার সকালে স্বাস্থ্য বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী সম্পর্কে অবহিত করতে যান। সেসময় কেউ কেউ কয়েকটা দিন করোনাভাইরাস আক্রান্ত তথ্য গোপন করে আগামী ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের পর ঘোষণা দেয়ার প্রস্তাব করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা সরাসরি নাকচ করে দেন। কোন তথ্য গোপন না করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানোর নির্দেশ দেন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনায় যা আছে সেভাবেই করোনার ঘোষণা প্রদান করতে বলেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীর অনুষ্ঠান পরেও করা যাবে। অনুষ্ঠানের চাইতে দেশের মানুষের ভালোমন্দ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।‘ 

এরপরেই বাংলাদেশের তরফ থেকে ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতর ও বিদেশ থেকে আমন্ত্রিত অতিথিদের করোনার বিষয়ে অবহিত করে পত্র প্রেরণ করা হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বার্তা দেয়া হয় এই মর্মে যে, ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীর অনুষ্ঠান কাটছাঁট করা হয়েছে। ১৭ মার্চ জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠেয় মূল অনুষ্ঠানটি ওই দিন হচ্ছে না। করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জনস্বার্থে ও জনকল্যাণে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পরে এই সমাবেশের তারিখ চূড়ান্ত করা হবে।‘ 

যেহেতু জনসমাগমে এই করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেশি হয় তাই যে কোন ধরণের গেদারিং এবং কর্মসূচি বাংলাদেশ সরকার না করার আহবান জানিয়েছে। এমনকি দেশব্যাপী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যে কাউন্সিল হচ্ছিলো সেই চলমান কাউন্সিল ও স্থগিত করা হয়েছে। 

এদিকে ৮ মার্চ গণমাধ্যমে সংবাদ আসলো, নরেন্দ্র মোদী সফর ‘বাতিল’ করেছেন। যেখানে করোনাভাইরাসের উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সফর ‘স্থগিত’ করা হয়েছে সেখানে অনেক গণ মাধ্যম রিপোর্ট করে বসলো নরেন্দ্র মোদী সফর ‘বাতিল’ বাতিল করেছেন। আশারাখি, গণ মাধ্যম ‘বাতিল’ এবং ‘স্থগিত’ এর পার্থক্যটা বুঝেন। 

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বিবৃতিই দেয়া হয়েছে এবং শেষে এটা ও বলা হয়েছে পরবর্তীতে উপযুক্ত সময়ে এই অনুষ্ঠানের দিন তারিখ ধার্য করা হবে। অথচ রিপোর্টে লেখা হলো ভারত সফর বাতিল করেছে! অজ্ঞাতসারে কি এই ভুল নাকি ইচ্ছাকৃত সেটা আলোচনার দাবী রাখে। ‘কূটনৈতিক অজুহাত’ হিসেবে করোনাভাইরাসকে উপস্থাপন করে নরেন্দ্র মোদী এই সফর বাতিল করেছেন বলে অনেকেই গণমাধ্যমে লিখছেন। তাহলে গত ৫মার্চ  ইইউ-ইন্ডিয়া সম্মেলন যে বাতিল করলো করোনার কারণে সেটা কে কি হিসেবে অভিহিত করবেন? আগামী ১৩ মার্চ ব্রাসেলসে যাওয়ার কথা ছিল নরেন্দ্র মোদীর৷ কিন্তু শেষ মুহূর্তে দুই তরফই করোনার কারণে সম্মেলন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়৷ যেমনটা বাংলাদেশ-ভারত এর ক্ষেত্রে হয়েছে। তাই যারা রাজনৈতিক কারণ খুঁজছেন তাদেরকে দ্বিতীয় বার ভাবতে হবে ব্রাসেলস সম্মেলনের কথাও। ভাবতে হবে ৫ মার্চ আনুষ্ঠানিক ভাবে নরেন্দ্র মোদী আসার ঘোষণা ও তবে তারা দিতোনা নিশ্চয়ই। তাই কূটনৈতিক অজুহাত থাকলে যে দিন ব্রাসেলস সম্মেলনে না যাবার ঘোষণা এসেছিলো সেদিনই একই কারণে বাংলাদেশ সফর স্থগিতের ঘোষণা আসতো। কিন্তু আসেনি কারণ ততক্ষণ পর্যন্ত করোনা সংক্রমণ ঘটেনি বাংলাদেশে। তাই করোনাভাইরাসকে ‘কূটনৈতিক অজুহাত’ হিসেবে উপস্থাপন মানে করোনা আক্রান্ত মানুষ ও সেই নিহতের ঘটনাগুলোকে অবজ্ঞা করা। কেননা করোনাভাইরাস কতো ভয়ানক তা বোধ হয় নতুন করে বলার কিছু নেই, গোটা বিশ্ব এর ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করছে। 

যখন অভিযোগ উঠেছে এই, করোনার কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশ তাদের অনুষ্ঠান বাতিল করেছে৷ তখন ভারত সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে তারা বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে একটা অফিসিয়াল লেটার পেয়েছেন এবং করোনা ভাইরাসের কারণে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠান স্থগিতের বিষয়টি তাদের জানানো হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের  মুখপাত্র রবীশ কুমার স্পষ্টভাবে জানান, ‘এই সফর বাতিল করা হয়নি বরং করোনার কারণে স্থগিত হয়েছে। ফলে করোনাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে, এই প্রশ্নটিই অবান্তর৷’

মুজিববর্ষ পালন করার মধ্যে শুধু আমাদের উচ্ছাস প্রকাশই নয়, এতে রয়েছে আমাদের দায়িত্ববোধ, শ্রদ্ধা ও জাতির পিতাকে স্মরণ করা। তাঁর শতবর্ষে পদার্পণ করার সময়টা এ জাতির জন্য অনেক বড় বিষয়। বঙ্গবন্ধুই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। আর এই দেশ স্বাধীনের সময় আমাদের সার্বিক সহায়তা দেয়া রাষ্ট্রের নাম ভারত। তাই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে ভারতের সরকার প্রধান হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর আসাটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তাছাড়া এনআরসি ইস্যু ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় সেটা আমাদের সবাইকে মাথায় রাখতে হবে। তাই ভারতের প্রতিনিধি হয়ে তাঁর আসার সঙ্গে অন্যকিছুর সম্পর্ক খোঁজা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। মাথায় রাখতে হবে, ভারত সরকারকে আমন্ত্রণ না জানিয়ে মুজিববর্ষ উদযাপন করা মানে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের অবদান অস্বীকার করা। 

লেখক- রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ