না হই পরিচয়হীন কোনো ভেড়ার পাল

প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০১৯, ১১:১৪

কয়েকদিন আগে উগান্ডার স্বৈরশাসন নিয়ে একজনের সাথে আলোচনা হচ্ছিলো। ফোনের ওপাশে যিনি ছিলেন, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এর শেষ কোথায়? আমি তাকে পৃথিবীর নানা দেশের, নানা সময়ের স্বৈরশাসকদের ইতিহাসের কথা শুনালাম। কতো শক্ত শক্ত স্বৈরশাসক জনতার প্রতিরোধে স্রোতের মতো ভেসে গেছে, সেই সব গল্প বললাম। সবশেষে বললাম, উগান্ডার এই স্বৈরশাসন কবে শেষ হবে, এই স্বৈরশাসক কবে বিদায় নেবে, সেটা আমি সঠিকভাবে জানি না। কিন্তু, নিশ্চিতভাবে এটা জানি, একদিন তা বিদায় নেবেই। আন্দোলন কখনো বলে কয়ে হয় না। মানুষ প্রতিবাদ করে প্রতিনিয়ত, সেগুলোকে দমনও করা হয় প্রবল আক্রোশে। কিন্তু, এর মাঝেই বনভূমি উত্তপ্ত হতে থাকে সবার অজান্তে। তারপর একদিন কোনো এক স্ফূলিঙ্গ থেকে দাবানল শুরু হয়ে যায়। সেই দাবানল পুড়িয়ে দেয় দেবালয়ও।

রোমানিয়ার স্বৈরশাসক চসেস্কু জনসমাবেশে ভাষণ দেওয়ার মুহুর্তে জনতার বিক্ষোভ শুরু হয়েছিলো আচমকা। জনসভা ছেড়ে চসেস্কুকে পালাতে হয়েছিলো সেই সময়ে। এর মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই চসেস্কু ধরা পড়ে। ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয় তাকে। আমাদের দেশেও এরশাদ এক সময় বিরাট এক স্বৈরাচার ছিলো। তার বিরুদ্ধে অসংখ্য আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছে। সেই সব আন্দোলন কোনোটা শেষ হয়েছে শুরুতেই, আবার কোনোটা তুঙ্গে উঠেও তরঙ্গস্রোতে হারিয়েছে দিশা। শেষে একদিন ডা. মিলন নিহত হবার পরেই এই আন্দোলন চরমরূপ ধারণ করে এবং পরম সাফল্যটা আসে সেখান থেকেই।

আমার এই বিশাল বক্তব্যের পরে ওপাশ থেকে শুধু একটা কথাই বলা হলো, ‘উগান্ডার এই স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনটা করবে কে? ওখানকার লোকজনতো সব ভেড়ার পাল হয়ে গিয়েছে।’

অন্যপক্ষের এই বক্তব্যে থেমে যাই আমি। তাইতো! ভেড়ার পাল দিয়ে আন্দোলন হবে কী করে? আন্দোলনই বা বলি কেনো, এদের দিয়ে কোন কাজটাই বা হবে বলেন?

'ভেড়ার পাল' বাংলা ভাষার একটা প্রবাদ। এর মানে হচ্ছে না বুঝে সবাই দলে বলে একদিকে থাকা বাচলা। ভেড়ারা যখন যায়, তখন এরা একজন আরেকজনকে অনুসরণ করে কোনো রকমের চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই। দল থেকে বিচ্যুত হতে সাধারণত দেখা যায় না কোনো ভেড়াকে। ভেড়ার এই বোধবুদ্ধিহীন, আনুগত্যময়, কৌতুহলশূন্য আচরণের কারণেই ভেড়ার পাল শব্দটার জন্ম হয়েছে।

শুনতে আশ্চর্য হলেও, এটা সত্যি যে, ভেড়ার এই নির্বিরোধী ও নিস্তরঙ্গ আচরণ, নির্বিকার, নিরস এবং নীরবমনোভাবের পিছনে মানুষের বেশ বড়সড় একটা দায় রয়েছে। আদিম কালে প্রকৃতিতে ভেড়া যখন বুনো জন্তু হিসাবে ঘোরাফেরা করতো, তখন সব ভেড়াদের এমন অনুগত এবং অনুসরণকামী আচরণ ছিলো না। কেউ বেশ দুর্বিনীত ছিলো তখন, কেউ ছিলো দুর্দান্ত কৌতূহলী, কেউ ছিলো রোমাঞ্চপ্রিয়, কেউ রোম্যান্টিক, আবার কেউ বা কলহপ্রবন। কারো দল বেঁধে চলতে ভালো লাগতো, কেউ থাকতে চাইতো একা। কেউ কেউ ছিলো প্রেমিকপ্রবর। রমণী সান্নিধ্যে সময় কাটতো তাদের। কেউ বা আবার ছিলো প্রকৃতিপ্রেমিক। সবার থেকে আলাদা হয়ে এদিক ওদিক গিয়ে প্রকৃতিকে ভালোভাবে বোঝার জন্য অধীর আগ্রহ দেখাতো। ভেড়াদের পোষা প্রাণী বানাতে গিয়ে তাদের আচরণের এই নানা বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যকে অত্যন্ত পরিকল্পিত উপায়ে পাকাপাকিভাবে পরিবর্তন করে ফেলেছে মানুষ।

নোয়াহ হারারি তার “স্যাপিয়েন্স: এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব হিউম্যানকাইন্ড" বইতে এর একটা চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। মানুষ যখন যাযাবর জীবন যাপন করতো, খাদ্যের জন্য শিকারের উপর নির্ভর করতো, তখন থেকেই ভেড়ার উপর পরিবর্তন নেমে আসা শুরু হয়। এর সূত্রপাত ঘটে নির্বাচিত শিকার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। শুরুর দিকে মানুষ যা তার শক্তি এবং সক্ষমতার আওতায়, তাই শিকার করতো। ধীরে ধীরে তারা বুঝে গেলো এভাবে শিকার করলে একটা পর্যায়ে গিয়ে শিকার করা প্রাণীরসংখ্যা কমে যাবে আশংকাজনকভাবে। ফলে, খাদ্যের অভাব দেখা দেবে। এ কারণেই নির্বাচিত শিকারের ধারণা মাথায় আসে মানুষের। মানুষ তার অভিজ্ঞতা দিয়ে ততো দিনে জেনে গেছে, পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ ভেড়া, দুর্বল স্বাস্থ্যের ভেড়া এবং অসুস্থ ভেড়াদের শিকার করাটাই তাদের জন্য বেশি সুবিধাজনক এবং লাভজনক। শিকারের এলাকায় দীর্ঘকাল ভেড়ার পাল যাতে টিকে থাকে, সে কারণে তারা মাদী ভেড়া এবং বাচ্চা ভেড়াদের শিকার করতো না, বরং এদেরকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতো। শুধু তাই নয়, এদেরকে অন্য হিংস্র প্রাণী থেকেও তারা রক্ষা করার সর্বাত্মক চেষ্টা করতো। সিংহ, নেকড়ে, হায়েনাদের মতো শিকারি প্রাণী এবং অন্য দলের মানুষরা যারা তাদের এলাকায় শিকার করতে অনুপ্রবেশ করতো, তাদের দূরে তাড়িয়ে দিতো তারা। বিস্তীর্ণ এলাকায় ভেড়াদের রক্ষা করা এবং নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর বলে তারা এগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে এসেসংকীর্ণ কোনো এলাকায় জড়ো করতো।

ভেড়ার পালকে নিয়ন্ত্রিত এলাকার মধ্যে এনেও মানুষ ক্ষান্ত দেয়নি। এই ভেড়াদের মধ্যে থেকেও যাচাই-বাছাই করা শুরু করে মানুষ। নিজেদের প্রয়োজনের জন্য সহায়ক যেগুলো, সেগুলোকেই শুধু তারা টিকে থাকতে সহযোগিতা করে, বাকিদের বিনাশে মেতে ওঠে তারা। যে ভেড়াটা সবচেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক, সবচেয়ে বেশি প্রতিরোধ দেখানোর চেষ্টা করে, শিং বাগিয়ে গুঁতো দিতে চায়, সেটাকে সবার আগে জবাই করে দিতো তারা। যেটার গায়ে বেশি মাংস নেই, সেটাকেও দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হতো দ্রুত। এর পিছনে সময় ব্যয় করার কোনো মানে হয় না। আর যেটা বেশি কৌতূহলী, দল ছেড়ে এদিক ওদিক চলে যায় কৌতূহল নিবারণ করতে, তাকেও বলি হতে হতো সহসাই। এরকম কৌতূহলী ধরনে ভেড়া, ভেড়া পালকদের মোটেও পছন্দের কিছু নয়। এগুলোকে দলের মাঝে রাখতে অতিরিক্ত পরিশ্রম করা লাগে। শুধু তাই নয়, এদের দেখাদেখি অন্যগুলোও কৌতূহলী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতি প্রজন্মে এরকম নির্বাচিত বিনাশের মাধ্যমে সাহসী, শক্তিশালী, প্রতিরোধপ্রবন ও কৌতুহলী ভেড়াদের সরিয়ে দেওয়া হতে থাকে একের পর এক। থেকে যেতে থাকে বোকাসোকা ধরনের মাংসল ভেড়াগুলো। এরা প্রতি প্রজন্মে মাংসল থেকে আরো মাংসল হয়ে ওঠে মানুষের প্রয়োজনে। বুদ্ধিদীপ্ত ভেড়াগুলো চলে গিয়ে থেকে যেতে থাকে চিন্তাশূন্য নির্বোধগুলো। বাইরের জগত-সংসার সম্পর্কে এদের কোনো অযাচিত কৌতূহল থাকে না। একটা ভেড়া যেদিকে রওনা দেয় বা ভেড়া পালক যেদিকে যেতে বলে এই বোধলুপ্ত, চিন্তাহীন প্রাণীগুলো গায়ের সাথে গা মিশিয়ে সেইদিকেই রওনা দেয়।

আমাদের দেশের সর্বক্ষেত্রেই এখন এই ভেড়ার পালের যুগ চলছে। দিনে দিনে বুদ্ধিমান, সাহসী এবং শক্তিধর মানুষগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। সত্যকথন বলা অমিত সম্ভাবনার মানুষদের ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে অশান্ত সাগরে। যারা প্রতিরোধ করতে পারতো, গলার আওয়াজ ছাড়তে পারো নুরুলদীনের মতো, তাদের উপর নির্মম আক্রমণ এসেছে সবার আগে। যারা লড়তে পারতো, তাদের রক্তে লাল করে দেওয়া হয়েছে সবুজ ভূখণ্ড। বাকি যারা আছে, অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে তারা ওই ভেড়ার পালই। চিন্তাহীন, বোধবুদ্ধিহীন, বিচার-বিবেচনারহিত, নির্বিরোধী এবং নিস্তেজ একটা অংশ মাত্র। এদের দিয়ে আর যাই হোক নতুন কিছু হবে না, হবে না সমাজের কোনো পরিবর্তনই।

আসুন, নিজেদের বিদ্যাবুদ্ধিকে কাজে লাগাই আমরা, নিজের বিবেচনা শক্তিকে ব্যবহার করি বিপুলভাবে, পাল্টা প্রশ্ন করতে শিখি যে কোনো কিছুরই। মেনে না নেই কোনো অথরিটিকে বিনা প্রশ্নে। যুক্তি দিয়ে ছিন্ন করি সমস্ত মায়াজাল। না হই পরিচয়হীন কোনো ভেড়ার পাল।

লেখক: প্রবাসী, প্রাক্তন শিক্ষক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ