লিট ফেস্টের সীমাবদ্ধতা বনাম সমাজের সীমাবদ্ধতা

প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০১৯, ১৮:৩৬

(১)
আমি তো লিটফেস্টে প্রতিবছরই যাই, এবারও যেতাম। সস্ত্রীক যাই, সপরিবারে যাই, সবান্ধব যাই। আমার নিজের এবার যাওয়া হয়নি কারণ যে তিনদিন লিটফেস্ট ছিল ঠিক সেই তিনদিনই আমি রাঙ্গামাটি ছিলাম। রাঙ্গামাটির কর্মসূচীটা বেশ আগে থেকেই নির্ধারণ করা ছিল, সেজন্যে লিটফেস্টে এবার রেজিস্ট্রেশনও করিনি। বিষ্যুদবারদিন রাঙ্গামাটি যাবো, তার দুই কি তিনদিন আগে মনীষাকে জিজ্ঞাসা করেছি, এবারের লিটফেস্টের কর্মসূচীর হাইলাইট কি? আমার টেবিলে 'এনার্কি' দেখিয়ে মনীষা বললে, এইবার উইলিয়াম ডালরিম্পল আসছেন। এনার্কি বইটা আমি মাত্র সপ্তাহ দুই তিন আগে কিনেছি পাঠক সমাবেশ থেকে।

আমি এমনিতে লেখকদের পিছনে মুগ্ধ নয়নে ঘুরে বেড়ানো টাইপ পাঠক নই। কবি বা লেখকে আমি কেবল তাঁর বইটি দিয়েই চিনতে চাই। কিন্তু তারপরেও এই যে লেখকরা নিজেদের কথা বলেন, ওদের সৃষ্টি নিয়ে সৃষ্টিলীলা নিয়ে কথা বলেন সেইগুলি শুনতে খারাপ লাগে না। আর লিটফেস্ট তো সেরিকম ইয়ের জন্যে একটা চমৎকার আয়োজন আরকি। গতবছর এইখানে ভিএস নাইপল এসেছিলেন। নাইপলের কথা শুনেছি, বেশ লেগেছে আমার কাছে। সেবার নাইপল বেশ বার্ধক্য আক্রান্ত ছিলেন, এরপর তো নাইপল চলেই গেলেন। ডালরিম্পল আসছেন শুনে মুহূর্তের জন্যে ভেবেছিলাম তবে কি রাঙার কর্মসূচীটা বাদ দিয়ে দিব?

একদল আছেন যারা লিটফেস্ট ব্যাপারটা পছন্দ করেন না। ঠিক আছে। লিটফেস্ট ব্যাপারটা পছন্দ না করার নানাপ্রকার কারণ আছে। আগে যখন এটা হে ফেস্টিভ্যাল নামে ছোট পরিসরে হতো, তখন থেকেই অনেকেই এই আয়োজনটার নিন্দা করেছেন। যারা এই আয়োজনটা পছন্দ করেন না ওদের মধ্যে অল্প কয়েকজন আছেন যাদের যুক্তিটা বুঝা যায় এবং গুরুত্ব দিতে হয়। বেশিরভাগই ফালতু বাত বলেন। আমার কথা যদি বলেন, আমি তো স্পষ্ট করেই বলছি যে আয়োজনটা ভাল। অনেক বইয়ের একটা আয়োজন থাকে, লেখকরা আসেন, দেশের লেখক কবিদের অনেকেও থাকনে। আলোচনা হয়। বেশ তো।

(২)
লিটফেস্টের নেতিবাচক দিকও আছে। ঠিক নেতিবাচক বলবো না হয়তো, সীমাবদ্ধতা বলতে পারেন। এটা হচ্ছে প্রিডমিনেন্টলি ঢাকা শহরের উচ্চ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত ইংরেজি শিক্ষিত লোকজনের ইভেন্ট। ইংরেজি ভাষার অনুষ্ঠান। ইংরেজি বইয়ের অনুষ্ঠান। দেশের সকল ছাত্র তরুণ ও পাঠককে সেইভাবে টানে না। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছেলেমেয়েরাই সেখানে গিজগিজ করে। লিটফেস্টের এইটা একটা বাস্তব সীমাবদ্ধতা। কিন্তু এর জন্যে আমি লিটফেস্ট অনুষ্ঠানের বিপক্ষে যেতে পারি না আরকি।

একসময় হে ফেস্টিভ্যালের নিন্দা করতেন এরকম অনেককেই আমি পরে আমি লিটফেস্টে যেতে দেখেছি। বাংলা একাডেমীর প্রাঙ্গণে হওয়ার পর থেকে এখানে লোক সমাগম বেড়েছে। ঢাকাই কবিদের অনেককেই আমি লিটফেস্টে দেখেছি। গত বছর তো নির্মলেন্দু গুনকে দেখলাম বিশাল ভক্তের দল পরিবেষ্টিত হয়ে বসে আছেন পুকুরের পারে। অনুষ্ঠানের আলোচকও ছিলেন তিনি, কবিতা পড়েছিলেন কিনা সেকথা মনে নাই।

এর আগে কোন বছর লিটফেস্ট নিয়ে বা সেখানে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে কোন কথা হয়নি। আমি মাঝে মাঝে সেখানকার ফটো পোস্ট করেছি- ঐটুকুই। এইবার তাইলে এতো কথা আসছে কেন? এইবার এতো কথা আসছে কারণ এইবার কিনা ব্রিটিশ হাইকমিশনারের স্ত্রী এবং তাঁর সাথে সাথে আরও কয়েকজন একটু নৃত্য করে ফেলেছেন আর কারা যেন তার ভিডিও পোস্ট করেছে ফেসবুকে- আর আপনারা সকলে সেই ধেই ধেই নৃত্য দর্শনে একটু পীড়িত হয়েছেন। সাহেবের বেটি এইরকম নেচে ফেলবে কেনে, তাও কিনা আবার বাংলা গানের সাথে- গেল গেল, অনুষ্ঠানের ভাবগাম্ভীর্য গেল ইত্যাদি।

(৩)
লিটফেস্টে অনেক বিদেশীরা থাকে। বাংলাদেশে যেসব সাহেব মেমসাহেব বাস করেন ওরা তো লিটফেস্টে যান, দল বেঁধেই যান। গুরুত্বপূর্ণ অনেকেই আপনি দেখতে পাবেন সেখানে। এছাড়া ভিনদেশী আলোচকরা আসেন, ভিনদেশী নানারকম শিল্পীরাও আসেন। নাচের শিল্পীও সম্ভবত এসেছেন এর আগে। গল্প বলিয়ে একজন আফ্রিকান মহিলা এসেছিলেন একবছর- চমৎকার ছিল তাঁর পরিবেশনা। ভারতীয় ফোক শিল্পী, দিশী ফোক শিল্পীরা নাচ গান নাট্য ধরনের পরিবেশনাও লিটফেস্টে করেছেন। সেইগুলি নিয়ে কেউ কখনো প্রশ্ন তোলেননা কেননা সেগুলি তো রীতিমত শিল্প। কিন্তু এই বিশেষ নাচখানা কিনা সেরকম কোন রীতিমত কোন পরিবেশনা নয়, একরকম স্বতঃস্ফূর্ত ইয়ে, এটাকে নিয়ে তাই এতো কথা।

ঠিক আছে, ওদের এইরকম নর্তন কুর্দন যদি আপনার পছন্দ না হয় তাইলে আপনি তো তাঁর নিন্দা করবেনই। করেন। কিন্তু মেহেরবানী করে এইটা বলবেন না যে এইরকম কেতু কোমর দোলালে বা একটু লঘু রসের উপস্থিতি হলেই অনুষ্ঠানের ভাবগাম্ভীর্য চলে যায় বা আপনার সংস্কৃতির উপর বিশাল আঘাত আসে বা বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণ অপবিত্র হয়ে যায়। বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণ কোন মন্দিরের বা সিনাগগের আঙ্গিনা নয় যে সেখানে একটু কোমর দোলানো যাবে না। বা লিটফেস্ট এমন কোন ইয়ে নয় যে একজন একটু উদ্বাহু করলে তাঁর পবিত্রতা নষ্ট হবে।

তাছাড়া বাংলা একাডেমীর প্রাঙ্গণে দর্শক শিল্পী বা অংশগ্রহণকারীদের এইরকম একটু নাচনকুদন অভূতপূর্ব কোন ব্যাপারও নয়। এইখানেই গাছের নীচে বাউল গান বা অন্যান্য গানের সাথে দর্শকদের অনেককেই আমি টুকটাক নেচে ফেলতে দেখেছি। আপনিই চিন্তা করে দেখেন, কীর্তনের 'সখা হে' টানের সাথে যদি একজন সাহেব বা মেমসাহেব দুই বাহু উপরে তুলে একটু দুলে উঠতেন তাইলে কি আপনি এতোটা কঠোরভাবে সমালোচনা করতেন? করতেন না। বরং সেইখানে হয়তো আপনিইই আহা উঁহু মধু মধু করে উঠতেন। তাইলে এইসব মেমসাহেবদের প্রতি এরকম বিরূপ হওয়াটা তো ন্যায় হলো না আরকি।

না, ভিডিওটিতে যেরকম গানের সাথে যেরকম নৃত্য ওরা করছিলেন সেটি আমারও বিশেষ পছন্দ নয়। আমাকে যদি সেইখানে কেউ নাচতে ডাকতো আমি খুবই অস্বস্তি বোধ করতাম। চটুল গানের সাথে নানা দাওয়াতে বা অনুষ্ঠানে যখন লোকজন নাচতে থাকে সেখানে আমাকে কেউ নাচতে ডাকলে আমি অস্বস্তিতে পড়ে যাই। এইরকম কোমর দোলানিতে আমি বিশেষ পারঙ্গম নই- এমনকি ডিস্কো ফিস্কোতেও আমার করুন অবস্থা হয়। কিন্তু তাইলে বলে অন্যরা যদি এউ চক্কর নেচে আনন্দ পায় তাতে আমার বিশেষ কোন অসুবিধা হয় না। ভাই, আপনার পছদন হলে আপনি নাচবেন, সে যদি বান্দরনাচের মতোও হয় সে আপনার রুচি পছন্দের ব্যাপার। আমার কি?

(৪)
শোনেন, লিটফেস্ট ব্যাপারটার আরেকটা দিক আছে। আমাদের দেশটা নিয়ে তো আমাদের একটা স্বপ্ন সবসময়ই ছিল যে এটা একটা সেক্যুলার দেশ হবে, এখানে আমরা সঙ্কীর্ণতা ও গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে উঠে উন্নততর সাংস্কৃতিক পরিবেশ তৈরি করবো, খোলা হাওয়া বিরাজ করবে। এখন তো দেশে ঠিক তার উল্টো একটা পরিবেশ বিরাজ করছে। একটি বিশেষ ধর্মীয় বিশ্বাসের লোকজন চাইছে যে দেশে ওদের প্রথা বিশ্বাস ও পছন্দ ইত্যাদির বাইরে আর কিছু করতে পারবে না। স্কুলের পাঠ্য বই পাল্টে ফেলছে ওরা, ছোট বাচ্চাদের পাঠ্য বইতে ছবি পাল্টে দিচ্ছে। আমাদের দেশটা এইরকম হোক সে তো আমরা চাইনি। আমরা চেয়েছি এখানে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য থাকবে, বিশ্বাস চেতনা ও মতামতের বৈচিত্র্য থাকবে- উদারতা থাকবে।

লিটফেস্ট খুব ছোট মাত্রায় হলেও আমাদের সংস্কৃতিতে ঐরকম একটা খোলা হাওয়া এনে দেয়। এইটাতে যদি আমরা বাগড়া দিই, এইটা যদি আমরা বন্ধ করে দিতে চাই তাইলে প্রকারান্তরে আমরা ওদের হাতকেই শক্তিশালী করবো যারা আমাদের দেশে উদার গোঁড়ামিমুক্ত সাংস্কৃতিক পরিবেশ চায় না। লিটফেস্ট আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্যে নানা দেশের না বিচিত্র বিষয়ের নানা জাতের বইপত্র পড়তে একটু উৎসাহিত করে। লিখতে ও চিন্তা করতেও উৎসাহিত করে। এইখানে যদি আপনি বাঁধা দেন তাইলে আপনি কোন না কোনোভাবে একবইওয়ালাদেরই উপকার করে দিলেন আরকি।

শিল্প সংস্কৃতিতে প্রেসক্রিপশন কখনোই ভাল ফল বয়ে আনে না। অনেক কিছুই আপনার পছন্দ হবে না- কিন্তু কেউ যদি চায় সেগুলিকেও চর্চা করতে, করুক। আপনি যদি কঠিন নিয়ম করে রাখেন তাইলে তো ছেলেমেয়েরা এখন আমরা যেখানে আছি সেখানেই থাকবে। বিকাশ আর হবে না। ওদের জন্যে মুক্ত পরিবেশ রাখতে হবে। ওরা এটা দেখবে, ওটা পড়বে, সেটা গাইবে তবেই না ওরা কোনটা সঠিক সেটা বেছে নিতে পারবে। আপনি কেন জোর করে আপনার পছন্দ চাপাতে চাইবেন। আপনার পছন্দই যে সবচেয়ে সঠিক পছন্দ সে তো নাও হতে পারে। আর আপনার কথাটাই যদি ঠিক হয়, তাইলে ওরা ঘুরেফিরে এখানেই আসবে।

(৫)
কেউ একটু ভিন্ন কিছু করলে বা ভিন্ন কিছু বললে ভয় পাবেন না, তেড়েফুঁড়ে উঠবেন না। সত্য বড় কঠিন জিনিস, তাঁকে যত পরীক্ষা করবেন যত চ্যালেঞ্জ করবেন সে ততোই পোক্ত হবে। যেটা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে ভয় পায় সেটি সত্যিই নয়। সংস্কৃতিতেও এইটাই ব্যাপার।

 

লেখক: আইনজীবী ও এক্টিভিস্ট

মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪.কমের সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা এক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় আমাদের নেই।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ