শিক্ষাবিদের মর্যাদা আর পদের মোহ

প্রকাশ : ১১ নভেম্বর ২০১৯, ১২:৫২

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বললে চোখের সামনে ভেসে উঠে শিক্ষিত রুচিবান এবং মর্যাদা সম্পন্ন একজন মানুষের ছবি। আর ভাইস চ্যান্সেলর মানে সেই ব্যক্তি যিনি শুধু শিক্ষক নন একজন শিক্ষাবিদ। যিনি শিক্ষা নিয়ে ভাববেন, ভাবাবেন, পথ দেখাবেন এবং দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। শিক্ষিত মানুষ মানে মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ। শিক্ষিত মানুষ প্রয়োজনে নিজের ক্ষতি স্বীকার করতে পারে কিন্তু নিজেকে ছোট করতে পারে না। কিন্তু এসব কথা অসার প্রমানিত করতে যেন উঠে পড়ে লেগেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরগণ। এখন উত্তাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, অতি সাম্প্রতিককালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আবরার হত্যাকে কেন্দ্র করে আন্দোলন, গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল সব কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহার ও রাষ্ট্র ক্ষমতার আশীর্বাদে কাউকে তোয়াক্কা না করার দৃষ্টান্তগুলো সামনে চলে এসেছে। তাই প্রশ্ন উঠছে আবার, ভাইস চ্যান্সেলর হওয়ার যোগ্যতা কি হবে,কারা হবেন, কিভাবে হবেন?

শিক্ষকেরা বড় হন, বুড়ো হন কিন্তু তাদের ক্লাসের ছাত্ররা কখনো বুড়ো হয় না কখনো। তবে বড় হতে থাকে প্রতিদিন। বয়সে যতটা তার চেয়েও বেশি বড় হতে থাকে জ্ঞানে, পাণ্ডিত্যে। প্রতি বছর নতুন ছাত্র আসে অজ্ঞতা আর সম্ভাবনা নিয়ে। কাদা মাটির মত তাকে অনেক যত্নে আকার দিতে না দিতেই সেই ছাত্রদের বিদায় নেবার সময় এসে যায়। তাদেরকে হারিয়ে দুঃখ নয় তৃপ্তি পান শিক্ষকেরা। পুরনোদের জায়গা খালি থাকার কোন অবকাশ নেই। স্রোতের ধারার মত কলকল করে নতুন ছাত্ররা এসে ভরিয়ে ফেলে শূন্যস্থান। আবার শুরু হয় মানুষ হবার পথে তাদেরকে এগিয়ে দেবার পালা। মানবজাতির অতীত ইতিহাসের অর্জনগুলোর নির্যাস ছাত্রদের কাছে তুলে ধরেন তারা। এক্ষেত্রে শিক্ষকগণ শুধু ছাত্রদেরকে মুখস্ত করতে শেখান না তোতাপাখির মত, বরং তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেন শিখতে, তাঁরা ছাত্রদেরকে সেই পথ দেখান যে পথে চললে শেখা যাবে। শিক্ষক তাই এক অর্থে পথ প্রদর্শকও বটে। আমাদের প্রত্যেকের জীবনে শিক্ষকের কাছে স্নেহ, শাসন পাবার অনেক ঘটনার সাথে জড়িয়ে আছে বড় হবার স্বপ্ন দেখাবার ঘটনার কথা। প্রতিটি বড় মানুষের জীবন তাই কোন না কোন শিক্ষকের স্বপ্ন দেখানোর সাথে জড়িয়ে আছে।

বাংলাদেশে এখন ৪৯ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে ৩ টিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়নি, বাকি ৪৬ টিতে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। এগুলোর মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম মাত্র হলেও ৭৩’র অধ্যাদেশ চালু আছে । বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় চলছে ৬১’র অধ্যাদেশ দিয়ে। যে অধ্যাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্ত শাসন নেই। বাকি বিশ্ববিদ্যালয় গুলো স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত হলেও সেখানে কোন স্বায়ত্তশাসন নেই। স্বায়ত্তশাসনবিহীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ করা হয় ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষ থেকে। যে ৪ টি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্ত শাসন আছে বলে দাবী করা হয় সেখানেও ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ পেয়ে থাকেন সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী। অর্থাৎ জ্ঞান বিজ্ঞান দর্শন সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে দক্ষতা নয়, সরকারের প্রতি কতটা অনুগত থাকতে পারেন বা পারবেন তা দিয়েই নির্ধারিত হয় ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে কে মনোনীত হবেন। ৭৩ এর অধ্যাদেশ দ্বারা পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সিনেট গঠন, উপাচার্য নির্বাচন নিয়ে অনেক সমালোচনা থাকলেও যে সিনেট আছে তাদের মতামতকেও তোয়াক্কা করা হয় না। মনোনীত শিক্ষককে ভাইস চ্যান্সেলর পদে নিয়োগ দিয়ে তারপর তাঁকেই নির্বাচিত করার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। ফলে ভাইস চ্যান্সেলরগণ শিক্ষার মান উন্নয়নের চাইতে উপরের নির্দেশ মানার মানসিকতা দিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন। তাঁরা নিজেদের মর্যাদা সম্পর্কে যে কতটুকু সচেতন তা তাদের বক্তব্য আর আচরনে প্রতিদিন প্রকাশ ঘটিয়ে চলছেন। সম্প্রতি এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর সরকারি যুব সংগঠনের সভাপতি হবার আকাংখা ব্যক্ত করে এর সরল বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। এসবের ফলে বিশ্ববিদ্যালয় হারাচ্ছে তার শিক্ষার মান আর ভাইস চ্যান্সেলররা হারাচ্ছেন তাদের মর্যাদা।

পদের মোহ, আনুগত্য, বশ্যতা আর প্রলোভনের কাছে নতিস্বীকার কত বড় মানুষ হওয়ার সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেয়, কত বড় মানুষকে ছোট করে দেয় আর নামিয়ে দেয় মানুষের মূল্যবোধ তা দেখছি আমরা প্রতিদিন। তারপরও তো মানুষ আশা করে, ভরসা করতে চায় বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার শিক্ষকদের প্রতি। কিন্তু প্রত্যাশা যতই থাক নিয়মের বাইরে যাওয়ার তো উপায় নেই। প্রচলিত শোষণমূলক, দুর্নীতিগ্রস্থ পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে অনুসরন করে এর বাইরে যাওয়ার উপায় থাকে না কারো। তাই শিক্ষক নিয়োগ, প্রশাসনিক দায়িত্ব বণ্টন, কর্মচারী নিয়োগ, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বরাদ্দ সহ অর্থনৈতিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভাইস চ্যান্সেলরদের সংশ্লিষ্টতা এবং দুর্নীতির খবর ছড়িয়ে পড়ে হাওয়ার বেগে। মানুষ ভাবে এই দুর্নীতিটা না করলে কি চলতো না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা যে বেতন ভাতা পান তাতে কি মান সম্মান নিয়ে বাঁচা যায় না? কিন্তু প্রশ্নটা সরল হলেও উত্তর কিন্তু অতো সহজ নয়। রাষ্ট্র এবং প্রশাসনের যে সব গ্রন্থিতে তারা বাঁধা পড়ে যান তা ছিন্ন করার ইচ্ছা বা সামর্থ্য অনেকের থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণকারী পদে থেকেও কিভাবে তারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে যান, ক্ষমতাবলয়ের সাথে থাকা অনেকের সেই লেজে গোবরে অবস্থা মানুষ দেখেছে। কিন্তু যে বিষয়টি দুঃখজনক তা হল এদের অনেকেই তা আবার উপভোগ করেন এবং ক্ষমতার পাকে জড়িয়ে পড়েন সচেতনভাবেই। তারা পৃষ্ঠপোষক হয়ে পড়েন নিজের প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর ভাইস চ্যান্সেলর এক্ষেত্রে এক সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত।

যখন অভিযোগ উঠলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার তখন অনেকেই ভেবেছিলেন, ভাইস চ্যান্সেলরের পদ রক্ষায় এরকম তো অনেকেই করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিকাদারি কাজে ভাগ বাঁটোয়ারার কথা দীর্ঘদিন ধরে জানা। হল দখল করে রাখা, ছাত্রদের উপর নির্যাতনের নতুন নতুন পদ্ধতি, দোকানে খেয়ে টাকা না দেয়া ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের এসব কর্মকাণ্ড এবং তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দোকানের জন্য স্থান বরাদ্দ, তাদের দাবী অনুযায়ী প্রার্থীদের চাকরি দেয়া এসব তো চলে আসছেই। দেখতে দেখতে আর শুনতে শুনতে এসব অন্যায় যেন স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। এখন বরং তুলনা করা হয় কে কত বেশি বা কম করেছে তা নিয়ে। কিন্তু ঈদ উপলক্ষে ছাত্রনেতাদের সেলামি দেয়ার নতুন এক নজির তৈরি করলেন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। শুধু নজিরেই চমক নয় সেলামির পরিমাণ শুনে আঁতকে উঠার মত। একজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা সারাজীবন চাকরি করে অবসরের সময় যে টাকা পাওয়ার আশা করেন, ছাত্রলীগের একজন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের নেতা ভিসি’র কাছ থেকে ঈদের সময় সেই পরিমাণ টাকা সেলামি পেয়েছেন। খবর পেয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা ছুটে গেলেন ন্যায্য পাওনা চাইতে। তাঁরা বললেন, এটা তাদের ফেয়ার শেয়ার। টাকা ভাগাভাগির টানাপোড়নে ব্যাপকভাবে প্রচার হল এই তথ্য। ভিসি এবার বিরক্ত হয়ে তার ক্ষমতা দেখালেন, প্রচার মাধ্যমে সাক্ষাতকারে ছাত্রনেতাদের দায়ী করলেন। প্রচার এবং হৈ চৈ এর কারনে ৭০ বছরের ইতিহাসে ছাত্রলীগের সভাপতি সাধারণ সম্পাদক কে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অব্যাহতি দেয়া হল। কিন্তু সেলামি দাতা বহাল তবিয়তে ক্ষমতায় থেকে গেলেন।

কিন্তু ঘটনা তো এখানেই থেমে থাকে নি। প্রচার হতে থাকলো ভিসি’র নানা দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহারের কথা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকদের আন্দোলনের ইতিহাস অনেক পুরনো। সেই আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে উঠলো আবার। তাদের আন্দোলন দুর্নীতিমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। এ আন্দোলন করতে গিয়ে ছাত্র শিক্ষকরা দফায় দফায় হামলার স্বীকার হচ্ছেন সেখানে। যারা আন্দোলন করেন তারা জেনে শুনেই আন্দোলনে আসেন যে, হামলা নির্যাতন সহ্য করতে হবে। কিন্তু হামলাকারীরা ভাইস চ্যান্সেলরের অভিনন্দন পাবে, গণ অভ্যুত্থানের নায়কের স্বীকৃতি পাবে এটা বোধ হয় কেউ কল্পনাতেও আনেন নি। দেশে গনতন্ত্র, নির্বাচন এসব শব্দের অর্থ পালটে দেয়া হয়েছে এবার গণ অভ্যুত্থানের সংজ্ঞা কি পালটে দেয়া হল? এসব বলে একজন ভাইস চ্যান্সেলরের মর্যাদা কোথায় নামিয়ে আনলেন তিনি? যে শিক্ষাবিদদের কাছে ছাত্রদের অতীতের শিক্ষা আর ভবিষ্যৎ কর্তব্যের দিশা পাওয়ার কথা তারা কি শিক্ষা রেখে যাচ্ছেন বর্তমান প্রজন্মের কাছে? যে ছাত্র শিক্ষকরা মিলে আজ আন্দোলনকারী শিক্ষকদের পেটাচ্ছে তাঁরাই বা কি শিক্ষা নিয়ে যাচ্ছে? এ কোন প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে ক্ষমতার বলয়ে এবং প্রশাসনের প্রশ্রয়ে থেকে?

দুর্নীতিবাজ এই কথাটা যে একজন শিক্ষকের কাছে কত অপমানজনক হতে পারে তার একটি দৃষ্টান্ত আমার জীবনে আছে। রংপুর জিলা স্কুলে আমি তখন ক্লাস ফাইভের ছাত্র। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মাক্সুদ স্যার। শ্রদ্ধা সম্মান ভয় সব মিলেই তিনি ছিলেন আমাদের কাছে মহীরুহের মত ব্যক্তিত্ব। একদিন তাকে কয়েকজন উপরের ক্লাসের ছাত্র বলেছিল, আপনি ভর্তিতে দুর্নীতি করেছেন? অভিযোগ শুনে অফিসে তিনি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। তারপর নাকি ধীরে ধীরে ক্যাম্পাসের পিছনে তার বাড়ীতে চলে গিয়েছিলেন। পরদিন আমরা স্কুলে এসে শুনলাম, স্কুল ছুটি। হেড স্যার নিজের পিস্তলের গুলিতে আত্মহত্যা করেছেন।

বিদ্যালয়ের স্যার আত্মহত্যা করে বাঁচিয়েছিলেন আত্মমর্যাদা আর আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পদ আঁকড়ে থাকার জন্য আত্মমর্যাদা হারাচ্ছেন প্রতিদিন।

লেখক: রাজনীতিবীদ

মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪.কমের সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা এক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় আমাদের নেই।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ