চিন্তার স্বচ্ছতা বনাম বুদ্ধিবৃত্তিক পক্ষপাত

প্রকাশ : ১১ অক্টোবর ২০১৯, ২১:২৪

অতি সম্প্রতি খুবই দুঃখজনক একটা ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। যেটা নিয়ে এখনো উত্তাল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের একজন ছাত্র আবরার ফাহাদকে ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কিছু নেতা ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেওয়ার 'অপরাধে' ছয় ঘণ্টা ধরে পিটিয়ে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের যে কক্ষে আবরার থাকতো, সেই কক্ষের পড়ার টেবিলে থাকা বইয়ের একটা ছবি পত্রিকার পাতাতে এসেছে। সেই ছবি দেখলে বোঝা যায় আবরার একজন বইপড়ুয়া ছেলে ছিলো। সেখানে যে সব বই আছে সেগুলো হচ্ছে রবীন্দ্র রচনাবলী, সাধারণ জ্ঞান চর্চার কিছু বই, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র ,শাহাদুজ্জামানের লেখা ক্রাচের কর্নেল, হুমায়ূন আহমেদ এর মিসির আলী সমগ্র, শুভ্র সমগ্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি, সমরেশ মজুমদারের সাতহাকন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী, অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমানের লেখা বঙ্গবন্ধু: মহাকালের মহানায়ক, পাউলো কোয়েলহোর দ্য আলকেমিস্ট এবং রলফ ডুবেলির দ্য আর্ট অব থিংকিং ক্লিয়ারলি।

এই শেষ বইটা, অর্থাৎ রলফ ডুবেলির 'দ্য আর্ট অব থিংকিং ক্লিয়ারলি' বইটা আমার নিজেরও খুব পছন্দের একটা বই। স্বচ্ছভাবে চিন্তা করার যে সক্ষমতা, সেটা থেকে বাঙালিরা বেশ খানিকটা দূরে। যুক্তিতর্কের সময়ে নানা ধরনের আবেগে ভুগি আমরা, নিজস্ব পূর্ব বিশ্বাসের ফলে তথ্য প্রমাণ বিচার না করেই আগে থেকে নেওয়া সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে আমরা তর্কে লিপ্তহই। সঠিক যুক্তির বদলে গলার জোরে বিতর্কে জিততে চাই।

“হোয়েন টু রব এ ব্যাংক” নামে স্টিভেন লেভিট এবং স্টিফেন ডাবনারের একটা বই আছে। এই বইয়ের ভূমিকাতে তাঁরা লিখেছেন, “প্রতিটা মা-বাবাই ভাবে তাদের সন্তান হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শিশু। এটা আমাদের মস্তিষ্কে এমনভাবে গেঁথে থাকে যে দিনের পর দিন সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তাকে অপরূপ সুন্দর মনে হতে থাকে। অন্যের বাচ্চার মুখে খাবার লেগে থাকলে, নাকে সর্দি ঝরলে, দেখতে কেমন গা গুলিয়ে আসে, কিন্তু নিজের বাচ্চার ক্ষেত্রে একই জিনিস দারুণ সৌন্দর্যময় বলে মনে হয়।”

মানুষের এই যে দেখার কিংবা ভাবনার ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব, এটাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় কগনিটিভ বায়াসনেস বলে। বাংলায় আমরা একে মস্তিষ্কজনিত পক্ষপাত বা বুদ্ধিবৃত্তিক পক্ষপাত বলতে পারি। মনোবিজ্ঞানে এই ধরনের পক্ষপাতের বিশাল একটা তালিকা রয়েছে। সবগুলো নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব নয় এখানে। বাছাই করা দুই একটা নিয়ে কথা বলছি এখানে।

আমার স্ত্রীর ডাক নাম আন্না। আন্না আমার সহপাঠী ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে। বাংলাদেশে থাকার সময়ে আন্নার সাথে মাঝে মাঝে দোকানে যাওয়া লাগতো। গাওছিয়াতে শাড়ি কিনতে গেলে দেখা যেতো দোকানি যে শাড়ির দাম চাচ্ছে তিনি হাজার টাকা, আন্না সেটাকে পাঁচশো বলে দোকান ছেড়ে চলে যেতে থাকতো। দোকানিরা নানা ধরনের অপমানসূচক কথা বলতো আমরা দোকান থেকে বের হয়ে যাবার সময়ে। আমার নাক কান সব লাল হয়ে যেতো বিব্রতকর এই অবস্থাতে। কখনো কখনো মেজাজও খারাপ হয়ে উঠতো আন্নার উপরে এরকম অদ্ভুত আচরণ করার জন্য। কিন্তু, ও নির্বিকারভাবে হেঁটে বাইরে চলে যেতে থাকতো। দোকান থেকে বের হয়ে যাবার মুহূর্তে শুনতাম দোকানি বলছে, “আপা, দাম আরেকটু বাড়িয়ে দেন।” সে একইভাবে এগিয়ে যেতে যেতে বলতো, ওই দামে দিলে দেন, নাহলে নাই।” এবং আমি অবাক হয়ে দেখতাম সত্যি সত্যি দোকান কর্মচারী ওই দামেই শাড়িটা তাকে দিয়ে দিয়েছে।

বাংলাদেশে দোকানিরা যে যে কোনো জিনিসের উচ্চমূল্য চায়, এবং কাস্টমারকে বাধ্য করে একটা দাম বলতে, এটাকে বলে এঙ্কোরিং বায়াস। সে যখন পাঁচশো টাকা দামের একটা শাড়ির দাম চাইছে তিন হাজার টাকা, ওই তিন হাজার টাকাটাই কাস্টমারের কানের মধ্যে গেঁথে গিয়েছে। এখন কাস্টমার এখান থেকে আর কতদূর নামবে? দুই হাজার কিংবা বড়জোর পনেরোশোতে। কিন্তু, সে যদি দাম চাইতো পনেরো শো বা এক হাজার, অতি অবশ্যম্ভাবীভাবে কাস্টমার সেই একই শাড়ির দরদাম করতে গিয়ে অনেক কম দাম অফার করতো। এই পরীক্ষাটা খুব সহজেই করতে পারেন। কাউকে যদি ৯x৮x৭x৬x৫x৪x৩x২x১ এর ফলাফল অনুমান করতে বলেন তবে সে এর উত্তর যা দেবে, তার বদলে তাকে যদি ১x২x৩x৪x৫x৬x৭x৮x৯ এর ফলাফল বলতে বলেন তবে অতি অবশ্যই তা আগের উত্তরের চেয়ে অনেক কম হবে। এর কারণটা খুব সহজ। প্রথম ক্ষেত্রে লোকে ৯কে ৮ দিয়ে গুণ করে ৭২ পাবে, অন্যদিকে ১ এর সাথে ২কে গুণ করে মাত্র ২ পাবে। ফলে, তার মস্তিষ্ক প্রথমটার ক্ষেত্রে অনেক বড় সংখ্যাকে অনুমান করবে, পরেরটার ক্ষেত্রে কম। অথচ, দুটোর ফল আসলে সমান। আপনি একই প্রশ্ন করেছেন, কিন্তু এঙ্কোরিং বায়াসের কারণে উত্তর আসছে ভিন্ন।

ইনগ্রুপ বায়াস বলে আরেকটা বায়াস আছে। এই বায়াসের ক্ষেত্রে দেখা যায় আপনি যে দলের সদস্য সেই দলের শুধুমাত্র ইতিবাচক দিকটাই আপনার চোখে পড়ে। আর বিপক্ষ বা প্রতিপক্ষ দলের ক্ষেত্রে সবকিছুই নেতিবাচক হিসাবে আপনার চোখে ধরা দেয়। ইনগ্রুপ বায়াস মানুষের মধ্যে এসেছে আদিকাল থেকে। আমাদের পূর্বপুরুষরা ছোট ছোট দলে অবস্থান করতো। প্রতিনিয়ত তাদের অন্যদলের সাথে দ্বন্দ্বে জড়াতে হতো। অন্যদলের সদস্যদেরকে তারা সবসময়ই আলাদা চোখে দেখতো, সন্দেহ করতো এবং সম্ভাব্য ক্ষতিকারক হিসাবে বিবেচনা করতো। ফলে, আমরা এবং তারা এই আলাদা করণের মাধ্যমে নিজের দলকে সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে বাঁচাতো তারা। এটাই বিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে এসে গিয়েছে। এর প্রধান সমস্যা হচ্ছে, এতে করে আমরা যারা একই দলের, তাদেরকে ফেভার করার এবং যারা ভিন্ন দলের, তাদেরকে রিজেক্ট করার প্রবণতা তৈরি হয়। নিজের দলের কেউ দোষ করলে, সেটাকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করা হয় কিংবা দলের মধ্যে এটা বিচ্ছিন্ন আচরণ বলে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করা হয়। সেই একই কাজ অন্য দলের কেউ করলে তখন সেটাই হয় সেই দলের মূল বৈশিষ্ট্য। নিজের দলের ভালো কাজগুলোই বেশি বেশি চোখে পড়ে, এর বিপরীতে বিপক্ষের সব কাজকেই নেতিবাচক বলে মনে হয়, কিংবা ইতিবাচক কিছু থাকলেও সেটাকে উপেক্ষা করা হয়।

ইনগ্রুপ বায়াসের সবচেয়ে ভালো উদাহরণ আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। স্পষ্ট করে বললে বলবো আওয়ামী লীগ আর বিএনপি। এরা দু’পক্ষই নিজেদের দলের ব্যাপারে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করে, বিপক্ষ সম্পর্কে প্রবল নেতিবাচক ধারণা তাদের। নিজেদের করা অপকর্ম তাদের চোখে পড়ে না, যেগুলো ইতিবাচক সাফল্য আছে, সেগুলোতেই মূল ফোকাস তাদের। এক দল আরেক দলের প্রতি প্রচণ্ড রকমের বৈরিতা পোষণ করে। সেই বৈরিতা এমনই তীব্র যে এর জন্য খুনোখুনি করে ফেলতেও তাদের সামান্যতম বাধে না। প্রতিটা দলের সদস্যরাই অন্য দলকে দোষারোপ করছে এবং নিজেদের পক্ষে সাফাই গেয়ে চলেছে। অদ্ভুত রকমের ব্লাইন্ড স্পট রয়েছে এর সদস্যদের। সেই ব্লাইন্ড স্পটের কারণে নিজেদের কোনো ভুলত্রুটি এদের চোখে পড়ে না।

ব্যান্ডওয়াগন বায়াস নামের একটা বায়াসের কথাও বলা যায়। এই বায়াসের ক্ষেত্রে দেখা যায়, বেশিরভাগ লোক যে দিকে যায়, অন্যেরাও সেদিকেই ছোটে। একটা উদাহরণ দেই। ধরেন, আপনার অফিসে কোনো একটা বিষয়ে মতামত চাওয়া হচ্ছে। আপনার সহকর্মীদের সবাই একমত। আপনার এক্ষেত্রে ভিন্নমত রয়েছে। এরকম ক্ষেত্রে আপনার নিজের মতামত চেপে সহকর্মীদের সাথে একমত হবার প্রবণতায় বেশি দেখা দেবে আপনার মধ্যে।

আপিল টু পপুলারিটি বলেও একটা বায়াসনেস আছে। এটা সম্পর্কে আলোচনা না করলেই নয়। কারণ, এই কুযুক্তিটা খুব বেশি পরিমাণে ফেস করতে হয় নানা সময়ে। ধরুন, আপনি গোলাম আযমের সমালোচনা করলেন। জামাতে ইসলামির লোকেরা এসে বলবে, উনি যদি একাত্তরে এতো খারাপ কাজই করতেন, তাহলে তাঁর জানাজায় এতো লোক হলো কেনো? কিংবা যদি বললেন, এরশাদ একটা লম্পট, বদমাশ, দুর্নীতিবাজ এবং স্বৈরাচার ছিলো। কেউ হয়তো লাফ দিয়ে এসে বলে বসবে, তাহলে এতো লোক তাঁর জন্য কাঁদছে কেনো ক্ষমতায় দীর্ঘদিন না থাকার পরেও?

এই যে কাউকে বা কোনো ধারণাকে জনপ্রিয় দেখিয়ে সেটা সঠিক, এই যুক্তি দেখানো, এটা ফ্যালাসি ছাড়া আর কিছুই নয়। এই ফ্যালাসির মর্মার্থ হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতই সবসময় সঠিক, যেহেতু বেশিরভাগ মানুষ সেটাতে বিশ্বাস করে।

আসলেই কি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত কিংবা কর্মকাণ্ড সবসময় ভালো? নিশ্চয় না। কারণ হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ যে সবসময় সুচিন্তিতভাবে মতামত প্রয়াস করে, সুস্থিরভাবে কাজ করে, তা কিন্তু নয়। একজনের দেখাদেখি আরেকজন সেই কাজ করে। কৈ মাছ যেমন কোথায় যাচ্ছে তা দেখে না, ঝাঁক যেদিকে যাচ্ছে, সেদিকেই এগিয়ে যায়, মানুষও অনেকটা সেরকম কাজই করে। কাজেই, দলবদ্ধভাবে কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠভাবে মানুষ কোনো কিছুকে সঠিক ভাবলে কিংবা একত্রে করলেই সেই কাজটা সেরা হয়ে যায় না। বরং অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় তারা আসলে চরম বোকার মতো চিন্তা করছে কিংবা কাজ করছে। হয়তো একজন বোকামিটা শুরু করেছে, আরেকজন তারা দেখাদেখি সেই বোকামিকে অনুসরণ করছে। আবার এদের দেখাদেখি আরো লোক জড়ো হচ্ছে সেই বোকামিতে অংশ নিতে।

হুমায়ুন আহমেদের ‘চোর’ নামের একটা টেলিভিশন নাটক আছে। সেখানে দেখা যায় এক চোর দোকানদারের ক্যাশবাক্স থেকে টাকা হাতিয়ে নেয় মানুষের এই অভ্যাসকে দুর্দান্তভাবে ব্যবহার করে। চোরটা হঠাৎ করেই আকাশের দিকে তাকায়। তার দেখাদেখি দোকানদারও আকাশের দিকে তাকায়। আর এই সুযোগে চোর ক্যাশবাক্স হাতিয়ে নেয়।

শুধু এই দোকানদারের ক্ষেত্রেই নয়, আপনি, আমি, আমাদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটবে। আকাশের দিকে কিছু মানুষকে চেয়ে থাকতে দেখলে আমরাও আমাদের দৃষ্টি অজান্তেই আকাশের দিকে নিয়ে যাবো। আরেকটা উদাহরণ দেই। ধরুন, কোনো একটা অনুষ্ঠানে কেউ বক্তৃতা করছে। এর মাঝে হঠাৎ করে কেউ তালি শুরু করলে তারা দেখাদেখি আরো অনেকেই তালি দেওয়া শুরু করে। এই যে অন্যের দেখাদেখি মানুষের কাজ করার প্রবণতা এটা এসেছে তার হার্ড ইনস্টিংক্ট (Herd Instinct) বা দলবদ্ধতার অনুভূতি থেকে।

মানুষ যখন শিকারি-সংগ্রাহক যুগে বসবাস করতো, তখন তার পক্ষে এককভাবে টিকে থাকা সম্ভব ছিলো না। যুথবদ্ধতাই ছিলো তখন টিকে থাকার একমাত্র উপায়। ধরুন, একটা দল কোথাও যাচ্ছে। হুট করে দলের সামনে থাকা কিছু লোক বাঘ আসছে বলে চিৎকার করে দৌড় দিলো। পিছনে যারা আছে, তারা হয়তো বাঘটাকে দেখেও নি, আদৌ সামনে বাঘ আছে কিনা জানেও না। এই পরিস্থিতিতে তারা কী করবে? সহজ কাজ হচ্ছে দলের পিছনে দৌড় দেওয়া। এটাই সারভাইভাল স্ট্রাটেজি। কেউ যদি এই কাজ না করে, তবে তার জিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এবং আসলেই তাই গিয়েছে। ঝাঁকের কৈয়ের বাইরের কৈ টেকেনি বেশিদিন। এই যে কিছু চিন্তা-ভাবনা না করে অন্যকে অনুসরণ করা, এটা মানুষের মধ্যে এসে গিয়েছে বিবর্তনীয় প্রক্রিয়ায়। শুধু যে এসেছে, তাই নয়, তার ভিতরে গ্রথিত হয়ে আছে বেশ গভীরভাবে।

পঞ্চাশের দশকে মনোবিজ্ঞানী সলোমন আশ একটা খুব সহজ ধরনের পরীক্ষা করেছিলেন। সেই পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছিলেন কীভাবে পিয়ার প্রেশার মানুষের সাধারণ বুদ্ধিমত্তাকে পাল্টে দেয়। তিনি কাগজের উপরে একটা লাইন টানেন। এর পাশে আরো তিনটা লাইন আঁকেন তিনি। এদের একটা প্রথম লাইনের তুলনায় ছোট, একটা বড় আর আরেকটা সমান। এদের তিনি নাম্বারিং করে এক, দুই এবং তিন হিসাবে। তিনি দেখেন কোনো একজন লোককে যদি এককভাবে ডেকে নিয়ে এই লাইনগুলো দেখিয়ে বলা হয় কোন দুটো লাইন সমান, কেউই সঠিক উত্তর দিতে ভুল করেন না। কিন্তু, গোলমাল বাঁধে অন্য একটা কাজ করলে। তিনি পাঁচজন অভিনেতাকে নিয়ে আসেন উত্তরদাতার আগে। সেই পাঁচজনই উত্তরদাতার সামনে ভুল উত্তর দেয়। এই পাঁচজনের ভুল উত্তরে প্রভাবিত হয়ে যায় পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ব্যক্তি। প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনই পিয়ার প্রেশারে পড়ে অভিনেতা পাঁচজনের দেওয়া ভুল উত্তর বেছে নেয়।

১৯৪৩ সালে নাজি প্রচারণা মন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলস এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতা দেন। সেখানে তিনি প্রবল উত্তেজিতভাবে জনতাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনারা কি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ চান? প্রয়োজন হলে এর চেয়েও বড় যুদ্ধ করতে কি আপনারা প্রস্তুত। জনতা গগনবিদারী কণ্ঠে যুদ্ধের পক্ষে রায় দেয়। অথচ, এদেরকে যদি আলাদাভাবে কিংবা নাম প্রকাশ করা হবে না এই শর্তে মতামত দিতে বলা হতো, এদের কেউ-ই হয়তো যুদ্ধ চাইতো না।

এই যে ঝাঁকের কৈ হবার প্রবণতা, এর ক্ষতিকর দিক কী? প্রচুর। মাঝে মাঝে দেখবেন স্টক মার্কেট ধ্বসে পড়ে, অদ্ভুত সব গুজবে বিশ্বাস করে লোকে, ধর্মীয় উন্মত্ত আচরণ করে, দলবেঁধে পচাপুকুর দেখতে যায়, পিরের দেওয়া পানিপড়া বা ডিমপড়া খায়। কারণ সবাই সেগুলো করছে, কাজেই তাকেও তা করতে হবে।। আবার, এগুলোর চেয়েও ভয়ংকর কোনো ঘটনাও ঘটতে পারে। যেমন ধরুন রেণুর কথা।

সাদাসিধে ধরনের নিরীহ এই মেয়েটা তার বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করতে গিয়েছিলো। দাঁড়িয়ে ছিলো স্কুল গেটের বাইরে। হয়তো একজন বা দুইজন মানুষ ছড়িয়ে দিয়েছে এই বলে যে সে একজন ছেলেধরা, একজন বা দুইজন মানুষ তাকে মারা শুরু করেছে শুরুতে। এদের দেখাদেখি বাকিরাও উন্মত্তের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে অসহায় মেয়েটার উপর। এই লোকগুলোর এককভাবে হয়তো মানুষ খুব করার সামর্থ্য নেই, কিন্তু ঝাঁকের কৈ হিসাবে সে বিশাল এক শক্তির অংশ। এদের প্রবল দাপটে পিষ্ট হয়ে যায় তাই রেণুর বুক। পাঁজরের হাড় ভেঙে হৃৎপিণ্ডে গিয়ে বিদ্ধ হয় তা।

কাজেই, কোনো কিছু জনপ্রিয় হলে বা অনেক লোকে কোনো একটা বিশ্বাসকে বিশ্বাস করে বলে, বা বহু লোকে কোনো একটা কাজটা করে বলে, বা অসংখ্য লোক কোনো কিছুকে ভালো বললেই সেটা ভালো হয়ে যায় না। সমারসেট মম যেমন বলেছেন, “ইফ ফিফটি মিলিয়ন পিপল সে সামথিং ফুলিশ, ইট ইজ স্টিল ফুলিশ।” এ’রকম পরিস্থিতিতে অ্যাপিল টু পপুলারিটিকে যতো বেশি উপেক্ষা করতে পারবেন, ততোই তা মঙ্গলজনক।

এই ধরনের কগনিটিভ বায়াসনেস নিয়েই রলফ ডুবেলি তাঁর এই বই দ্য আর্ট অব থিংকিং ক্লিয়ারলি বইটা লিখেছেন। সারা জীবন ধরে তিনি যে সব বায়াসনেস ফেস করেছেন, সেগুলোকে টুকে টুকে রেখেছেন তিনি। তারপর এক সময় সেগুলোকে একত্রিত করে এই বইটা তিনি লিখেছেন। প্রায় প্রতিটা মানুষের মধ্যেই কোনো না কোনো ধরনের কগনিটিভ বায়াসনেস রয়েছে। যাঁদের মধ্যে রয়েছে তাঁদের বেশিরভাগেরই ধারণা নেই যে তাঁরা আসলে কগনিটিভ বায়াসনেসে ভুগছেন। রলফ ডুবেলির এই বইটা পড়লে আর নিজের সাথে খানিকটা বোঝাপড়া করলে নিজের মধ্যে থাকা অনেক কগনিটিভ বায়াসকেই আবিষ্কার করা সম্ভব। আর আবিষ্কার করে ফেলতে পারলে, নিজেকে এই বায়াসনেসের হাত থেকে বাঁচানোরও একটা সুযোগ তৈরি হয়ে যায়। রলফ তাঁর বইতে নিরানব্বইটা কগনিটিভ বায়াসনেস নিয়ে আলোচনা করেছেন। কাজেই, আপনার মধ্যে যে কোনো ধরনেরই বায়াসনেস থাকুক না কেনো, সেটাকে চিহ্নিত করতে খুব বেশি সমস্যা না হবারই কথা। এই নিরাব্বইটার যে কোনো একটাতে কিংবা একাধিকটাতে নিশ্চিতভাবে আপনার নিজস্ব কগনিটিভ বায়াসনেস চুপটি করে বসে রয়েছে। বসে থেকে আপনাকে আপনার নিজস্ব বিচার ক্ষমতা এবং বিবেচনাবোধকে বাধাগ্রস্ত করছে চুপিসারে। আর একবার চিহ্নিত করতে পারলে, এটাকে অতিক্রম করার প্রচেষ্টাটা অন্তত আপনি নিতে পারবেন। হয়ে উঠতে পারবেন একজন যুক্তিবোধসম্পন্ন মানুষ।
-------------------------------------
লেখাটা নিহত আবরার ফাহাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হলো।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ