জেল-হত্যা ছিল আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার মহাপরিকল্পনারই অংশ

প্রকাশ | ০৩ নভেম্বর ২০১৯, ১২:৫৯

৩ নভেম্বরের জেল হত্যাকাণ্ড বা ১৫ আগষ্ট পিতা হত্যাকাণ্ডের কথা কি করে যে লিখি! লিখতে গেলেই যে চোখে জল ভরে যায়! তবুও ৩ নভেম্বর বা ১৫ আগষ্ট যে আমাদের মাঝে বারবার ফিরে আসে। তাইতো তাদের স্মরনে এই লেখা ।

৫০-এর দশকে মুজিব তার অনেক বন্ধুদের বলতেন যে, “যদি ৫,০০০ হাজার মানুষ প্রাণ দিতে প্রস্তুত থাকে তাহলে আমি বাংলাদেশ স্বাধীন করতে পারবো।” বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল মুজিবের মনে পুষে রাখা বহুদিনের স্বপ্ন। বাঙ্গালীর মুক্তির লক্ষ্যে মুজিব ধাপে ধাপে নেতৃত্ব দিয়ে বাঙ্গালীদের যোদ্ধা হিসাবে প্রস্তুত করতে লাগলেন। আর শেখ মুজিবের সেই স্বপ্নপূরণে এগিয়ে এলেন তার অতি বিশ্বস্ত চার সহযোদ্ধা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামান। যারা ছিলেন মুজিবের লালিত স্বপ্নের গভীর বিশ্বাসী আর মোস্তাক গং কখনই স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন না। তাই স্বাধীনতার পরও স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিগুলির সহায়তায় জাতির পিতাসহ জাতীয় চার নেতাকে হত্যার জন্য সাম্প্রদায়িক মোস্তাক গং পিছু নেয়।

দীর্ঘ সংগ্রামের পর ৩০ লক্ষ শহিদের বিনিময়ে শেখ মুজিব তার বহুদিনের পুষে রাখা স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণ করলেন বটে কিন্তু তিনি মোস্তাক গংদের হাতে ১৫ আগষ্ট নিজের জীবনটাও দিলেন। ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জাতীয় ৪ নেতাকে তাদের দলে ভিড়াতে না পেরে ঘাতকরা নিজেদের নিরাপদ নিশ্চিত মনে করতে পারেনি। তারা নিশ্চিত ছিল জাতিয় ৪ নেতার নেতৃত্বে হয়তো আবারও আওয়ামী লীগ ঘুরে দাড়াতে পারে, তাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে চিরতরে বিলীন করার উদ্দেশ্যেই ৩ নভেম্বরে জেল খানায় তখনকার আইজি প্রিজন নুরুজ্জামান ৫ জন সেনা কর্মকর্তাকে সাথে নিয়ে সেই রাতে কারাগারে প্রবেশ করেন৷ এরপর টেলিফোনে খন্দকার মোশতাক ৪ নেতার নাম জানিয়ে দেন৷ তারপর ৪ নেতাদের নিউ সেলে জড়ো করে ঘাতকরা ব্রাশ ফায়ারে শেখ মুজিবের চার নক্ষত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করে জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেয়৷ তখনকার আইজি প্রিজন নুরুজ্জামান জানতেন যে ৪ নেতাকে কারাগারের অভ্যন্তরে হত্যা করা হবে৷ কিন্তু কারাগারের আর কোন কর্মকর্তা ভাবতেই পারেননি যে ওই রাতে এমন পৈশাচিক হত্যাকান্ড ঘটবে৷

পরদিন দুপুরের দিকে পুলিশের মহাপরিদর্শক টেলিফোনে বঙ্গভবনে জেনারেল খলিলকে জানান, গত রাতে সেনাবাহিনীর লোকজন জেলে ঢুকে আওয়ামী লীগের চার নেতাকে হত্যা করেছে। জেনারেল খলিল রাষ্ট্রপতির সচিব মাহবুব আলম চাষীদের খবরটি দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে জানাতে বলেন। চাষী রাষ্ট্রপতিকে সংবাদ দিয়ে তাঁর কামরা থেকে বেরিয়ে এসে বলেন, প্রেসিডেন্ট ঘটনা জানেন। তার অর্থ মোস্তাক ৪ নেতা হত্যার জন্য দায়ী। পরিস্তিতি তখন খুব উত্তপ্ত থাকায় জেনারেল খলিল খবরটি আর কাউকে না জানিয়ে চেপে যান। তাঁর কথা হল, “আমি ডিফেন্স স্টাফ প্রধান। আমার দায়িত্ব প্রেসিডেন্টকে জানানো, আমি তাই করেছিলাম, অন্যদের বলতে যাব কেন?”

পরদিন সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে মোস্তাকের মন্ত্রিসভার বৈঠকে নানারকম গোল বাঁধল। কর্ণেল শাফায়াত ৪ নভেম্বর সকাল ১০ টায় জেল হত্যাকাণ্ডের সংবাদ পান এবং সন্ধ্যায় ৬ টায় বঙ্গভবনে যান। সেখানে মোস্তাককে নিয়ে কেবিনেট কক্ষে ঢুকেই দেখলেন জেনারেল খলিল বসে আছেন। জেঃ খলিলকে দেখে শাফায়াত ক্ষোভের সংগে বললেন, “ আপনি চীফ অব ডিফেন্স স্টাফ, প্রায় ৪০ ঘন্টা হয়ে গেছে জেলখানায় ৪ নেতাদের হত্যা করা হয়েছে, তারও ২০ ঘন্টা দেশ ত্যাগ করেছে খুনিরা, আপনি এসবই জানেন কিন্তু আমাদের বলেননি কিছুই। এই ডিগ্রেসফুল আচারনের জন্য আমি আপনাকে আ্যারেস্ট করতে বাধ্য হচ্ছি।” খলিল নিশ্চুপ। এরপর সাফায়াত মোস্তাককে বললেন, “স্যার আপনি আর এপদে থাকতে পারবেন না। কারণ আপনি একজন খুনি। জাতির পিতাকে হত্যা করে আপনি অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছেন। এসব অপরাধের জন্য বাংলার জনগম আপনার বিচার করবে।”

এভাবেই স্বাধীনতা বিরোধীরা ১৫ আগষ্ট আর ৩ নভেম্বর নির্মম হত্যাকান্ড ঘটিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশকে সম্পূর্নরুপে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উল্টাদিকে প্রবাহিত করে। আজ দীর্ঘ চার দশক পর বাংলাদেশ আবারও মুক্তিযুদ্ধের চেতায় ফিরে যাচ্ছে। হত্যাকাণ্ডগুলির বিচার হচ্ছে। মোস্তাক গং আর নেই তবে তাদের অনুসারিরও অভাব নেই। তাই আজ সেই বেদনাদায়ক ৩ রা নভেম্বরে আমরা সকলে তাদের বিরুদ্ধ রুখে দাড়াই এবং শেখ মুজিব ও চার নেতার আত্মার মাগফেরাত কামনা করে, স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার শপৎ নেই।